সাধারণ মানুষের স্বার্থে ঘা
Privatisation

কাদের সুবিধা দিতে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক বেসরকারিকরণ করছে সরকার?

বর্তমানে সব থেকে বেশি রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা আছে ব্যাঙ্কিং ক্ষেত্রে, সব মিলিয়ে ১২টি।

Advertisement

প্রসেনজিৎ বসু

শেষ আপডেট: ১৬ মার্চ ২০২১ ০৫:৪৫
Share:

করোনা অতিমারিজনিত অর্থনৈতিক মন্দা মোকাবিলায় মোদী সরকারের ‘আত্মনির্ভর প্যাকেজ’ ঘোষণার সময়ই অর্থমন্ত্রী জানিয়েছিলেন যে, রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা বেসরকারিকরণের নতুন নীতি আনতে চলেছে সরকার। ফেব্রুয়ারির কেন্দ্রীয় বাজেটে পূর্ণাঙ্গ রূপে প্রকাশিত সেই নীতিতে প্রতিরক্ষা, পরমাণু শক্তি, ব্যাঙ্ক, বিমা এবং অন্যান্য আর্থিক পরিষেবা, বিদ্যুৎ, পেট্রোপণ্য, কয়লা-সহ বিভিন্ন খনিজ, পরিবহণ, টেলিকম ইত্যাদি ক্ষেত্রকে ‘স্ট্র্যাটেজিক’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। কেন্দ্রীয় সরকার এই কয়েকটি ক্ষেত্রে যৎসামান্য কিছু রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা রেখে বাকি সব সরকারি সংস্থাকে বিলগ্নীকরণ এবং ‘স্ট্র্যাটেজিক সেল’ মারফত বেচে দিতে চাইছে। কেন্দ্রের নীতি অনুযায়ী স্ট্র্যাটেজিক ক্ষেত্রেও তিন বা চারটের বেশি রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা থাকবে না।

Advertisement


বর্তমানে সব থেকে বেশি রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা আছে ব্যাঙ্কিং ক্ষেত্রে, সব মিলিয়ে ১২টি। অর্থমন্ত্রীর ঘোষণা অনুযায়ী, এর মধ্যে যে কোনও দু’টি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক আগামী অর্থবর্ষেই বিক্রি হবে। এই বাবদ সরকারের এক লক্ষ কোটি টাকা আয় হবে বলে কেন্দ্রীয় বাজেটের হিসেবেও ধরা হয়েছে। এর বিরুদ্ধেই দুই দিনের ব্যাঙ্ক ধর্মঘট ডেকেছে ব্যাঙ্ক কর্মচারী এবং অফিসারদের ইউনিয়নের যৌথ মঞ্চ, ইউএফবিইউ।


রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের বেসরকারিকরণ কতটা যুক্তিসম্মত? ভারতে ব্যাঙ্কিং ক্ষেত্রের অভিজ্ঞতাই বা কি? ভারতীয় রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের রিপোর্ট অন কারেন্সি অ্যান্ড ফাইনান্স (বিশেষ সংখ্যা, চতুর্থ খণ্ড, ২০০৬-০৮) থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, স্বাধীনতার সময় ভারতে কোনও সরকারি ব্যাঙ্ক ছিল না; ছিল ৬৩৮টি প্রাইভেট ব্যাঙ্ক আর ৩৯৫টি সমবায় ব্যাঙ্ক। স্বাধীনতার পর প্রথম আট বছরে সব মিলিয়ে ৩৬১টি ব্যাঙ্ক ফেল করে, যার ফলে বহু আমানতকারী সর্বস্বান্ত হন। এর পর ১৯৫৫ সালে সর্ববৃহৎ ইম্পিরিয়াল ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া-র জাতীয়করণ করে তৈরি হয় ভারতীয় স্টেট ব্যাঙ্ক।

Advertisement


বড় পুঁজিপতিদের মালিকানায় বেসরকারি ব্যাঙ্কগুলি সম্পদ কুক্ষিগত করে রেখে ব্যাঙ্ক চালাত নিজেদের সঙ্কীর্ণ স্বার্থে। গ্রামাঞ্চলের কৃষক, শহরের ছোট ব্যবসায়ী বা মধ্যবিত্তদের ঋণ দেওয়ায় এই ব্যাঙ্কগুলির ছিল প্রবল অনীহা। ১৯৫২ থেকে ১৯৬৯, এই ১৭ বছরে সারা দেশে ব্যাঙ্কের শাখার সংখ্যা চার হাজার থেকে বেড়ে হয় মাত্র আট হাজার। এর পর ১৯৬৯ সালে ১৪টি বাণিজ্যিক ব্যাঙ্ককে রাষ্ট্রায়ত্ত করা হয়। ১৯৭৫-এর মধ্যে দশ হাজারের বেশি নতুন ব্যাঙ্কের ব্রাঞ্চ খোলা হয়, যার বড় অংশই ছিল গ্রামীণ শাখা। ১৯৮০-তে আরও ৬টি ব্যাঙ্ক রাষ্ট্রায়ত্ত হওয়ার ফলে ১৯৯০ সালের মধ্যে সারা দেশে ব্যাঙ্কের শাখার সংখ্যা পৌঁছে যায় ৫৯ হাজারের বেশি, যার মধ্যে ৩৪ হাজারের বেশি গ্রামীণ শাখা। সবুজ বিপ্লব, খাদ্যশস্য উৎপাদনে আত্মনির্ভরতা অর্জন বা শিল্প-পরিকাঠামো নির্মাণ, দেশে আমজনতার স্বার্থে যতটুকু উন্নয়ন হয়েছে, তার অনেকটাই রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের হাত ধরেই এসেছে।


১৯৯০-এর দশক থেকে অনেকগুলি নতুন বেসরকারি ব্যাঙ্ক খুললেও রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলিকে কিন্তু কোনও সরকারই বিক্রি করে দিতে পারেনি। ব্যাঙ্কিং ক্ষেত্রের ট্রেড ইউনিয়নগুলির বিরোধিতা তো ছিলই, পূর্ব অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে সাধারণ ব্যাঙ্ক গ্রাহকদের মধ্যে বেসরকারিকরণের বিরুদ্ধে জনমত ছিল প্রবল। ২০০৭-০৮ অর্থবর্ষে বিশ্ব জুড়ে যে আর্থিক সঙ্কট আসে, তার মূলে ছিল বিভিন্ন বহুজাতিক বেসরকারি ব্যাঙ্কগুলির আর্থিক বাজারে ফাটকাবাজি এবং রিয়্যাল এস্টেট ব্যবসায় ঋণ নিয়ে বেপরোয়া কারসাজি। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের আধিপত্যের কারণে এই ধরনের বল্গাহীন, ঝুঁকিপূর্ণ আচরণ থেকে ভারতের অর্থব্যবস্থা অনেকটাই মুক্ত।
গত তিন দশকে ভারতে যতগুলি ব্যাঙ্ক ফেল করেছে, প্রত্যেকটাই বেসরকারি। যেমন সাম্প্রতিক সময়ে ইয়েস ব্যাঙ্ক, লক্ষ্মীবিলাস ব্যাঙ্ক বা দুই দশক আগে গ্লোবাল ট্রাস্ট ব্যাঙ্ক। কিন্তু আজ অবধি কোনও রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের ফেল করার নজির নেই। রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ভারতে সমস্ত পরিবারের মোট আর্থিক সঞ্চয়ের ৫৬ শতাংশের বেশি গচ্ছিত রয়েছে বাণিজ্যিক এবং কোঅপারেটিভ ব্যাঙ্কগুলিতে, ২৩ শতাংশের কাছাকাছি জীবনবিমায়, ৭ শতাংশ মিউচুয়াল ফান্ডে এবং বাকিটা নগদ টাকায়। আজও ভারতের সমগ্র ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থার মোট সম্পদ, আমানত এবং প্রদত্ত ঋণের ৬০% রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলির। জনগণের কষ্টার্জিত সঞ্চয়ের সিংহভাগ যে হেতু ব্যাঙ্কব্যবস্থাতেই গচ্ছিত, সেই সঞ্চয়ের সুরক্ষায় এবং আর্থিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের কোনও বিকল্প নেই।


রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলি অবশ্যই সমস্যার ঊর্ধ্বে নয়। আধুনিক যুগের গ্রাহকদের প্রত্যাশার অনুরূপ পরিষেবা তারা অনেক ক্ষেত্রেই দিতে পারে না। তদুপরি বৃহৎ শিল্পে ঋণ দেওয়ার প্রক্রিয়ায় দুর্নীতি, স্বজনপোষণ, ঋণখেলাপ এবং জালিয়াতির প্রবণতা গত এক দশকে অনেকটাই ফুলেফেঁপে উঠেছে। এর ফলে জমেছে পাহাড়প্রমাণ অনাদায়ি ঋণের বোঝা। এর ফলে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলি দুর্বল হয়েছে, কমে গিয়েছে ঋণ এবং আমানত বৃদ্ধির হার।


কেন্দ্রীয় অর্থ মন্ত্রকের তথ্য অনুযায়ী, বাণিজ্যিক ব্যাঙ্কগুলির অনাদায়ি ঋণের পরিমাণ ২০১৭-১৮ অর্থবর্ষে ১০ লক্ষ কোটি টাকা ছাড়িয়েছিল। এটা ডিসেম্বর ২০২০-তে খানিকটা কমে হয়েছে ৭.৫ লক্ষ কোটি টাকা, যার মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলির অংশ ৫.৭৭ লক্ষ কোটি টাকা। মন্দার ধাক্কায় আগামী দিনে এই বোঝা আরও বাড়তে চলেছে বলে জানিয়েছে রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের ফাইনানশিয়াল স্টেবিলিটি রিপোর্ট (জানুয়ারি ২০২১)। কিন্তু এর জন্য মূলত দায়ী কারা?
মোট ব্যাঙ্কঋণের অর্ধেক যায় বৃহৎ ঋণগ্রহীতাদের কাছে, যাঁরা পাঁচ কোটি টাকার বেশি ঋণ পেয়েছেন। গোটা ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থার মোট অনুৎপাদক সম্পদের ৭৩%-র বেশি জমেছে এই বৃহৎ ঋণগ্রহীতাদের দৌলতে। অর্থাৎ, ভারতের বড় ব্যবসায়ীরা মূলত রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক থেকে কোটি কোটি টাকা ধার নিয়ে আর ফেরত দিচ্ছেন না। শুধু বিজয় মাল্য, নীরব মোদীদের মতো জালিয়াতিতে অভিযুক্ত হয়ে বিদেশে চম্পট দেওয়ারাই নয়, ঋণখেলাপিদের তালিকায় আছেন দেশের সবচেয়ে বড়লোক শিল্পপতিরা। এহেন অনাচারকেই ‘রিস্কলেস ক্যাপিটালিজ়ম’ বা ঝুঁকিহীন পুঁজিবাদ আখ্যা দিয়েছিলেন রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের এক প্রাক্তন গভর্নর।
রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৪-১৫ থেকে ২০১৯-২০, এই ৬ বছরে নতুন অনুৎপাদক সম্পদ বেড়েছে প্রায় ১৮ লক্ষ কোটি টাকা। এর মধ্যে উদ্ধার হয়েছে মাত্র ৫.৭১ লক্ষ কোটি টাকা। আর ৬.৭৮ লক্ষ কোটি টাকার অনাদায়ি বা মন্দ ঋণ ‘রাইট অফ’ করে দেওয়া হয়েছে, অর্থাৎ ব্যাঙ্কের হিসেবের খাতা থেকে মুছে দেওয়া হয়েছে। ভাল পরিমাণ অপারেটিং প্রফিট থাকা সত্ত্বেও, মন্দ ঋণ ‘রাইট অফ’ করতে গিয়ে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলির গত পাঁচ বছরে কয়েক লক্ষ কোটি টাকা লোকসান হয়েছে।


এখানে যেটা উল্লেখযোগ্য, তা হল, গত চার বছরে কেন্দ্রীয় সরকার ২.৭১ লক্ষ কোটি টাকা ধার করে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলিতে পুঁজি হিসেবে বিনিয়োগ করেছে, যে ধার সুদ সমেত করদাতাদেরই মেটাতে হবে। এক দিকে করদাতাদের টাকায় ব্যাঙ্কে পুঁজি নিবেশ, আর অন্য দিকে ব্যালান্স শিট থেকে মন্দ ঋণ সরাতে লোকসান এবং পুঁজির ক্ষয়— মোদী সরকারের আমলে এ ভাবেই ঋণখেলাপি ব্যবসায়ীদের স্বার্থরক্ষা চলছে। ২০১৭ সালের একটি রিপোর্টে সিএজি (কম্পট্রোলার ও অডিটর জেনারেল) রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের মন্দ ঋণ উদ্ধারের থেকে বেশি পরিমাণে রাইট অফ করার বিরুদ্ধে অর্থ মন্ত্রককে সতর্ক করা সত্ত্বেও এটা ঘটেছে। কোন বড় ব্যবসায়ী এবং ঋণগ্রহীতা রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলির এই মন্দ ঋণ রাইট অফ-এর ফলে লাভবান হয়েছেন, তা সরকারি গোপনীয়তার কারণে জানা অসম্ভব।
ব্যাঙ্কিংব্যবস্থার বর্তমান সঙ্কটের নেপথ্যে আছে বাণিজ্যিক ব্যাঙ্কগুলির, বিশেষত রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কসমূহের বর্ধমান অনুৎপাদক সম্পদের পরিমাণ। এর থেকে বেরোনোর একটাই পথ; ঋণখেলাপি বড় ব্যবসায়ীদের থেকে অনাদায়ি ঋণ দ্রুত আদায় করার ব্যবস্থা করা। এর জন্য প্রয়োজন আর্থিক আইন এবং বিচারব্যবস্থার সংস্কার, সর্বোপরি রাজনৈতিক সদিচ্ছা। সেই পথে না হেঁটে মোদী সরকার যে ভাবে এই ঋণখেলাপি ব্যবসায়ী শ্রেণির কাছেই রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলিকে বেচে দিতে উদ্যত হয়েছে, সেটা সাঙাততন্ত্রের একটা চরম নিদর্শন।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement