এইটুকুই: যুব কংগ্রেস কর্মীদের দাবি সর্বভারতীয় মেডিক্যাল পরীক্ষা যাতে স্বাভাবিক পরীক্ষার মতো পরিচালিত হয়, গুরুগ্রাম, ২৫ জুন। পিটিআই।
মেডিক্যাল কলেজের প্রবেশিকা পরীক্ষা ‘নিট’-এ দুর্নীতি নিয়ে অভিযোগের ঝড় উঠেছে। বাতিল হয়েছে স্নাতকোত্তরের প্রবেশিকা (নিট-পিজি)। যত উঁচু নির্মাণই হোক, ভিত্তিতে বিস্ফোরক ঠুসে আগুন দিলেই নিমেষে তা ধ্বংস হয়। প্রবেশিকা পরীক্ষা বাতিল যেন তেমনই। অবশ্য প্রথম প্রশ্ন তুলতে হবে ভারতের মেডিক্যাল শিক্ষারব্যবস্থাকে নিয়েই। যাকে আজ এক মেকি সৌধ বলে মনে হয় আমার।
কেন, তা বুঝতে চাইলে ফিরে যেতে হবে ভারতের অর্থনীতিতে বিশ্বায়নের সময়টিতে। নব্বইয়ের দশকের গোড়ায়, যখন উদারবাদী নীতি গ্রহণ করল সরকার, তখন নানা ধারণার মধ্যে প্রাধান্য পেল এই চিন্তাটিও যে, মেডিক্যাল শিক্ষার জন্য সরকারকে অনেক টাকা খরচ করতে হচ্ছে। সরকারের বোঝা কমাতে, এবং একই সঙ্গে যথেষ্ট ডাক্তার তৈরি করতে, বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজ খোলা দরকার। পয়সা দিয়ে মেডিক্যাল শিক্ষা কেনা যে তার আগে চালু ছিল না, এমন নয়। কিছু আসন থাকত সরকারি ‘কোটা’-র অধীনে, রাজনৈতিক ক্ষমতা কিংবা ঘুষের জোরে সেগুলি পেত কিছু ছাত্রছাত্রী। অবশ্যই এ সব আসনের সংখ্যা ছিল খুব কম। সেই কালোবাজারিকে এ বার নিয়ে আসা হল খোলা বাজারে। টাকা দিয়ে মেডিক্যাল শিক্ষা ক্রয় আইনসিদ্ধ হল। বিনিয়োগে উৎসাহী ব্যবসায়ী, রোজগার-প্রতিপত্তি বাড়ানোয় আগ্রহী চিকিৎসক, এবং সন্তানকে চিকিৎসক করার স্বপ্নে বিভোর অভিভাবক, সকলেই তার সুযোগ নিলেন।
বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজ অনুমোদন পাওয়ার প্রথম পর্বে আমরা শুনেছিলাম, কুড়ি থেকে ত্রিশ শতাংশ আসন থাকবে বেসরকারি কলেজে, সত্তর-আশি শতাংশই সরকারি কলেজে। সরকারি শিক্ষার সহযোগী, বা পরিপূরক একটা ব্যবস্থা তৈরি হবে বেসরকারি ক্ষেত্রে। আজ দেখা যাচ্ছে, বেসরকারি কলেজের সংখ্যা সরকারি কলেজের তুলনায় কম হলেও, সেখানে আসন বেশি। তাই দেশের অর্ধেক মেডিক্যাল আসনই বেসরকারি কলেজে। দেখা গিয়েছে, আসন বাড়ানোর শর্ত পূরণ করতে সরকারি কলেজ যখন হিমশিম খায়, তখন সহজেই অনুমোদন পেয়ে যায় বেসরকারি কলেজগুলো। কী করে কার্যসিদ্ধি হয়, আন্দাজ করা কঠিন নয়। বিনিয়োগ এবং লাভ, এই চক্র ক্রমশ মেডিক্যাল শিক্ষাব্যবস্থার কেন্দ্রে চলে এল।
শিক্ষায় কেন্দ্রীকরণের ঝোঁক থেকে মেডিক্যাল কলেজে ভর্তির সর্বভারতীয় ‘নিট’ শুরু হয় ২০১৩ সালে। তার আগে রাজ্যগুলি মেডিক্যাল প্রবেশিকা পরীক্ষা নিত। ‘নিট’-এর ব্যবস্থার মধ্যেই একটা অন্যায় রয়েছে, কারণ এই পরীক্ষা রাজ্য বোর্ডগুলিতে, মাতৃভাষায় পড়াশোনা করা ছেলেমেয়েদের অনুকূল নয়। এর সুবিধে বেশি পায় ইংরেজি ও হিন্দি মাধ্যমের, কেন্দ্রীয় বোর্ডের ছাত্রছাত্রীরা। অ-হিন্দিভাষী রাজ্যগুলি ‘নিট’-এর বিরোধিতা করে দেখিয়েছে যে, নিট-উত্তীর্ণদের মধ্যে রাজ্য বোর্ডের ছাত্রছাত্রীদের সংখ্যা নগণ্য।
প্রশ্ন ওঠে নিট-এর ভিত্তিতে ভর্তির ব্যবস্থাপনা নিয়েও। ছবিটা এই রকম যে, তেইশ লক্ষ নিট-পরীক্ষার্থীর মধ্যে বারো লক্ষকেই ‘নিট-উত্তীর্ণ’ ঘোষণা করা হয়। আসল প্রতিযোগিতা হয় হাজার পঞ্চাশেক সরকারি আসনের জন্য। বাকি পঞ্চাশ হাজার আসনে যে মেধাতালিকার ক্রম অনুসারে ভর্তি হয়, তা কিন্তু নয়। সেখানে বিপুল টাকা দিতে পারার ক্ষমতাই শেষ কথা। এমনকি নিট পাশ করেনি যারা, তাদেরও ভর্তির সুযোগ করে দিতে ‘নিট অ্যাপিয়ার্ড’ (নিট-এ বসেছিল) নামে একটি আলাদা শ্রেণি তৈরি করেছে বেসরকারি কলেজ। তাই শূন্য পেয়েও কলেজে ভর্তি হওয়া সম্ভব।
এ সবের যা অবধারিত ফল, তা-ই হয়েছে— চাহিদাকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে জোগান। প্রচুর বেসরকারি এঞ্জিনিয়ারিং কলেজ যেমন শূন্য আসন নিয়ে ধুঁকছে, তেমন সঙ্কটের দিকে যাচ্ছে মেডিক্যাল শিক্ষাও। ভারতে হাজার মানুষ পিছু এক জন এমবিবিএস তৈরির লক্ষ্য ছিল। এখন সেই অনুপাত আটশো কুড়িতে এক জন চিকিৎসক। এগারো-বারো লক্ষ চিকিৎসক কাজ করছেন। বেসরকারি মেডিক্যাল শিক্ষায় বিনিয়োগকারীদের (প্রায় প্রতি কলেজেই কোনও রাজনৈতিক প্রভাবশালী যুক্ত রয়েছেন) টনক নড়েছে। টিউটোরিয়াল, মক টেস্ট, ক্যাপিটেশন ফি, চড়া টিউশন ফি-র অঢেল খদ্দের আর বেশি দিন জুটবে কি?
গরমে ঘামাচি বেরোনোর মতো, যে কোনও পরীক্ষায় কিছু ‘পেপার লিক’ ভারতে গা-সওয়া এখন। কিন্তু এ বছর নিট-এ যেন দুর্নীতির সুনামি দেখা গেল। প্রশ্নপত্র তৈরি, ছাপা হওয়া, ওএমআর শিট সংগ্রহ, নম্বর ট্যাবুলেশন, তার পরেও ‘গ্রেস মার্ক’ পাইয়ে দেওয়া, প্রতি ধাপে যত দূর সম্ভব অনিয়ম। তার ফলে দুর্নীতির মাত্রা আগের বছরগুলিকে বহুগুণ ছাড়িয়ে গিয়েছে। মরিয়া ভাবে টাকা তোলার এই চেষ্টা দেখে মনে হয়, যেন তর সইছে না। বুদবুদ এ বার মিলিয়ে যাবে, সেই আশঙ্কায় সময় থাকতে লুটেপুটে নেওয়ার চেষ্টা করছে কিছু লোক।
বস্তুত নিট-দুর্নীতির বিস্তার কতখানি, তা আদৌ স্পষ্ট নয়। যেমন, হাজার দেড়েক পরীক্ষার্থীর গ্রেস মার্ক বাতিল করে, তাদের ফের পরীক্ষায় বসতে বলেছে সুপ্রিম কোর্ট। কিন্তু এরা কেবল সেই সব পরীক্ষার্থী, যাদের গ্রেস মার্ক দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিল কোনও নিম্ন আদালত। আরও কত জনের ওএমআর শিট এবং ট্যাবুলেশন-এ তোলা মোট নম্বরে ফারাক রয়েছে, পয়সার খেলায় নীরবে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে ‘গ্রেস মার্ক’, তা কে খতিয়ে দেখতে গিয়েছে? এমনও শোনা যাচ্ছে যে, কয়েকশো সফল পরীক্ষার্থীর ওএমআর শিট নষ্ট করে ফেলা হয়েছে, যাতে বেনোজল ঢোকানো যায় সহজে।
মূল্যায়নে কতটা জল মিশেছে, তার একটা আন্দাজ পাওয়া যায় এ থেকে যে, গত বছর ৬৫০ নম্বরের আশেপাশে পাওয়া পরীক্ষার্থী যেখানে দশ হাজার র্যাঙ্কের আশেপাশে ছিল, এ বছর (মোট পরীক্ষার্থী না বাড়া সত্ত্বেও) একই নম্বর পাওয়া পরীক্ষার্থীর র্যাঙ্ক হয়েছে চল্লিশ হাজারের কাছাকাছি। যথাযথ মূল্যায়ন হলে এটা কী করে সম্ভব? এই পরিস্থিতিতেও যে মেডিক্যাল কলেজে ভর্তির কাউন্সেলিং চলছে, সেটা দুর্ভাগ্যজনক। নির্ধারিত কলেজ বদলে যাবে, বা নিট বাতিল হয়ে যাবে, তার সম্ভাবনা যথেষ্ট।
এত এলোমেলো, নিরাপত্তাহীন কী করে হয় পরীক্ষাব্যবস্থা? কারণ, গোড়ায় গলদ। আমেরিকার ‘কলেজ বোর্ড’ ব্যবস্থা অনুকরণ করতে চেয়েছিল কেন্দ্র। কিন্তু প্রবেশিকা পরীক্ষার ভারপ্রাপ্ত কলেজ বোর্ড একটি সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র, স্বায়ত্তশাসিত, আর্থিক ভাবে স্বাধীন একটি প্রতিষ্ঠান, যার সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন অন্তত পাঁচ হাজার শিক্ষক। এ দেশে প্রথম কয়েক বছর সিবিএসই ‘নিট’ পরীক্ষা নিয়েছে। ২০১৭ সালে প্রতিষ্ঠা হয়েছে ‘ন্যাশনাল টেস্টিং অথরিটি’। এটি নামেই স্বতন্ত্র। পরীক্ষা-কেলেঙ্কারির পর প্রকাশ পাচ্ছে, এনটিএ কার্যত নিধিরাম সর্দার— যথেষ্ট কর্মী, উন্নত প্রযুক্তিগত পরিকাঠামো, প্রশ্নপত্র ছাপানোর জন্য সুরক্ষিত ছাপাখানা, কিছুই নেই। তার উপর এই তথাকথিত স্বায়ত্তশাসিত সংস্থার সদস্যদের মাথায় বসে রয়েছেন কেন্দ্রীয় সরকারের কিছু আধিকারিক।
বাজার হয়তো নিজের নিয়মে সংশোধন করবে এই পরিস্থিতিকে, কিন্তু তত দিনে অনেক ক্ষতি হয়ে যাবে। কার্যত হত্যা করা হবে একটি প্রজন্মের আশা-আকাঙ্ক্ষাকে। পরিত্রাণের উপায় দু’টি। এক দিকে বেসরকারিকরণে লাগাম টানা। অন্য দিকে সর্বগ্রাসী কেন্দ্রীকরণ রুখে, রাজ্যগুলির ক্ষমতা ফিরিয়ে দেওয়া। যত দিন না পরীক্ষা পরিচালনার জন্য আস্থাযোগ্য একটি কেন্দ্রীয় সংস্থা তৈরি হয়, তত দিন রাজ্য স্তরে জয়েন্ট এন্ট্রান্স পরীক্ষা চালু থাকুক। তাতে ক্ষতির আশঙ্কা কম।