—প্রতীকী চিত্র।
আউটকাম চাই।”— সম্প্রতি শহরে কোয়ান্টাম টেকনোলজি বিষয়ক এক অনুষ্ঠানে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি দফতরের এক শীর্ষস্থানীয় কর্তার মুখে বার বারই শোনা গেল এ কথা। গত বছর কোয়ান্টাম গবেষণায় ৬০০৩ কোটি টাকা বরাদ্দ করে সরকার। কারণ যে বিপুল লাভের সম্ভাবনা, সে কথা ঘুরে-ফিরে এসেছে ওই কর্তার মুখে।
আউটকাম কী? মুনাফা। সরকারের ঘরে মুনাফা আনবে কোয়ান্টাম প্রযুক্তি-ভিত্তিক কৃত্রিম মেধা, মুনাফা আনবে কোয়ান্টাম কম্পিউটার। যেমন, মুনাফা এনেছে মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্র ইসরো। স্বল্প খরচ ও বিশ্বাসযোগ্যতা— এই দুইয়ের উপর ভর করে গত কয়েক বছরে বিদেশি উপগ্রহ উৎক্ষেপণ-সহ বিবিধ ক্ষেত্রে ইসরোর হাত ধরে বিদেশি মুদ্রা ঢুকেছে রাজকোষে। তবে কি বিজ্ঞান গবেষণারও পুরোপুরি ‘বাণিজ্যিকীকরণ’ ঘটাতে চাইছে নরেন্দ্র মোদীর সরকার! মুনাফা মিললে তবেই বিনিয়োগ?
ভারতে চিরকালই এই প্রশ্ন উঠেছে, যে দেশে এত অভাব, সেখানে বিজ্ঞান-চর্চায় হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ কেন? এক সময়ে কাঠগড়ায় তোলা হয়েছিল ইসরোকেও, যদিও তাদের সাফল্যে সেই প্রশ্নবাণ কিছুটা কমেছে। সাধারণ মানুষ এখন জানেন, খরচ নয়, এটা ‘বিনিয়োগ’। যদিও গবেষকদের আক্ষেপ, বিজ্ঞানও যদি ‘বিনিয়োগ’ হয়ে যায়, সে ক্ষেত্রে বিজ্ঞানচর্চার মান তলানিতে গিয়ে ঠেকা অবশ্যম্ভাবী। বর্তমানে পরিস্থিতি এমনটাই দাঁড়িয়েছে যে, বহু ক্ষেত্রে গবেষণার ফলাফল কী হবে জেনে, তবে অর্থ দেওয়া হচ্ছে। অর্থাৎ, ‘বিনিয়োগ’ লাভজনক হলে তবেই মিলবে টাকা। কিন্তু কোনও গবেষণার ফলাফল কী হবে, তা কখনওই আগে থেকে নিশ্চিত করে জানা সম্ভব নয়। তা ছাড়া, ফলিত গবেষণা (অ্যাপ্লায়েড সায়েন্স রিসার্চ) একপ্রকার, মৌলিক গবেষণায় (ফান্ডামেন্টাল রিসার্চ) কখনও হাতেগরম ফল পাওয়া সম্ভব নয়। তবে দুই ক্ষেত্রেই গবেষণা সিঁড়ির ধাপের মতো। সিঁড়ির শেষ ধাপে পৌঁছতে হলে মাঝের ধাপগুলো পেরোতেই হবে।
কাতালিন কারিকোর কাহিনিই ধরা যাক। হাঙ্গেরিয়ান-আমেরিকান এই বিজ্ঞানী গত বছর চিকিৎসাবিজ্ঞানে নোবেল পেয়েছেন। যে গবেষণার জন্য তিনি নোবেল পেয়েছেন, সেই কাজটি করেছিলেন বিশ বছর আগে। সে সময়ে এমআরএনএ প্রযুক্তি নিয়ে তাঁর গবেষণাকে কেউ গুরুত্ব দিতে চায়নি। অথচ, তাঁকে নিয়েই হইচই পড়ে গেল প্রায় দু’দশক পরে। কারণ, তাঁর দেখানো এমআরএনএ প্রযুক্তিকে ব্যবহার করে প্রায় রেকর্ড গতিতে করোনাভাইরাসের প্রতিষেধক তৈরি হয়েছে। নোবেল পুরস্কারে সম্মানিত হয়েছেন প্রবীণা। নোবেল কমিটি মনে করিয়ে দিয়েছে, মৌলিক বিজ্ঞানচর্চার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা।
সদ্য সমাপ্ত অন্তর্বর্তীকালীন বাজেট বক্তৃতায় কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন জানিয়েছেন, প্রযুক্তি ক্ষেত্রে গবেষণার জন্য এক লক্ষ কোটি টাকার তহবিল গঠন করা হবে। উদ্ভাবনকে ‘উন্নয়নের ভিত্তি’ বলে অভিহিত করে তিনি বলেছেন, “৫০ বছরের সুদমুক্ত ঋণ দেওয়ার জন্য এক লক্ষ কোটি টাকার তহবিল গঠিত হবে।” নির্মলা জানিয়েছেন, কেন্দ্রের উদ্যোগ বেসরকারি ক্ষেত্রকে গবেষণা ও উদ্ভাবনে উৎসাহিত করবে। বিজ্ঞানীদের বক্তব্য, এর সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় বা গবেষণা প্রতিষ্ঠানের কোনও যোগ নেই। তাঁদের অনেকেরই বক্তব্য, এ ভাবে গবেষণার জন্য এক লক্ষ কোটি টাকার তহবিল গঠন করে বেসরকারি সংস্থাগুলিকে সুদমুক্ত ঋণ দেওয়ার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। গত বছর প্রধানমন্ত্রীকে মাথায় বসিয়ে ‘ন্যাশনাল রিসার্চ ফাউন্ডেশন’ (এনআরএফ) গঠন করে পাঁচ বছরে গবেষণার জন্য ৫০ হাজার কোটি টাকা খরচ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল সরকার। অধ্যাপক-গবেষকদের প্রত্যাশা ছিল, সেই অনুদানের ব্যবস্থা এই বাজেটে থাকবে। তাঁদের অভিযোগ, ‘এনআরএফ’ গঠন করে আসলে ইউজিসি-সহ কেন্দ্রীয় অর্থবরাদ্দকারী সংস্থাগুলিকে অকেজো করে দেওয়া হয়েছে। ইউজিসি-র বড় মাপের গবেষণা প্রকল্প, স্পেশাল অ্যাসিস্ট্যান্স প্রোগ্রাম, নন-নেট ফেলোশিপ প্রোগ্রাম বন্ধ হয়ে গিয়েছে। গবেষকদের টাকা দেওয়া হচ্ছে না। নতুন যাঁরা গবেষণায় আসছেন, তাঁরা প্রবল বাধার মুখে পড়ছেন। কেন্দ্রীয় সংস্থাগুলি কোন কোন বিষয়ে গবেষণা করতে হবে, তা-ও প্রায় ঠিক করে দিচ্ছে। এ সবেরই উল্লেখ ছিল রূপালী গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘বিজ্ঞান-ঐতিহ্য বর্জন’ প্রবন্ধে (২১-১)।
প্রশ্ন হচ্ছে, এ ভাবে চললে কি আদৌ বিজ্ঞানের অগ্রগতি ঘটবে, না কি অবনতি? বিজ্ঞান-শিক্ষার পরিকাঠামো ফোঁপরা হয়ে যাবে না তো? গত দশ বছরে গবেষণা খাতে যা বরাদ্দ (জিইআরডি) কমেছে, তা বিশ্বের গড়ের তুলনায় কম তো বটেই, অন্য উন্নয়নশীল দেশগুলির থেকেও কম।
এই মুহূর্তে চিকিৎসাবিজ্ঞান গবেষণায় অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রযুক্তি ‘অর্গানয়েড’। ক্যানসার, স্কিৎজ়োফ্রেনিয়া, ডিমেনশিয়া রোগের গবেষণায় এর ব্যবহার করা হচ্ছে। অর্গানয়েড হল ল্যাবে তৈরি অঙ্গ বা অঙ্গের ক্ষুদ্র সংস্করণ। মস্তিষ্কের অর্গানয়েড তৈরি করে ব্রেনের নানা অসুখ বোঝার চেষ্টা করা হচ্ছে। অর্গানয়েড প্রযুক্তি আবিষ্কার এক দিনে হয়নি, ক্যানসার, অ্যালঝাইমার’স-সহ অন্যান্য কঠিন রোগের গবেষণায় এর ব্যবহারও চোখের নিমেষে দাওয়াই বাতলে দেবে না। কিন্তু পথ দেখাবে অবশ্যই। অন্ধকারে আলো ফেলবে। কমলকুমার মজুমদারের ভাষা একটু ঘুরিয়ে বলি, এ দেশ থেকে সেই আলো কি ‘ক্রমে সরিতেছে’?