উত্তাল: বকেয়া মহার্ঘ ভাতার দাবিতে সরকারি কর্মীদের বিক্ষোভ, কলকাতা, ১০ মার্চ। পিটিআই
গত সপ্তাহের শুক্রবার রাজ্য জুড়ে সরকারি কর্মচারীরা বকেয়া মহার্ঘ ভাতার দাবিতে ধর্মঘট করলেন। শনিবার রাতে দিল্লিতে এক অনুষ্ঠানে কেন্দ্রীয় অর্থ মন্ত্রকের এক শীর্ষকর্তার সঙ্গে দেখা। দেখামাত্রই তিনি বললেন, “আপনাদের রাজ্যে তো সরকারি কর্মচারীরা বকেয়া ডিএ-র দাবিতে আন্দোলন করছেন! ওঁদের অন্তত পেনশনের দাবিতে আন্দোলন করতে হচ্ছে না! পেনশনের তুলনায় ডিএ-র দাবি মেটানো অনেক সহজ। বাকি সব রাজ্য তো পেনশন নিয়ে জেরবার!”দেশের অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামনের প্রিয় এই অফিসারকে জানানো গেল, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রাজ্যের বিধানসভায় কিছুটা এই যুক্তিই দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, দেশের কোনও রাজ্য এখন অবসরপ্রাপ্তদের পেনশন দেয় না। পশ্চিমবঙ্গ দেয়। পেনশন না দিলে ২০ হাজার কোটি টাকা বেঁচে যায়। এর পরেই তিনি বিরোধী দলগুলির উদ্দেশে প্রশ্ন করেন, “পেনশন বন্ধ করে দেব?”
স্বাভাবিক ভাবেই তাতে চিঁড়ে ভেজেনি। সরকারি কর্মচারী থেকে বিরোধী শিবিরের নেতাদের, সবার কথা হল, রাজ্য সরকার দুর্গাপুজোর সময় যদি ক্লাবগুলোকে টাকা দিতে পারে, খেলা-মেলা-উৎসবে কোটি কোটি টাকা খরচ করতে পারে, তা হলে ডিএ দিতে সমস্যা কোথায়? নিয়োগ দুর্নীতিতে তৃণমূলের নেতারা কোটি কোটি টাকা লুট করছেন। কর্মচারীরা প্রাপ্য ডিএ পাবেন না কেন!
ডিএ-র আন্দোলনকে সামনে রেখে রাজনীতির নিয়মেই পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি, কংগ্রেস, সিপিএম ভোটের বাক্সে ফয়দা তুলতে চাইছে। সেই বিজেপি, কংগ্রেস, সিপিএম-ই আবার নিজেদের রাজ্যে সরকারি কর্মীদের বেতন, পেনশন, ডিএ দিতে গিয়ে নাস্তানাবুদ হচ্ছে। কোভিডের পর থেকে প্রায় সব রাজ্য সরকারেরই নুন আনতে পান্তা ফুরানোর দশা। তাতে অবশ্য রাজনীতির আগুনে ঢালার ঘি-এর অভাব হয় না। বিজেপি-শাসিত রাজ্যে পুরনো পেনশন প্রকল্প ফেরানোর দাবি উঠলে কংগ্রেস তাতে সমর্থন জানায়। কংগ্রেস-শাসিত রাজ্যে ঘোষণার পরেও পুরনো পেনশন প্রকল্প চালু হচ্ছে না কেন, তা নিয়ে বিজেপি প্রশ্ন তুলছে। পশ্চিমবঙ্গে সরকারি কর্মীদের বকেয়া ডিএ-র দাবিতে সিপিএম রাস্তায় নেমেছে। অথচ বামশাসিত কেরলে গত দু’বছর ধরে সরকারি কর্মীদের চার কিস্তি ডিএ কিন্তু এখনও বকেয়া পড়ে রয়েছে।
অটলবিহারী বাজপেয়ী সরকারের শেষবেলায় ২০০৪-এর ১ জানুয়ারি থেকে কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মচারীদের পুরনো পেনশন প্রকল্প তুলে দিয়ে নতুন পেনশন প্রকল্প চালু হয়েছিল। কেন্দ্রের দেখাদেখি রাজ্যগুলিতেও একই ব্যবস্থা চালু হয়েছে। আগের ব্যবস্থায় ২০ বছর চাকরির পরে অবসর নিলে শেষ পাওয়া মূল বেতনের ৫০ শতাংশ পেনশন মিলত। সেই পেনশন পেতে চাকরি করার সময় সরকারি কর্মীদের কোনও দায় নিতে হত না। নতুন পেনশন প্রকল্পে চাকরিরত অবস্থায় কর্মীদের মূল বেতনের ১৪ শতাংশ কেটে নিয়ে পেনশন তহবিলে জমা হয়। সরকার জমা করে ১০ শতাংশ। পেনশন তহবিলের টাকা শেয়ার বাজারে লগ্নি করে যা ফয়দা হয়, সেটাই পেনশন দেওয়া হয়। সেটা মূল বেতনের ৫০ শতাংশ হতে পারে। ৫ শতাংশও হতে পারে। কোনও গ্যারান্টি নেই।
নতুন ব্যবস্থায় সরকারি কর্মীদের পেনশনের অঙ্ক অনিশ্চয়তার মুখে পড়লেও কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারগুলি ভবিষ্যতের পেনশনের খরচ থেকে কার্যত মুক্তি পেয়ে গিয়েছে। একমাত্র ব্যতিক্রম পশ্চিমবঙ্গ। রাজ্যের বামফ্রন্ট সরকার কোনও দিনই পুরনো পেনশন প্রকল্প বাতিল করে নতুন পেনশন প্রকল্প চালু করেনি। ২০১১-য় ‘পরিবর্তন’-এর পরে তৃণমূল ক্ষমতায় এলেও পুরনো পেনশন প্রকল্প তুলে দেয়নি। এখন শুভেন্দু অধিকারী ডিএ-র দাবিতে অনশন-আন্দোলনের পাশে দাঁড়ানোয় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রশ্ন ছুড়েছেন, তা হলে কি পেনশন বন্ধ করে দেওয়া হবে?
ডিএ পেতে হলে পেনশন ছাড়তে হবে— রাজ্য সরকারি কর্মীরা এই যুক্তি কেন মানবেন? মানার কথাও নয়। শুভেন্দু অধিকারী তাই সরকারি কর্মীদের আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। কিন্তু শুভেন্দুবাবুর বর্তমান রাজনৈতিক দল বিজেপি নিজের রাজ্যে এই পেনশনের দাবিতেই জেরবার। চলতি বছরে ন’টি রাজ্যে বিধানসভা ভোট। আগামী বছর ২০২৪-এর লোকসভা ভোট। ভোটমুখী কর্নাটক থেকে মধ্যপ্রদেশ, একের পর এক বিজেপি-শাসিত রাজ্যে সরকারি কর্মীরা পুরনো পেনশন প্রকল্প ফেরানোর দাবিতে আন্দোলনে নামছেন। মহারাষ্ট্রে ১৭ লক্ষ কর্মী ধর্মঘটে নেমেছেন। প্রায় ৪৪ বছর পরে মহারাষ্ট্রে এই ধরনের ধর্মঘট হচ্ছে। দাবি একটাই— পুরনো পেনশন প্রকল্প ফেরাও।
কর্মী সংগঠনের নেতারাও জানেন, ভোটের মুখে রাজনৈতিক দলগুলোর থেকে এই সব দাবি আদায় করে নেওয়া সহজ। এই দাবির কাছে মাথা নুইয়েই ছত্তীসগঢ়, রাজস্থান, ঝাড়খণ্ড, পঞ্জাব, হিমাচল প্রদেশে অ-বিজেপি সরকার পুরনো পেনশন প্রকল্প চালু করেছে। বিজেপি-শাসিত কর্নাটক, হরিয়ানাতেও একই দাবি ওঠায় প্রমাদ গনছেন রাজ্যের গেরুয়া শিবিরের নেতারা। তাঁদের আশঙ্কা, হিমাচলের মতো কংগ্রেস ওই সব রাজ্যেও পুরনো পেনশন প্রকল্পের প্রতিশ্রুতি দিয়ে সরকারি কর্মীদের ভোট ঝুলিতে পুরে ফেলবে। রাজ্যের নেতারা দিশার খোঁজে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের মুখের দিকে তাকাচ্ছেন। উত্তর মিলছে না। কারণ, নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহ-নির্মলা সীতারামনরা জানেন, এক বার বিজেপি-শাসিত রাজ্যে পুরনো পেনশন প্রকল্পের দাবি মেনে নিলে কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মচারীরা মোদী সরকারের কাছে একই দাবি তুলবেন। ২০২৪-এর লোকসভা ভোটের আগে তার ঠেলা কে সামলাবে?
এমনিতেই কেন্দ্রীয় সরকারের বাজেটের ১০০ টাকার মধ্যে ১৬ টাকা বেতন, পেনশন দিতে খরচ হয়ে যায়। রাজ্যগুলিতেও একই হাল। কোভিডের আগের বছরে সব রাজ্যের মোট খরচের ১১ শতাংশ শুধু পেনশন মেটাতে খরচ হয়েছে। মোদী সরকারের অন্দরমহলের আশঙ্কা, ২০২৪-এর লোকসভা ভোটের আগে শাসক দলকে বেকায়দায় পেয়ে কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মীরাও পুরনো পেনশন প্রকল্প ফেরানোর দাবি তুলতে পারেন। ঠিক যে ভাবে ২০১৪-র লোকসভা ভোটের আগে সামরিক বাহিনী থেকে ‘এক পদ, এক পেনশন’ রূপায়ণের দাবি উঠেছিল। ভোটের সময় বিজেপি সেই দাবি পূরণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল বলে মোদী সরকারকে ক্ষমতায় এসে অবসরপ্রাপ্ত ফৌজিদের জন্য ‘এক পদ, এক পেনশন’ ব্যবস্থা চালু করতে হয়েছিল। আগামী বছর ফের লোকসভা ভোট। কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মচারী সংগঠনগুলির একাংশ ইতিমধ্যেই পুরনো পেনশন প্রকল্প ফেরানোর দাবি তুলে জানিয়েছে, জুলাই-অগস্ট মাসে সংসদের বাদল অধিবেশনের সময় তারা এই দাবি নিয়ে মাঠে নামবে।
কেন্দ্রে বা রাজ্যে বিজেপি সরকার বলতেই পারে যে, পুরনো পেনশনব্যবস্থা ফেরাতে হলে রাজকোষে বিপুল বোঝা চাপবে। তখন উন্নয়ন খাতে খরচ ছাঁটাই করতে হবে। আন্দোলনে নেমে পড়লে সরকারি কর্মীরা সে কথা কানে তুলবেন না। তাঁদের রাজকোষে বোঝার তত্ত্ব বোঝানো যাবে না। এখন যেমন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ডিএ-র দাবিতে অনড় রাজ্যের সরকারি কর্মীদের কিছুই বুঝিয়ে উঠতে পারছেন না। মহারাষ্ট্র, কর্নাটক, হরিয়ানায় তাই বিজেপি নেতাদের বলতে হচ্ছে, তাঁরা পুরনো পেনশন প্রকল্পের দাবি সহানুভূতির সঙ্গে খতিয়ে দেখবেন।
বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতারা জানেন, এখানেই শেষ নয়। অষ্টম বেতন কমিশনের দাবি উঠল বলে। সপ্তম বেতন কমিশনের পরে ১০ বছর কাটতে চলেছে। ২০১৫-য় সপ্তম বেতন কমিশন চালু হয়েছিল। লোকসভা ভোট যত এগিয়ে আসবে, ততই নতুন বেতন কমিশনের দাবি জোরালো হবে। লোকসভা ভোটের আগে অন্তত তার প্রতিশ্রুতি দিয়ে রাখাটা জরুরি। যদিও তার আর্থিক দায় কী ভাবে সামলানো হবে, তার উত্তর নেই।
জাতীয় স্তরে ও অন্য রাজ্যে সরকারি কর্মীদের দাবি ধামাচাপা দেওয়ার পথ খুঁজছে বিজেপি। সেই বিজেপি-ই এ রাজ্যে রাজনৈতিক মোক্ষলাভের আশায় সরকারি কর্মীদের ডিএ-আন্দোলন চালিয়ে যেতে বলছে। রাজনীতি এমনই। দু’মুখো।