উদ্বেগ: মণিপুরের সাম্প্রতিক হিংসার বিরুদ্ধে যন্তর মন্তরের সামনে জনজাতি সম্প্রদায়ের প্রতিবাদ, নয়াদিল্লি, ৩১ মে। পিটিআই
শব্দগুলি শুনি সর্বদা— ট্রাইব, ট্রাইবাল, আদিবাসী, জনজাতি। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোর ভূমিপুত্রদের সম্পর্কে তথাকথিত ‘মেনল্যান্ড’-এ যখন আলোচনা হয়, এই শব্দগুলো শোনা যায় বেশি করে । আবার ১৯৭২ সালের পরে ‘সেভেন সিস্টার্স’ তৈরি হওয়ার পর জাতিগত সংঘর্ষ বলে আর একটা শব্দ এই রাজ্যগুলোর অস্তিত্বের সমার্থক হয়ে দাঁড়িয়েছে। মেনল্যান্ডের সমাজে এই শব্দের মানে, বিভিন্ন জনজাতি গোষ্ঠীর আদিম লড়াই। সত্যি কি তা-ই?
যেখানে সাধারণ সময়ে উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলো থেকে হাতে-গরম খবর জাতীয়-স্তরে মিডিয়া হাউসগুলোয় পৌঁছতে পারে না, সেখানে ইম্ফলের অদূরে পাহাড়ি এলাকা চূড়াচাঁদপুরে কুকি, নাগা, যোমি এবং চিং জনজাতিদের সঙ্গে মেইতেইদের হিংসাত্মক ঘটনার ছবি উঠে এসেছে জাতীয় মিডিয়ায়। অবস্থা স্বাভাবিক করার জন্য সেনা ও আধা সামরিক বাহিনী ও পরে অতিরিক্ত ৬০০ সেন্ট্রাল রিজ়ার্ভ পুলিশ ফোর্স পাঠিয়েও লাভ হয়নি দেখে আসরে নেমেছেন অমিত শাহ। তাও মণিপুরে সঙ্কট এবং হিংসা অব্যাহত।
এ বারে সংঘর্ষ শুরু হয়, মেইতেইরা শিডিউল ট্রাইব বা তফসিলি জনজাতি হওয়ার দাবি জানালে এবং মণিপুর হাই কোর্ট সেই দাবি মেনে নেওয়ায় রাজ্য সরকারকে সবুজ সঙ্কেত দেওয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে। মেইতেইরা মণিপুরের মোট জনসংখ্যার ৫৩ শতাংশ হয়েও বসবাস করে রাজ্যের ১০ শতাংশ সমতল জমিতে। সেই জমিও শুধু তাদের করায়ত্ত নয়। মণিপুর ভূমি রাজস্ব ও ভূমি সংস্কার আইন অনুযায়ী মেইতেইরা পাহাড়ে জমি কিনতে পারে না। আবার ধর্মের দিক থেকে মেইতেইরা হিন্দু আর জনজাতি সম্প্রদায়গুলো অধিকাংশই খ্রিস্টান। কুকিদের অভিযোগ, মণিপুরের উপর জন্মগত-জাতিগত ভাবে তাদের নাগরিকত্বের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করার জন্য মেইতেইরা তাদের অবৈধ অনুপ্রবেশকারী, এমনকি জঙ্গি বলেও অভিহিত করে থাকে। তাই প্রতিবাদ হিসাবে, কুকি সংগঠনগুলো রাজধানী দিল্লির যন্তর মন্তরে মণিপুরে রাষ্ট্রপতি শাসন ও তাদের নিজস্ব রাজ্যের দাবি জানিয়েছে। না, শুধু জাতিগত বা ধর্মগত দিক থেকে এই সংঘর্ষের কারণ ব্যাখ্যা করা মুশকিল।
ইতিহাসের দিকে ফিরে তাকানো যাক। মেইতেইরা জাতিগত ভাবে বহু-ঈশ্বরবাদী কাংলেইপাক বা সোনামাহি ধর্মের অনুসারী ছিল। ষোড়শ শতকে মণিপুরে হিন্দুধর্মের প্রভাব শুরু হলেও, অষ্টাদশ শতকে দু’জন মণিপুরি রাজা গরিব নিওয়াজ় ও ভাগ্যচন্দ্রর নেতৃত্বে তারা বৈষ্ণব ধর্মের অনুসারী হয়ে ওঠে। হিন্দু ধর্মে ধর্মান্তরিত হওয়ার পর, মেইতেইরা ব্রাহ্মণ আর ক্ষত্রিয়, মূলত দুটো বর্ণে বিভাজিত হয়। অধিকাংশ মেইতেইদের নামের আগে কে এইচ লেখা থাকে, যার মানে ক্ষত্রিয়। শর্মা বা গুরুমাইউমরা (গুরুদেব) ব্রাহ্মণ। এ ছাড়া আছে লোই বা যারা হিন্দুধর্ম গ্রহণ করেনি। মণিপুরে এরা তফসিলি জাতি বলে গণ্য হয়।
ভৌগোলিক দিক থেকে মণিপুর দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সংযোগকারী অঞ্চল হওয়ায়, এই দেশগুলোর সঙ্গে মণিপুরের সাংস্কৃতিক বৈচিত্রের মিল পাওয়া যেত। ১৯৩১ সালের সেন্সাসে ব্রিটিশরা তফসিলি জনজাতিদের সংজ্ঞায়িত করতে গিয়ে গোষ্ঠীগুলোর আদিমতা, ভৌগোলিক বিচ্ছিন্নতা, সামাজিক, শিক্ষাগত ও অর্থনৈতিক পশ্চাৎপদতার মতো বিষয়গুলোকে গুরুত্ব দেয়। এই অঞ্চল সম্পর্কে ব্রিটিশ নীতি ছিল, সমতলের কোনও আইনকে জনজাতিদের জীবনযাপনের শর্ত হিসাবে আরোপ না করা। কুকিরা ছিল যোদ্ধা জাতি। এরা বারুদ বানাতে ও বন্দুক চালাতে পারত। তাই ঔপনিবেশিক সময়ে বর্মা আর মণিপুরের মধ্যে ব্রিটিশরা মণিপুরের পাহাড়ি অঞ্চলে কুকি কলোনি তৈরি করেছিল। কুকিরা মণিপুরের রাজাকে কর দিত না, সেনাবাহিনীতে কাজ করত।
স্বাধীনতার পর মণিপুরের রাজা প্রিয়ব্রত সিং-কে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সর্দার পটেল বাধ্য করেন সই করে ভারতে যোগদান করতে। এই জোর-জবরদস্তি মেইতেইরা ভাল চোখে দেখেনি। মণিপুরে তখন থেকেই এক ভারত-বিরোধী মনোভাব দেখা যায়, যেটা প্রথমে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন ও পরে হিন্দুত্ববিরোধী আন্দোলনের রূপ নেয়। এর ফলে মেইতেইরা হিন্দু ধর্ম ছেড়ে নিজেদের পুরনো ধর্মে ফিরে যেতে থাকে। বাংলা হরফে লেখা পুঁথিপত্র পুড়িয়ে, তাদের হারিয়ে যাওয়া বর্ণমালা পুনরুদ্ধার, সনাতন সানামাহি ধর্ম পালন এবং নিজেদের হিন্দু নাম অবধি পরিবর্তন করতে শুরু করে ।
মেইতেইদের আসল সমস্যা শুরু হয়, জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে তাল মিলিয়ে অঞ্চল সম্প্রসারণ না করতে পারার অক্ষমতাকে কেন্দ্র করে। পাহাড়ি জমিতে আইনি অধিকার ভোগের সুবিধার সঙ্গে নাগা, মিজ়ো, কুকি ইত্যাদি তফসিলি জনজাতিরা মণিপুরের উপত্যকা অঞ্চলেও জমি, বাড়ি কিনতে পারে। তারা কেন্দ্রীয় সরকারের চাকরি পায়, কিন্তু আয়কর দিতে হয় না। ইম্ফলে জমির দাম আকাশছোঁয়া, তারা জমি কিনতে পারে না। আগে মেইতেইরা হিন্দু এবং ‘জেনারেল ক্যাটেগরি’ হওয়ার কারণে চাকরিতে সংরক্ষণের সুবিধা পেত না। ১৯৯২ সালে মণ্ডল কমিশনের রিপোর্ট বাস্তবায়নের পর কিছু মেইতেই ওবিসি বা অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণির স্বীকৃতি পায়। কিন্তু আসল সমস্যার সমাধান হয় না। কেননা, এক, মণিপুরে অসম, মেঘালয় ও অন্যান্য রাজ্য থেকে আসা বাঙালি মুসলমান, বিহারিরা দক্ষ শ্রমিক বলে মেইতেইরা তেমন কাজ পেত না। দুই, মায়ানমারের অশান্ত পরিস্থিতির কারণে সীমান্তবর্তী অঞ্চল দিয়ে কুকি, নাগা, পাইতেই, চিংরা মণিপুরে ঢুকে পড়ত প্রায়ই। তিন, রাজ্যের ব্যবসায় প্রাধান্য পেত অ-মণিপুরিরা বিশেষত মারোয়াড়িরা। বহিরাগতদের আটকানোর জন্য মেইতেইরা মণিপুরে ‘ইনার লাইন পারমিট’ চালু করার দাবি করে। কিন্তু মণিপুর জনজাতি-অধ্যুষিত রাজ্য না বলে তৎকালীন সরকার এই দাবি মেনে নেয়নি। বিজেপি আমলেই মণিপুরে ইনার লাইন পারমিট চালু হয়। এতে শুধু ভারতের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষরাই না, কুকিদের মতো আরও অনেক জনজাতিদের মণিপুরে বাস করা অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেই দৃষ্টান্ত দেখে মেঘালয়ের মতো রাজ্যগুলোও এখন ইনার লাইন পারমিট চালু করার দাবি করছে।
কেন্দ্রীয় সরকারের বদান্যতা দেখে, মেইতেইরা এক ধাপ এগিয়ে এখন তফসিলি জনজাতি হওয়ার দাবি জানিয়েছে। তাতে তারা সরকারি চাকরিতে অগ্রাধিকার পাবে, কুকি-নাগাদের মতো সরকারি প্রতিযোগিতায় সুবিধা পাবে ও পাহাড়ে জমি কিনতে পারবে। আসল ন্যারেটিভকে পাল্টে দেওয়ার চেষ্টা চলছে, যাতে দোষটা কুকিদের উপর চাপানো যায়। সবচেয়ে বিপজ্জনক— পুরো হিংসার ঘটনাকে হিন্দু-খ্রিস্টান বিরোধ হিসাবে দেখানোর চেষ্টা চলছে। বলা হচ্ছে, কুকিরা পাহাড়ে গাঁজা উৎপাদন ও মায়ানমার থেকে অবৈধ মাদক সরবরাহ করে, এবং তাতে বিজেপি সরকার বাধা দেওয়াতেই নাকি এই হিংসার পরিবেশ তৈরি হয়েছে।
মেইতেইরা যদি তফসিলি জনজাতি হওয়ার নির্ণায়ক বিষয়গুলির উপযোগী হত, তা হলে ব্রিটিশ আমলে বা ১৯৫০ সালে ভারতে সংবিধান কার্যকর করার সময়ই তারা ওই তকমা পেত। আজ যদি বিপদ দেখে এস টি বৈশিষ্ট্যের সংজ্ঞাকে উপেক্ষা করে মেইতেইদের তফসিলি জনজাতি গোষ্ঠীভুক্ত করা হয়, তা হলে দেশের যে কোনও গোষ্ঠী বাড়তি সুযোগসুবিধা পাওয়ার জন্য একই দাবি করতে পারে। এর পরিণাম হতে পারে বিপজ্জনক। ভোটব্যাঙ্কের স্বার্থে মুসলমান তোষণের কথা শোনা যায় হিন্দুত্ববাদীদের মুখে, কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকারের এই নীতিও কি একই রকম ভোটব্যাঙ্কচালিত ও তোষণমূলক নয়?
উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সমস্যার বীজ আসলে নিহিত, জনজাতিদের জমি ও প্রাকৃতিক সম্পদের উপর অধিকার এবং সরকারি চাকরি-সহ অন্য লাভজনক পেশায় সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের একাধিপত্যের ধারণায়। শুধু কি মণিপুরই অগ্নিগর্ভ ঘটনার সাক্ষী? ত্রিপুরাতেও জনজাতি সম্প্রদায়গুলি উচ্চশিক্ষা বা সরকারি চাকরিতে একে অন্যকে আটকানোর চেষ্টা করেন। ১৯৬০-এর দশকে পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে যখন চাকমা, হাজংরা পালিয়ে এসে ত্রিপুরায় আশ্রয় নিয়েছিল, সবচেয়ে বিরোধিতা করেছিল টিইউজেএস নামে এক জনজাতি সংগঠন। অরুণাচলেও একই চিত্র: স্থানীয় জনজাতিরা অভিবাসী চাকমা, হাজংদের রাজ্য থেকে তাড়াতে চেষ্টা করছে। তাই মণিপুরের ঘটনা কেবল মণিপুরের নয়— বহু জায়গার, বহু মানুষের ভাগ্য নির্ধারণকারী।