স্বতঃস্ফূর্ত: উরুমছির ঘটনার পর চিন সরকারের কোভিড-শূন্য নীতির বিরুদ্ধে সাদা কাগজ হাতে প্রতিবাদ সাধারণ মানুষের, ২৭ নভেম্বর, বেজিং। রয়টার্স
মাও জে দং-এর বিখ্যাত উক্তি ছিল, ‘দাবানলের জন্য একটা স্ফুলিঙ্গই যথেষ্ট’। এটা যদিও এখনও পরিষ্কার নয় যে, ২৫ নভেম্বর শিনচিয়াং প্রদেশের রাজধানী উরুমছি-তে বহুতলের বিধ্বংসী আগুনে দশ জনের মৃত্যু ও ন’জনের আহত হওয়ার যে ঘটনা ঘটে, তা কোনও দাবানলের জন্ম দেবে কি না। তবে এটা নিশ্চিত ভাবে বলা যায় যে, ঘটনাটি চিনে বৃহত্তম গণ-প্রতিবাদের সূচনা করেছে, যা সে দেশে বহু বছর দেখা যায়নি। আগুন লাগার প্রাক্কাল থেকেই নিরন্তর অতিমারি নিয়ন্ত্রণের বিরুদ্ধে শাংহাই-সহ চিনের অন্যান্য বড় শহরে গণ-আন্দোলন শুরু হয়। তাতে বাদ যায়নি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসও। এবং এই প্রতিবাদই এখন চিনের নবনির্বাচিত সর্বশক্তিধর জেনারেল সেক্রেটারি শি জিনপিং এবং তাঁর শূন্য-কোভিড নীতির বিরুদ্ধে বড় পরীক্ষা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
১৯৮৯ সালে চিনের কমিউনিস্ট পার্টিতে রাজনৈতিক পরিবর্তন আনার প্রচেষ্টায় তিয়েনআনমেন স্কোয়ার আন্দোলনের সেই রক্তক্ষয়ী দমনের পর থেকে, সে দেশ বেশ কিছু বিচ্ছিন্ন প্রতিবাদের সাক্ষী থেকেছে। কিন্তু এদের অধিকাংশই ছিল বেতন বা জমির ক্ষতিপূরণ নিয়ে, অথবা দুর্নীতিগ্রস্ত আধিকারিকদের বিরুদ্ধে, যা সহজেই মেটানো যেত নিচু তলার আধিকারিকদের তাড়িয়ে বা বিভিন্ন ছাড়ের মাধ্যমে। যদিও, কেউই তখন দেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করার চেষ্টা করেননি। বিশেষ করে, কেন্দ্রীয় সরকার এবং শাসক দলের বিরুদ্ধে প্রকাশ্য অবাধ্যতা খুবই বিরল চিনে। কিন্তু গত সপ্তাহে দেশের বিভিন্ন শহরে মানুষ যে ভাবে প্রতিবাদে ফেটে পড়েন, তাতে সেখানকার পরিস্থিতি যে বেশ গুরুতর, তা বলা বাহুল্য ।
প্রসঙ্গত, তিরিশ বছরেরও বেশি সময়ে বিভিন্ন সামাজিক গোষ্ঠীর মধ্যে এমন ধারাবাহিক এবং স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন দেখেনি চিন। ‘আমরা কোভিড টেস্ট চাই না। আমরা স্বাধীনতা চাই’— এই সব স্লোগানের মাধ্যমে বিভিন্ন শহরে স্বাস্থ্য আধিকারিক এবং জনসাধারণের স্বাভাবিক গতিবিধির উপরে নিয়ন্ত্রণের বিরুদ্ধে ক্ষোভ ব্যক্ত করেন আন্দোলনকারীরা। এর প্রেক্ষিতেই গত কয়েক দিনে বিভিন্ন জায়গায় আধিকারিকদের কোভিড বিধিনিষেধ শিথিল করতে দেখা গিয়েছে। গুয়াংঝাও এবং চংকিং-এ প্রায় রাতারাতিই এই নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয়। সম্ভবত এই প্রথম চিনের জনসাধারণ তাঁদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় প্রশাসনকে তাদের পথ পরিবর্তন করে কোনও জাতীয় নীতি প্রণয়নে পিছু হটতে বাধ্য করেছে। যদিও এর পরে বিভিন্ন শহরে সুরক্ষা বাহিনী আরও বেশি করে মজুত করা হয়।
গত অক্টোবরে চিনের কমিউনিস্ট পার্টি-র পার্টি কংগ্রেস অধিবেশনে রেকর্ড তৃতীয় বারের জন্য জেনারেল সেক্রেটারি মনোনীত হওয়ার পরে শি জিনপিং-এর কাছে এখন এটাই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। যদিও অতিমারির প্রাথমিক পর্বে, যখন ভাইরাসটি আরও মারাত্মক ছিল এবং এর কোনও টিকা বাজারে আসেনি, তখন করোনার প্রাদুর্ভাব কমানোর জন্য এমন নীতি নির্ধারণের সঙ্গত কারণ ছিল। বিভিন্ন জায়গায় গণ-পরীক্ষা, শহর জুড়ে লকডাউন এবং অস্থায়ী হাসপাতালে কোয়রান্টিনের ব্যবস্থার পরিকল্পনা দারুণ কাজ দিয়েছিল। ফলে শি-র অতি বড় বিরোধীও সেই সময় তাঁর নীতিতে প্রভাবিত হয়েছিলেন। ব্যাপক সমর্থনও পেয়েছিলেন শি। বিশেষ করে আমেরিকায় ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং ব্রিটেনে বরিস জনসনের তত্ত্বাবধানে সে সব দেশে সেই সময় যে অব্যবস্থা পরিলক্ষিত হয়েছিল, তার সাপেক্ষে চিনের নীতি ছিল খুবই কার্যকর। জনস্ হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের করোনাভাইরাস রিসোর্স সেন্টার-এর এ বছরের জুনের তথ্য অনুযায়ী, আমেরিকায় যেখানে প্রতি এক লক্ষ মানুষে ৩০০ জনের মৃত্যু হয়েছে, সেখানে চিনে হয়েছে মাত্র একটি। কিন্তু অনেক বেশি ছোঁয়াচে, অথচ মৃদু ওমিক্রন ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের সময় থেকে এই পন্থা ক্রমশ অচল, এমনকি অযৌক্তিক হয়ে পড়ে। ভাইরাসকে নির্মূল করার ব্যাপারে চিনের এই একগুঁয়ে মনোভাব তাদের নিঃসঙ্গ করে তুলেছে।
বেজিং-এর এই শূন্য কোভিড নীতি এখন ধ্বংসাত্মক হিসাবে পরিগণিত হচ্ছে যা দেশের অর্থনীতির ক্ষতি করেছে, খালি করেছে স্থানীয় প্রশাসনের কোষ এবং জন্ম দিয়েছে কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে বিপুল ক্ষোভের। তা ছাড়া, এই অসন্তোষ এমন সময় হচ্ছে যখন চিনের অর্থনীতি গত চল্লিশ বছরের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ সময় থেকে নিজেকে পুনরুজ্জীবিত করার চেষ্টা করছে। প্রশাসনের শূন্য কোভিড নীতি ইতিমধ্যেই দেশের খুচরো বিপণন, বিনোদন এবং পর্যটনকে ধ্বংস করে দিয়েছে। বাণিজ্যিক বিনিয়োগকে দুর্বল করার পাশাপাশি সম্পত্তির সঙ্কট আরও খারাপ এবং বিদেশি বিনিয়োগকেও প্রভাবিত করেছে এমন নীতি। শহরাঞ্চলে যুবকদের মধ্যে বেকারত্বের হার প্রায় ২০ শতাংশ ছুঁইছুঁই, যা এই আন্দোলনে আরও ঘৃতাহুতি দিয়েছে। ফলে, এই সব প্রতিবাদ শাসক দলের যোগ্যতা এবং তাদের প্রগাঢ় অর্থনৈতিক পরিচালন ক্ষমতার উপরে প্রশ্ন তুলে দিয়েছে। দলের নীতির উপরে মানুষের ক্রমবর্ধমান অবিশ্বাস ও অসন্তুষ্টি সরকারের প্রতি জনগণের আস্থার সঙ্কটকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে।
কিন্তু এই নীতি ত্যাগ করে অতিমারিকে বাড়তে দিলেও অন্য সমস্যার সৃষ্টি হত। চিনের বিশেষজ্ঞদের মতে, যদি বেজিং-এ লকডাউন তুলে নেওয়া হত, তা হলে এত সংখ্যক মানুষকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হত যে, গোটা চিকিৎসাব্যবস্থাটাই ভেঙে পড়ত। চিনে করোনার টিকা দেওয়ার হার আনুষ্ঠানিক ভাবে বেশি হলেও, প্রবীণদের মধ্যে তা বেশ কম। অশীতিপর ব্যক্তিদের মধ্যে প্রায় চল্লিশ শতাংশই এখনও বুস্টার ডোজ় পাননি। এই পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে হলে চিনের কমিউনিস্ট পার্টির কাছে একমাত্র যে কার্যকর পথ খোলা ছিল তা হল, পশ্চিমের টিকা আমদানি করা, অথবা লাইসেন্স করে নিজের দেশেই তৈরি করা এবং মানুষকে, বিশেষ করে প্রবীণদের তা নিতে উৎসাহিত করা।
বলা বাহুল্য, কোভিড পরিস্থিতি এবং গণ-আন্দোলন— এই দ্বৈত চ্যালেঞ্জ শি-কে কঠিন পরিস্থিতির মুখে ফেলে দিয়েছে। এত মাস ধরে অন্য দেশের থেকে তিনি চিনে অতিমারি পরিস্থিতি কত ভাল সামলেছেন, তা নিয়ে বড়াই করে এসেছেন। এখন যদি তিনি বিদেশ থেকে টিকা আমদানি করেন, তা হলে শি-কে মেনে নিতে হবে যে, তাঁদের তৈরি টিকা ব্যর্থ হয়েছে। তাতে তাঁরই মুখ পুড়বে। পাশাপাশি তিনি যদি আন্দোলনকারীদের খোলা হাত দেন, তা হলে তাঁদের স্পর্ধা আরও বাড়বে। আবার, তাঁদের জোর করে আটকাতে গেলে আরও ঘনীভূত হবে বিক্ষোভ।
অধিকাংশ বিশেষজ্ঞ বলছেন যে, গণদাবি সত্ত্বেও, সাম্প্রতিক প্রতিবাদ তিয়েনআনমেন স্কোয়ারের মতো আন্দোলন নয়। ১৯৮৯ সালের দাবি ছিল রাজনৈতিক সংস্কারের, কিন্তু এই দাবি বিধিনিষেধ তুলে নেওয়ার পক্ষে, যাতে মানুষ তাঁদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় ফিরতে পারে।
এটা এখন নির্ভর করছে শি জিনপিং বর্তমান পরিস্থিতি কী ভাবে সামলাতে চাইছেন, তার উপর। তিনি কি বাস্তবধর্মিতা এবং সংযমের সঙ্গে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করবেন, না কি জেদ এবং হিংসার বশবর্তী হয়ে? আন্দোলন শুরু হওয়ার পরে তাঁর প্রথম বক্তব্যে শি ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের দূতকে জানান যে, তিন বছরের লকডাউনের কারণে ছাত্রছাত্রীরা হতাশ হয়ে পড়েছে। আশা করা যায়, চিনের সর্বশক্তিমান ব্যক্তির গলায় এমন সমঝোতামূলক কণ্ঠস্বরই শোনা যাবে আগামী দিনে এবং শান্তিপূর্ণ ভাবেই তিনি গোটা বিষয়টি পরিচালনা করবেন। তবে সে দেশে পরিস্থিতি কী দাঁড়াচ্ছে, তা আর কয়েক দিন পরেই জানা যাবে বলে মনে হয়।