জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত বিপর্যয় এবং স্থানান্তরকরণ সার্বিক ভাবে গ্রামের মেয়েদের উপর চাপ বহু গুণ বৃদ্ধি করবে। —ফাইল চিত্র।
আয়লা যে বার তছনছ করল সুন্দরবন অঞ্চল, সুশীলাদি তখন কলকাতায়। স্বামীর মৃত্যুর পর পাঁচ বাড়ি ঠিকে কাজ করে সংসার চলে তাঁর, হিঙ্গলগঞ্জের গ্রামের বাড়িতে তাই রেখে আসতে হয়েছে ছেলেমেয়েকে। মেয়ের পরের বছর মাধ্যমিক। পড়াশোনায় ভাল। সুশীলাদির ইচ্ছা, মেয়ে অন্তত কলেজটুকু পাশ করুক।
আয়লা এল, অভ্যস্ত শহুরে জীবনে তুমুল ছন্দপতন ঘটাল। কিন্তু ঝড়ের আসল দাপট টের পেলাম পরের দিন, যখন সুশীলাদি এলেন বিধ্বস্ত এক চেহারা নিয়ে। গভীর রাতে বাঁধ ভেঙে গ্রামে জল ঢুকে ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছে ঘরবাড়ি। ত্রাণশিবিরে উঠে যাওয়ার আগে একখানা শুকনো কাপড়ও সঙ্গে নিয়ে যেতে পারেননি কেউ। সব ভেসে গিয়েছিল সেই এক রাতে। কলেজ যাওয়ার স্বপ্নটুকুও। মেয়ে মাধ্যমিক পাশ করল ঠিকই, কিন্তু আর তার দায়িত্ব নিতে চাননি সর্বস্ব-হারানো সুশীলাদির দেওররা। অগত্যা বিয়ে। মেয়ে এখন মায়ের সঙ্গেই ঠিকে কাজ করে সংসার টানে।
আয়লা-পরবর্তী সুন্দরবনের এই ছবি বড় চেনা। দুর্ভোগ আরও বাড়িয়েছে আমপান, ইয়াসের মতো একের পর এক ঘূর্ণিঝড়। স্বাদু জলের ভাঁড়ার কমে জল-জমিতে সেখানে নুনের আধিক্য। চাষবাস কার্যত বন্ধ। অধিকাংশ পুরুষ পাড়ি দিয়েছেন ভিনরাজ্যে কাজের খোঁজে। ফেলে গিয়েছেন বৌদের। সংসার, সন্তান আর বয়স্কদের দায়িত্ব চাপিয়ে। অনিয়মিত টাকা পাঠানোর উপর ভরসা না করে সংসার চালাতে মেয়ে-বৌরা নদীকেই আঁকড়ে ধরেন। কোমর সমান নোনা জলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে বাগদা, মাছ, কাঁকড়া ধরার পরিণতি— জরায়ুর রোগ। চর্মরোগেরও আধিক্য বেড়েছে। ক’জন আর যান চিকিৎসকের কাছে?
উষ্ণায়নের বিশ্বে উপকূল অঞ্চল আরও বিপজ্জনক হয়ে উঠবে। সমুদ্র ক্রমশ গ্রাস করবে জনপদ, ঘন ঘন ধাক্কা দেবে আরও তীব্র গতির ঝড়। বছরের অধিকাংশ সময় কর্মহীন অবস্থায় কাটবে উপকূলের বাসিন্দাদের। আর সেখানের মেয়েরা আরও বেশি নিষ্পেষিত হবেন, বিশেষত দরিদ্র প্রান্তিক অঞ্চলের মেয়েরা। সমীক্ষায় প্রকাশ, ২০২০ সালের আমপানের পর সুন্দরবন অঞ্চলে পাঁচ লক্ষেরও বেশি মানুষ ঘর-জীবিকা-চাষের জমি হারিয়েছিলেন। এই পরিস্থিতিতে সক্রিয়তা বেড়েছে নারীপাচারকারীদের। প্রতিটি বিপর্যয়ের পর পরই শিশুশ্রমিক, নাবালিকা বিবাহের পাশাপাশিলক্ষণীয় ভাবে বৃদ্ধি পায় ক্রীতদাসত্ব এবং জবরদস্তি যৌন পেশায় নিয়োজিত করার মতো ঘটনা। ঠিক যেমনটি ঘটেছিল ইন্দোনেশিয়াতে, ২০০৪ সালের সুনামির পর।
মেয়েদের সমস্যা অবশ্য শুধুমাত্র সুন্দরবন অঞ্চলেই সীমাবদ্ধ নয়। গত বছর প্রকাশিত ক্লাইমেট অ্যাকশন নেটওয়ার্ক সাউথ এশিয়া-র এক রিপোর্টে স্পষ্ট বলা হয়েছিল, জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত বিপর্যয় এবং স্থানান্তরকরণ সার্বিক ভাবে গ্রামের মেয়েদের উপর চাপ বহু গুণ বৃদ্ধি করবে। দিনের ১২ থেকে ১৪ ঘণ্টা সময়ই তাঁদের অতিবাহিত করতে হবে চাষের কাজ এবং সংসার সামলাতে। কমবে সংসারের কাজের বাইরে তাঁদের ‘নিজস্ব’ সময়। বাস্তবেও দেখা গিয়েছে, গ্রামে কাজের সুযোগের অভাবে পরিবারের পুরুষ ভিনরাজ্যে পাড়ি দেন রাজমিস্ত্রি, জরিশিল্পে শ্রমিক প্রভৃতি পেশার খোঁজে। মেয়েদের কাঁধে দায়িত্ব চাপে পরিবারের মুখে খাবার তুলে দেওয়ার। খরা বা বন্যায় শস্য উৎপাদনে ঘাটতি থাকলে বা ভিনরাজ্য থেকে টাকা পাঠানোয় টান পড়লে মেয়েদের পাতেই খাবারের ভাগ কমে, হাত পড়ে তাঁদের যৎসামান্য গয়নায়, অথবা চড়া সুদে ধার করতে হয় মহাজনের কাছ থেকে। পরিবারের আর্থিক অনটন তীব্র হলে মেয়েদের স্কুলছুটের সংখ্যাও উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ে। ইতিমধ্যেই ঝড়-বন্যা বিধ্বস্ত এলাকায় সেই প্রবণতা প্রকট হয়েছে।
শুধু তা-ই নয়, উষ্ণায়ন বাড়তে থাকলে জলের উৎসগুলি শুকিয়ে এলে বা ফসল কম হলে পশুখাদ্যে টান পড়লে বিস্তীর্ণ পথ পাড়ি দিয়ে সেগুলি জোগাড়ের দায়িত্বও চাপে মেয়েদের উপর। শুধুমাত্র জলের জোগানে মেয়েদের কতটা সময় অতিবাহিত হয়, সেটা বোঝাতে একটি পরিসংখ্যান বলছে, দেশের দরিদ্রতম সম্প্রদায়ের মেয়েরা বছরে প্রায় আড়াই মাস অতিবাহিত করেন শুধুমাত্র জলের জোগানে। গ্রামীণ মহারাষ্ট্রে জলের তীব্র সঙ্কটের সঙ্গে জন্ম নিয়েছে ‘জল-স্ত্রী’র ধারণা। গ্রামের পুরুষরা একাধিক বিবাহ করছেন শুধুমাত্র এই উদ্দেশ্যে যাতে বৌরা সংসারে জলের জোগানটি অক্ষুণ্ণ রাখতে পারে।
রাষ্ট্রপুঞ্জ জোর দিয়ে বলেছে, মেয়েদের ভাল থাকা এবং তাঁদের অধিকারগুলিকে পিছনে ফেলে রাখা যাবে না। মেয়েদের যে ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়, সেই সংক্রান্ত পদক্ষেপ করতে হলে নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে তাঁদের ভূমিকা এবং শক্তিশালী অংশীদারিকে স্বীকৃতি দিতে হবে। উষ্ণায়নের বিপদ ঠেকাতে সিদ্ধান্ত গ্রহণের পর্যায়গুলিতে তৃণমূল স্তর থেকেই মেয়েদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে না পারলে তাঁরা নিজেদের সমস্যা যথাযথ ভাবে তুলে ধরতে পারবেন না। ভারতের মতো বিশাল দেশে জলবায়ু পরিবর্তনের ধাক্কা আগামী দিনে সর্বাধিক হবে, এমনটাই অনুমান। অন্য দিকে, লিঙ্গবৈষম্য সূচকে এ দেশের স্থান ১৩৫ নম্বরে। এই দুই অন্ধকার দিককে এক সঙ্গে বাঁধতে না পারলে জলবায়ু পরিবর্তনের নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে কোনও আলোর দিশা পাওয়া অ-সম্ভব।