—প্রতীকী ছবি।
১৯৮০-র দশকে বিবিসি-র টিভি সিরিজ় ইয়েস, প্রাইম মিনিস্টার-এর একটা এপিসোড থেকে সূত্র নিয়ে সম্প্রতি ব্রিটেনে একটা সমীক্ষা আয়োজিত হল। করল খ্যাতনামা মার্কেট রিসার্চ সংস্থা ‘ইপসস্’। সিরিজ়ের ‘দ্য গ্র্যান্ড ডিজ়াইন’ শীর্ষক পর্বটিতে দেখা গেল, ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী জিম হ্যাকার একটি প্রকল্প গ্রহণ করতে চান। তাঁর প্রাইভেট সেক্রেটারি বার্নার্ড উলে সমীক্ষা করে দেখেছেন যে, ব্রিটিশ জনতা প্রধানমন্ত্রীর প্রস্তাবিত প্রকল্পের পক্ষে। ও দিকে ক্যাবিনেট সেক্রেটারি স্যর হামফ্রে অ্যাপেলবি প্রকল্পটার বিরুদ্ধে। তিনি বার্নার্ডকে বোঝালেন, কী ভাবে শুধুমাত্র কিছু বিশেষ স্টাইলের প্রশ্ন যোগ করে এবং মূল প্রশ্নটাকে বিশেষ ভাবে উপস্থাপিত করে একই সমীক্ষা থেকে পরস্পরবিরোধী সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া সম্ভব। বদলাতে হবে প্রশ্নের বিন্যাস, তার রূপরং— তা হলেই পাওয়া যাবে ভিন্ন ফল।
চার দশক পরে স্যর হামফ্রে-বর্ণিত পরীক্ষাটাই করেছে ইপসস্। স্যর হামফ্রে যে বিষয়টি নিয়ে সমীক্ষার কথা বলেছিলেন, সেই ন্যাশনাল সার্ভিস ফিরিয়ে আনা বিষয়েই দু’সেট প্রশ্ন করেছে তারা। মূল প্রশ্নটা এক— কিন্তু এক সেট প্রশ্নপত্রে সেই মূল প্রশ্নে পৌঁছনোর আগে কিছু ইতিবাচক প্রশ্ন করা হয়েছে, মূল প্রশ্নও করা হয়েছে ইতিবাচক সুরে; অন্য সেট প্রশ্নপত্রের সুর নেতিবাচক। দু’ক্ষেত্রেই নেওয়া হয়েছে ১,০৭৯ জনের নমুনা। এবং, স্যর হামফ্রের কথা সত্য প্রমাণ করে দুটো স্যাম্পল থেকে পরস্পরবিরোধী সিদ্ধান্ত পেয়েছে ইপসস্। প্রথম ক্ষেত্রে ন্যাশনাল সার্ভিস ফিরিয়ে আনার পক্ষে ৪৫% আর বিপক্ষে ৩৮%; আর দ্বিতীয় ক্ষেত্রে পক্ষে ৩৮% এবং বিপক্ষে ৪৮%।
এই সমীক্ষা থেকে যদি বিবিধ জনমত সমীক্ষার ফলাফল বিষয়ে সংশয় জন্মালে অবাক হওয়ার কারণ নেই— বিশেষত, এই ভোটের বাজারে, যেখানে বিভিন্ন প্রাক্-নির্বাচনী সমীক্ষা ঝাঁপিয়ে পড়েছিল কোন দলের দিকে কতখানি জনসমর্থন তা মাপতে। প্রশ্নের হেরফেরে বদলে দেওয়া যায় সমীক্ষার ফলাফলই, একেবারে বিজ্ঞানসম্মত ভঙ্গিতে। পারমাণবিক অস্ত্রে মানুষ নিরাপদ বোধ করছেন কি না; ভিয়েতনাম থেকে আরও দ্রুত আমেরিকান সেনা প্রত্যাহার করা উচিত কি না— এমন প্রবল তাৎপর্যপূর্ণ বিষয়েও প্রশ্নের ধরন বদলে জনমতসমীক্ষার ফলাফল পাল্টে দেওয়া গিয়েছে, এমন উদাহরণ অতলান্তিক মহাসাগরের দু’পাড়েই রয়েছে।
প্রশ্নকে ঘুরিয়ে-পেঁচিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা হয়েছে আরও। ১৯৭৩-এ একটা পরীক্ষা করলেন অর্থনীতিবিদ রিচার্ড হ্যারিস। একটা সিনেমা দেখে বেরোনো লোকদের যখন জিজ্ঞাসা করা হল যে, কতটা ‘দীর্ঘ’ ছিল ছবিটা, তাঁদের উত্তরের গড় মান পাওয়া গেল ১৩০ মিনিট। কিন্তু ছবিটা কতখানি ‘ছোট’ ছিল, সে প্রশ্নের উত্তরে গড় মিলল ১০০ মিনিট।
প্রশ্নের মাধ্যমে সম্ভাব্য উত্তরকে নিয়ন্ত্রণ করা যায় অনেকটাই। ১৯৭৫-এ একটা সমীক্ষা করলেন আমেরিকান মনস্তত্ত্ববিদ এলিজ়াবেথ লোফটাস। যাঁদের প্রায়শই মাথা ধরে, তাঁদের জিজ্ঞাসা করা হল, উপশমের জন্য কত রকমের পণ্য ব্যবহার করেছেন তাঁরা— একটি, পাঁচটি, দশটি না কি তার চেয়েও বেশি? গড় উত্তর এল ৫.২। কিন্তু যখন বিকল্পগুলি পাল্টে করা হল ১, ২, ৩ বা তার চেয়ে বেশি, তখন গড় উত্তর মিলল ৩.৩।
সমীক্ষায় সাফল্য পাওয়ার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধাপগুলির একটি হল যথাযথ প্রশ্নাবলির খসড়া তৈরি। এ এক বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়া— মনোবিজ্ঞান এখানে নিয়ন্ত্রক ভূমিকায়। মানুষের স্বভাবজনিত পক্ষপাত ও ত্রুটিকে এড়িয়ে প্রাসঙ্গিক ও নির্ভরযোগ্য ফল পেতে হলে মানুষের জটিল চিন্তাপদ্ধতি এবং উত্তর দেওয়ার প্রকরণ বোঝা আবশ্যক। যেমন, লাভ আর লোকসানের প্রতি মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি যে-হেতু অভিন্ন নয়, প্রশ্নের উত্তরেও তা প্রতিফলিত হবে। ১৯৮১ সালের এক গবেষণাপত্রে অ্যামোস টভারস্কি ও ড্যানিয়েল কানেম্যান কাল্পনিক এক এশীয় রোগের প্রাদুর্ভাবের মডেল তৈরি করেন, যেখানে জীবন বিপন্ন ৬০০ জনের। অসুখটির দু’টি প্রতিরোধ প্রোগ্রামের কথা বলা হল। প্রোগ্রাম ‘ক’-তে নিশ্চিত ভাবে জীবন রক্ষা পাবে ২০০ জনের; আর ‘খ’-প্রোগ্রামে ৬০০ জনেরই বাঁচার সম্ভাবনা এক-তৃতীয়াংশ, এবং কারও না-বাঁচার সম্ভাবনা দুই-তৃতীয়াংশ। দেখা গেল, উত্তরদাতাদের ৭২% ঝুঁকি নিতে চাইলেন না, তাঁরা বেছে নিলেন ‘ক’-কে। অন্য একটি সমীক্ষা করা হল প্রোগ্রাম ‘গ’ এবং ‘ঘ’-এর মধ্যে বাছবার জন্য। ‘গ’-তে ৪০০ জন মারা যাবেন নিশ্চিত ভাবে। আর ‘ঘ’-তে ৬০০ জনেরই মৃত্যুর সম্ভাবনা দুই-তৃতীয়াংশ; কারও মারা না যাওয়ার সম্ভাবনা এক-তৃতীয়াংশ। ‘গ’ এবং ‘ঘ’-এর পরিস্থিতি যে সংখ্যাগত ভাবে অবিকল ‘ক’ এবং ‘খ’-এর মতো, একটু ভাবলেই তা বোঝা যায়। তবুও, উত্তরদাতাদের ৭৮% এ বার ঝুঁকি নিলেন, তাঁরা বেছে নিলেন ‘ঘ’-কে। কোন প্রশ্ন করলে কোন উত্তর পাওয়া যায়, স্যর হামফ্রে সেটা বিলক্ষণ জানতেন!
তাঁর ২০১১-র বই থিঙ্কিং, ফাস্ট অ্যান্ড স্লো-তে মানুষের এ ধরনের মানসিকতার কিছু কারণ নির্দেশ করেছেন কানেম্যান। তিনি বলছেন, মানুষের চিন্তাপ্রক্রিয়া দু’টি স্বতন্ত্র সিস্টেমের সংমিশ্রণের ফল। সিস্টেম এক দ্রুত, তাৎক্ষণিক; তা কাজ করে সচেতন চিন্তাভাবনা ছাড়াই; আর সিস্টেম দুই কাজ করে ধীরে, যুক্তির বিশ্লেষণের মাধ্যমে।
কিন্তু এ সব তো মানুষের উত্তর দেওয়ার প্রকরণের ব্যাখ্যা। সমস্যা হল, আমরা যখন কোনও নামজাদা সমীক্ষক সংস্থার করা কোনও স্টাডির ফল দেখি, তখন কি ভাবি যে, সমীক্ষার প্রশ্নগুলি ঠিকঠাক পরিস্রুত ছিল কি না, উত্তরদাতাদের জন্য নির্ধারিত বিকল্পগুলির মধ্যে কোনও ‘মধ্যম বিভাগ’ অন্তর্ভুক্ত ছিল কি না, প্রশ্নগুলি লাভ না ক্ষতির পরিপ্রেক্ষিতে তৈরি করা হয়েছিল, প্রশ্নগুলি ইতিবাচক ছিল না নেতিবাচক, মূল প্রশ্নটি কী ভাবে উত্থাপিত হয়েছে, মূল প্রশ্নের আগে কোনও ‘লিডিং কোয়েশ্চন’ করা হয়েছে কি না, অথবা প্রশ্নের ভাষা বা বিকল্পের মধ্য দিয়ে ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃত ভাবে উত্তরদাতাকে কোনও নির্দিষ্ট দিকে ঠেলে দেওয়া হয়েছে কি না? অনুমান করছি, বেশির ভাগ মানুষই এতশত ভাবেন না। সমীক্ষার ফলাফল বিষয়ে, অতএব, সাবধান।