ফ্রান্সে এই ইতিহাসের পিছনে আর একটা ইতিহাস আছে। ফাইল চিত্র।
এমন একটা দেশে বসে ফ্রান্সের অবসর ভাতার সংস্কার নিয়ে লিখতে হচ্ছে, যেখানে চাকরি যেন লটারিতে জেতা টিকিট, যে পেল সে বর্তে গেল আর সাধারণ মানুষের অবসরান্তের বার্ধক্যে ওত পেতে থাকে বেকারত্ব। সেই গল্প হলেও সত্যি-র পরিবারের বড়দাদার দশা। যত বয়স বাড়ছে, সওদাগরি অফিসে মনিবের চোখে কর্মী ততই যেন অপাঙ্ক্তেয় হয়ে পড়ছেন, তাকে কোনও ক্রমে ঘাড় থেকে ঝেড়ে নামানোর ফিকির খুঁজছেন মালিক। আমার নিজের ঠাকুরদাকে অশক্ত শরীরে এমন একটি অফিসে যেতে দেখেছি প্রায় আমৃত্যু। বাড়িতে অন্নের সংস্থান ছিল ঠিকই, কিন্তু তাতে চাকরিহীনতার অনিরাপত্তা দূর হয় কি?
শ্রমের সঙ্গে অবধারিত যোগ কঠোরতার, ক্ষয়ের। এই ক্ষয় শুধু শারীরিক নয়। এই ক্ষয় মনেরও, সামাজিক সত্তারও। পঞ্চাশের পর কর্মজীবনের উপান্তে পৌঁছলেই কর্মীর মনে জমতে শুরু করে আশঙ্কার কালো মেঘ, নিজেকে ঘিরে উপেক্ষা-বোধ, শুরু হয় অবসরের তীরে পা রাখার অপেক্ষা। ওটি আমার অধিকারের শক্ত মাটি, অফিসের মনিব যা ছিনিয়ে নিতে পারবে না।
এ দেশের পেনশন-ব্যবস্থা দিয়ে ফ্রান্সের পরিস্থিতিকে বোঝা কঠিন। সেখানে অবসর ভাতা সর্বজনীন অধিকার। আর এই অধিকার দেবতার বরে পাওয়া নয়। ধাপে ধাপে সংগ্রামের মাধ্যমে অর্জিত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯৪৫-এ প্রধানত বামপন্থীদের চাপে অবসরের বয়স নির্ধারিত হয় পঁয়ষট্টি বছর। ১৯৮১-তে ফ্রঁসোয়া মিতেরঁ-র নেতৃত্বে সমাজতান্ত্রিকরা ক্ষমতায় আসেন। ১৯৮২-তে অবসরের বয়স কমিয়ে আনা হয় ষাট বছরে। এই অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াই সহজ ছিল না। দক্ষিণপন্থীরা সমস্ত নখ-দাঁত বার করে চিরকাল তাকে প্রতিরোধের চেষ্টা করেছেন।
তবে ফ্রান্সে এই ইতিহাসের পিছনেও আর একটা ইতিহাস আছে। সরাসরি রাষ্ট্রীয় সৌজন্যে বার্ধক্য-সেবার প্রথম উপভোক্তা নৌসেনারা। সম্রাট চতুর্দশ লুইয়ের সময় যুদ্ধে পঙ্গু সৈনিকদের সেবা ও আশ্রয়স্থল হিসেবে প্যারিসে নির্মিত হয় ‘ওতেল দেজ্যাঁভালিদ’। আহত সৈনিকদের পঙ্গুত্বের ধারণার ভিত্তিতেই বার্ধক্যের প্রতিবন্ধকতার ধারণাটি তৈরি হয়। পেনশনের দ্বিতীয় অধিকারী প্যারিসের অপেরা, ও থিয়েটার-শিল্পীরা। ফরাসি বিপ্লবের পর প্রথম আমলাদের জন্য পেনশন ধার্য হয়। কিন্তু কোষাগারে টান পড়ায় অচিরেই এই সুবিধা বাতিল হয়ে যায়। সামরিক বাহিনী কিন্তু বঞ্চিত হয় না। প্রতিবন্ধকতার কারণে বেকার দরিদ্র অক্ষম ব্যক্তিদের জন্যে চালু হয় সরকারি অনুদান। রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপে শ্রমিকশ্রেণির ভিতর প্রথম পেনশনের সুবিধা ভোগ করেন খনি ও রেলশ্রমিক। যে-হেতু পরিবহণ ও শক্তি এ দু’টি অত্যাবশ্যক পরিষেবা ও উৎপাদন-ক্ষেত্র। তবে রাষ্ট্রীয় দাক্ষিণ্যে পাওয়া এ সব পেনশন ছিল ব্যক্তি-নির্ভর। অর্থাৎ, পেনশন ফান্ডে কর্মীর আয়ের জমা পড়া অংশের সমপরিমাণ অর্থ দিত রাষ্ট্রীয় তহবিল।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অভিঘাতে সমাজে সহায়সম্বলহীন মানুষ, নিহত, পঙ্গু, রোগগ্রস্তের সংখ্যা সহসা অতিমাত্রায় বৃদ্ধি পায়। ব্যক্তি-স্বাতন্ত্র্যর থেকে সামাজিক সংহতির প্রশ্নটি এই প্রথম বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। ব্যক্তিনির্বিশেষে প্রতিটি রোজগেরে নাগরিক ভাগ করে নেবেন জাতীয় পেনশন তহবিলের দায়িত্ব, তাঁর রোজগারের একটি অংশ এবং রাষ্ট্রীয় অনুদান মিলিয়ে তৈরি হবে সেই সম্মিলিত তহবিল। সেই তহবিলের অর্থে প্রতিপালিত হবে অসমর্থ মানুষের জীবন। অর্থাৎ, কর্মীর জমানো অর্থ ও মালিকের সমপরিমাণ অর্থের যোগফলে অবসরপ্রাপ্তের নিজস্ব ব্যক্তিগত তহবিল তো রইলই, এর সঙ্গে যুক্ত হয় এই সম্মিলিত সামাজিক তহবিল থেকে সমপরিমাণ তৃতীয় অংশ। এর পারিভাষিক নাম সামাজিক বিমা। ফ্রান্সের সমস্ত নাগরিক এই বিমার আওতাভুক্ত। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর থেকে গত শতাব্দীর সত্তরের দশক অবধি ফ্রান্সে অর্থনৈতিক স্বর্ণযুগ। সামাজিক তহবিল ফুলে-ফেঁপে উঠল। সেই তুলনায় সেখানে পেনশনভোগীর সংখ্যা ছিল নগণ্য।
ক্রমশ ছবিটা বদলাতে শুরু করল। প্রথম ধাক্কাটা এল জনসংখ্যা থেকে। এক দিকে জন্মহার নিম্নগামী, অপর দিকে গড় পরমায়ুর ঊর্ধ্বগতি। ১৯৭৫-এ গড়ে প্রায় চার জন কর্মী নিজেদের মধ্যে বণ্টন করে নিতেন এক জন পেনশনভোগীর আর্থিক বোঝা। ২০২২-এ এক জন পেনশনভোগীর আর্থিক বোঝার চাপ এসে পড়ছে গড়ে দেড় জন রোজগেরের উপর। দ্বিতীয় ধাক্কার উৎস নতুন ইউরোপ। ১৯৯৩-তে মাস্ট্রিচ চুক্তির মাধ্যমে যে নতুন ব্যবস্থার সূচনা হল তাতে এই সামাজিক সুরক্ষা বিমার ধারণাটাই প্রশ্নের মুখে এসে পড়ল। চালু হল প্রতিযোগিতামূলক মুক্ত-বাজার অর্থনীতি। গুরুত্বপূর্ণ শিল্পোদ্যোগ এই ধাক্কায় ফ্রান্সের কারখানায় তালা ঝুলিয়ে অন্যত্র পাড়ি দিল— কেননা শ্রম অতি মহার্ঘ ফ্রান্সে।
এই মোতাবেক ইউরোপীয় কমিশন ফ্রান্সের মতো দেশের উপর ক্রমাগত চাপ জারি রেখেছে পেনশন-ব্যবস্থা ঢেলে সাজানোর জন্য। অন্যথায়, শেয়ার বাজারে ফরাসি কোম্পানিগুলির পতন নাকি অনিবার্য। সোজা কথা, বিসমার্ক-প্রবর্তিত বণ্টন-মূলক পেনশন-ব্যবস্থা আজকের পৃথিবীতে অচল। শোনা যাচ্ছে, পেনশনকে ফের ব্যক্তি-নির্ভর করে সরাসরি শেয়ার বাজারের সঙ্গে যুক্ত করার কথা। যে ব্যবস্থা বাজপেয়ী-জমানার থেকে ইতিমধ্যে চালু এ দেশের কেন্দ্রীয় সরকারি পেনশনভোগীদের ক্ষেত্রে। এবং অতি সম্প্রতি কিছু রাজ্যের চাপে কেন্দ্র নাকি আবার খতিয়ে দেখছে এই জাতীয় পেনশন প্রকল্পকে (আ বা প; ২৫/৩/২৩)।
সন্দেহ নেই— সামাজিক সুরক্ষা তহবিল তুলে দিলে, প্রবীণ নাগরিকের দুর্দিন অবশ্যম্ভাবী। বেকারত্ব, অসুস্থতা প্রভৃতি নানা কারণে অধিকাংশের কর্মজীবনে প্রায়শ ছেদ পড়ে, ফলত অবসরান্তে পকেটে জমা হয় গোটা নয়, পেনশনের সিকি বা আধুলি। তবে সংবিধান অনুযায়ী যে-হেতু ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট উপর্যুপরি তিন বার নির্বাচিত হতে পারেন না, ইমানুয়েল মাকরঁর কাছে এ মুহূর্তে কোনও নির্বাচনী বাধ্যবাধকতা নেই। পেনশন-সংস্কারের একটা এসপার নয়তো ওসপার দেখেই ছাড়বেন তিনি, জনগণও তা বিলক্ষণ জানেন। আশঙ্কা একটাই, এই গণ-বিক্ষোভের সুযোগে ফ্রান্সের অতি-দক্ষিণপন্থীরা আবার ফণা তুলে দাঁড়াচ্ছেন না তো?