নেতিবাচক আবেগী রাজনীতির মোকাবিলায় চাই বিকল্প আবেগ
Ram Mandir

এলাম ‘নতুন দেশে’

নেহরুর আমলের উদার-গণতান্ত্রিক প্রথা ও প্রতিষ্ঠানের ‘সঙ্কট’-এর সূত্রপাত হয়েছিল, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী রজনী কোঠারির ভাষ্যে, নেহরুর মৃত্যুর কিছু দিনের মধ্যেই।

Advertisement

শিবাজীপ্রতিম বসু

শেষ আপডেট: ২১ নভেম্বর ২০২৩ ০৮:৩৭
Share:

নবনির্মাণ: রামমন্দির তৈরির শেষ পর্বের কর্মব্যস্ততা, অযোধ্যা, ৬ নভেম্বর। পিটিআই।

আগামী ২২ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শ্রীনরেন্দ্র মোদী, অযোধ্যায় ‘রামলালা বিরাজমান’-এর মূর্তি প্রতিষ্ঠার দিন, অনেকখানি পথ হেঁটে নির্মীয়মাণ রামমন্দিরের গর্ভগৃহে পৌঁছবেন। ‘নির্মীয়মাণ’, কেননা, নির্মাণ কমিটির সভাপতি নৃপেন্দ্র মিশ্র জানিয়েছেন, এ বছর ডিসেম্বরের শেষে গর্ভগৃহ-সহ মন্দিরের নীচের অংশ তৈরি হয়ে গেলেও উপরের দু’টি তলা শেষ হতে ২০২৪-এর শেষ। তবে তো ২০২৫-এর গোড়াতেই উদ্বোধন হতে পারত! স্থাপত্য-বিজ্ঞানের নিয়মমতো হয়তো সেটাই ঠিক হত, কিন্তু বাস্তব রাজনীতির হিসাব অনুযায়ী নয়, কেননা, ২০২৪-এর এপ্রিল/মে মাসে লোকসভা ভোট: তার আগেই যে ‘মন্দির উদ্বোধন’-এর পুণ্য কাজটি সম্পন্ন করতে হবে!

Advertisement

১৯৯০ সালে লালকৃষ্ণ আডবাণীর ‘রথযাত্রা’ রাম জন্মভূমি আন্দোলনে যে আবেগ সঞ্চার করেছিল, তা ক্রমশ উন্মাদনা হয়ে, দু’বছর পরে (৬ ডিসেম্বর, ১৯৯২), করসেবকদের চালিত করেছিল বাবরি মসজিদের কাঠামো ধুলোয় মিশিয়ে দিতে। তারও সাতাশ বছর পর (৯ নভেম্বর ২০১৯), সুপ্রিম কোর্টের পাঁচ বিচারকের ডিভিশন বেঞ্চ যখন— ১৯৪৯-এ বাবরি মসজিদ ‘অপবিত্র’ করা ও ১৯৯২-এ তা ধ্বংসের কাজকে ‘আইন ভাঙা’ বলে চিহ্নিত করেও, এই কাঠামোর নীচে অ-ইসলামি সৌধের অস্তিত্বের প্রত্নতাত্ত্বিক সাক্ষ্যের উপর ভিত্তি করে কেন্দ্রীয় সরকারকে, রামমন্দির নির্মাণের লক্ষ্যে একটি অছি বোর্ড গড়ার নির্দেশ দিলেন, তখনই মন্দির আন্দোলনের বৃত্তটি প্রায় সম্পূর্ণ হয়ে গিয়েছিল। ২২ জানুয়ারি বাকি ব্যাসাংশটি টানা হবে এবং তখন থেকে আসমুদ্রহিমাচল এই জম্বুদ্বীপের গরিষ্ঠ অধিবাসীরা, বেয়াড়া যুক্তি-তক্কো ভুলে, জাতপাত-শ্রেণি পরিচয়ের ঊর্ধ্বে উঠে, পরবর্তী কয়েক মাস ‘জয় শ্রীরাম’ ধ্বনিতে মুখরিত হয়ে আত্মগর্বী ‘নতুন ভারত’-এর সূচিত হওয়ার আবেগে ভেসে যাবে। সেই ঢেউয়ের মাথায় সওয়ার হয়ে শ্রীমোদী ও তাঁর দল শত্তুরদের মুখে ছাই দিয়ে নবনির্মিত সংসদ ভবনে গিয়ে পৌঁছবেন। যত রাজ্যের ‘ছদ্ম সেকুলার’, ‘শহুরে নকশাল’, আর পরস্পরবিরোধী, পাঁচমিশালি ‘ইন্ডিয়া’ জোটের লোকেরা আঙুল চুষতে চুষতে সেই নয়নাভিরাম দৃশ্য দেখবে আর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলবে, ‘হায় রাম’!

ঠিক এমনটাই হবে, তার গ্যারান্টি দেওয়া যায় না। কিন্তু দেশের শাসক দল ও তার মতাদর্শগত সহযোগীরা যে এমনটাই চাইছেন, তা তাঁরা মন্দির উদ্বোধনের তারিখ ঘোষণার পর থেকে উল্লসিত কথাবার্তা ও আকার-ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দিয়েছেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার প্রথম চার দশকে যা অকল্পনীয় ছিল, এমনকি বাবরি কাঠামো ধ্বংস হওয়ার সময়েও, মন্দির আন্দোলনের প্রধান স্থপতি আডবাণীর কণ্ঠে যে ‘বিষাদের সুর’ বেজেছিল, তা ইতিমধ্যেই দূর অতীতে পর্যবসিত। চোখের সামনে ওই ধ্বংসলীলা দেখার এক পক্ষকালের মধ্যে সংবাদপত্রের এক নিবন্ধে ওই দিনটিকে তাঁর জীবনের ‘সবচেয়ে দুঃখময় দিন’ বলে চিহ্নিত করেছিলেন। প্রায় দু’দশক পরেও (২০১১) তাঁর ব্লগে ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা লিখেছিলেন, সে দিনের ঘটনা তাঁদের দলের বিশ্বাসযোগ্যতায় ‘বিশ্রী গহ্বর’ তৈরি করেছিল। মাত্র এক যুগেই যেন ‘পেরিয়ে এলেম অন্তবিহীন পথ’! আজ কেবল উল্লসিত বিজেপি নেতা-কর্মী নয়, প্রবীণ কংগ্রেস নেতা তথা মধ্যপ্রদেশের বিধানসভা ভোটে মুখ্যমন্ত্রীর পদ-প্রত্যাশী, কমল নাথ সম্প্রতি দাবি করছেন, বিজেপি নয়, ১৯৫০ সালের মামলার বিবাদে বন্ধ হয়ে যাওয়া বাবরি মসজিদের তালা খুলে রামলালার পুজোর ব্যবস্থা তো করেছিলেন স্বয়ং রাজীব গান্ধীই! আরও বলেছেন, রামমন্দির ধর্মীয় ‘আচার-বিচার’-এর ব্যাপার, নির্বাচনী প্রচারের নয়। সুপ্রিম কোর্টের হস্তক্ষেপে রামমন্দির নির্মিত হয়েছে, যে-হেতু এখন বিজেপি সরকারে, তাই তারা এটা করছে। কংগ্রেস সরকারে থাকলে তারাও একই কাজ করত!

Advertisement

বিশ্ব হিন্দু পরিষদ-সহ সঙ্ঘ পরিবারের সব সংগঠনই তো (বিজেপিও) এ কথাই বলে এসেছে, রঘুকুলপতি রামচন্দ্র কোনও রাজনৈতিক দলের বিষয় নন, সমগ্র ভারতীয়দের ‘আদর্শ পুরুষ’, তাঁদের বিশ্বাস ও আবেগের ভরকেন্দ্র— উদার-গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা, আইনসভা বা বিচারবিভাগ, কিংবা যুক্তিবাদী জ্ঞানচর্চা, বিশেষত, আধুনিক ইতিহাসের আওতার ‘বাইরে’র বিষয়। শুধু কমল নাথ কেন, রাহুল গান্ধী থেকে সমগ্র কংগ্রেস— বাম ও মুসলিমকেন্দ্রিক দলগুলি বাদে, কোনও দলই রামমন্দির নির্মাণের বিরোধিতা তো করেইনি, জমির মালিকানা বা বিকল্প মসজিদ নির্মাণ বিষয়ে কোনও বিতর্কেও যোগ দেয়নি। এই ভাবে সংখ্যাগুরু বিশ্বাস ও আবেগের উপর দাঁড়িয়ে থাকা নবনির্মিত মন্দিরটি কেবল আইনি বা সরকারি নয়, রাজনৈতিক ও সামাজিক বৈধতা লাভ করল। ফলে, লোকসভা নির্বাচনে যদি বিজেপির পক্ষে কোনও ‘অঘটন’ও ঘটে, তবু হিন্দুত্ববাদীদের চিন্তা নেই— রামমন্দিরের ভাবাবেগ, উত্তর-উদারবাদী ভারতে এমন এক সামাজিক সম্মতির জন্ম দিয়েছে, যা অস্বীকার করার শক্তি অধিকাংশ বিরোধী দলের নেই। এই অবস্থানের থেকে মাত্র কয়েক হাত দূরে অপেক্ষমাণ ‘হিন্দু রাষ্ট্র’-এর ভাবনা। শুধু সময়ের অপেক্ষা।

নেহরুর আমলের উদার-গণতান্ত্রিক প্রথা ও প্রতিষ্ঠানের ‘সঙ্কট’-এর সূত্রপাত হয়েছিল, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী রজনী কোঠারির ভাষ্যে, নেহরুর মৃত্যুর কিছু দিনের মধ্যেই। সঙ্কট অত্যন্ত প্রকট হয়েছিল ইন্দিরা গান্ধীর শাসনে ‘জরুরি অবস্থা’ ঘোষণার সময়। গণতন্ত্রের ‘ঘাটতি’ ইন্দিরা ‘পোষাতে’ চেয়েছিলেন কিছুটা সমাজবাদী, কিছুটা ‘জনবাদী’ নীতি মারফত। স্বাধীনতার আদর্শের বদলে এনেছিলেন ‘শৃঙ্খলা’র নীতি, ‘পরিশ্রম’-এর। তখন লেখা হত ‘কঠোর পরিশ্রমের বিকল্প নেই’— যাকে উল্টে দিয়ে কবি শঙ্খ ঘোষ লিখেছিলেন, ‘কঠোর বিকল্পের পরিশ্রম নেই’! জরুরি অবস্থা শেষে, ১৯৭৭-এ ইন্দিরার পরাজয় ও জনতা সরকারের গঠনের মধ্যে ছিল রাষ্ট্রীয় সমাজতন্ত্রের কঠোরতা মুক্ত হয়ে উদার (বুর্জোয়া) গণতন্ত্রে ফেরার আকুতি— যার আবেদনও অনেক দিন বজায় ছিল। বিজেপি আজ যে ‘নতুন ভারত’ গড়তে চাইছে, তার ভিত্তি পশ্চিম অনুপ্রাণিত যুক্তিবাদ বা স্বাধীনতা নয়, সংখ্যাগরিষ্ঠ ও ‘শক্তিমান’ জাতীয়তাবাদের প্রতি গণ-আবেগ, সর্বোচ্চ নেতৃত্বের প্রতি চূড়ান্ত বিশ্বাস, প্রশ্নহীন আনুগত্য। বিজেপির প্রতিস্পর্ধী দলগুলির বিশেষ কিছু করার নেই, তারা যুক্তিবাদী বা আর্থসামাজিক দিক থেকে প্রশ্ন তুলতে পারে, কিন্তু ‘গণ-আবেগ’এর মোকাবিলা কী ভাবে করতে হয়, জানে না। অথচ, এই গণ-উন্মাদনার, আবেগ-অনুভূতির পাল্টা আবেগের পৃষ্ঠভূমি রচনা করতে না পারলে, পুরনো প্রকৌশলে তা পুরোপুরি সম্ভব নয়।

এই পাল্টা আবেগ-নির্মাণের বিষয়টি আলোচনা করেছেন বিশিষ্ট রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অজয় গুড়াবর্তী, তাঁর সাম্প্রতিক গ্রন্থে (পলিটিক্স, এথিক্স অ্যান্ড ইমোশনস ইন ‘নিউ ইন্ডিয়া’)। তাঁর মতে, রাজনৈতিক ও প্রযুক্তিগত যুগান্তকারী পরিবর্তনগুলির জন্য যদি বিংশ শতাব্দীকে ‘বিপ্লবের যুগ’ বলা যায়, তবে একুশ শতক অবশ্যই ‘আবেগের যুগ’— যে আবেগ-উন্মাদনায় ভর করে কেবল ভারতে নয়, সমগ্র বিশ্বে দক্ষিণপন্থী সংখ্যালঘু-বিরোধী উগ্র জাতীয়তাবাদের উত্থান ঘটছে। এই নতুন যুগে বাস্তব পরিস্থিতি উপস্থাপিত হচ্ছে মনস্তাত্ত্বিক ও আবেগগত বিষয় হিসাবে, অভিনয় সম্পাদনের মঞ্চ হিসাবে। স্বাধীন সত্তার অধিকারী হিসাবে নয়, নাগরিকদের ভাবা হচ্ছে নির্দিষ্ট ভূমিকা পালনকারী রূপে। ফলে, তাঁরা করোনা-কালে ‘থালা বাজানো’ বা ‘মোমবাতি জ্বালানো’র মতো আপাত-অর্থহীন কাজেও সার্থকতা খুঁজে পাচ্ছেন। শাসকের সঙ্গে অনেকে আবেগগত একাত্ম বোধ করছেন, কারণ, মিশেল ফুকো যাকে ‘প্রশাসনিকতা’ (গভর্নমেন্টালিটি) বলছেন, তাতে ভর করে, তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর গণমাধ্যম মারফত প্রকৃত ও ভ্রান্তিমূলক (নির্মিত) বাস্তবের তথ্য এমন গুলিয়ে দেওয়া হচ্ছে, বহু মানুষ ধর্মীয় সংখ্যালঘু ও বিদেশি ‘শত্রু’দের বিষয়ে এক দীর্ঘস্থায়ী ভয়, সন্দেহ, ঘৃণা ও অনিশ্চিতির বোধ থেকে প্রবল শাসকের দাপটের কাছে নিজেকে সমর্পণ করে নিশ্চিন্ত বোধ করছে। তখন, বেকারত্বের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে ‘জাতির অস্তিত্ব রক্ষা’র বিষয়টি।

এই প্রশ্নহীন আবেগী রাজনীতির বিকল্পে কি সমানুভূতি, ভালবাসা ও শুশ্রূষার অন্যতর আবেগের সঞ্চার করা যায়? সস্তা, চটজলদি নির্বাচনী সাফল্যের মোহের বদলে সমাজমনের গভীরে প্রোথিত এই সব উপাদানের সযত্ন চর্চা চালিয়ে একটা বিকল্প রাজনীতি গড়ে না তুললে, বর্তমান সঙ্কট পেরোনো অসম্ভব। রাজনৈতিক দলগুলি কি তার জন্য প্রস্তুত?

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement