—প্রতীকী ছবি।
ইলেক্টোরাল বন্ড বা নির্বাচনী ঋণপত্র নিয়ে সুপ্রিম কোর্টে গত ছ’বছরেরও বেশি সময় ধরে একটা মামলা চলছে। রাজনৈতিক তহবিল সংগ্রহের পদ্ধতি নিয়ে মামলা। লোকসভা নির্বাচন যত এগিয়ে আসছে, তহবিল সংগ্রহের তাগিদ তত বাড়ছে। বাড়ছে মামলাটার গুরুত্বও। ২০১৭-১৮’র বাজেট পেশ করতে গিয়ে তৎকালীন অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি বলেছিলেন, স্বাধীনতার সত্তর বছর কেটে গিয়েছে, তবু আমাদের দেশে এমন একটা পদ্ধতি বা আইন তৈরি হল না যার মধ্যবর্তিতায় রাজনৈতিক দলগুলি স্বচ্ছ ভাবে অর্থসংগ্রহ করতে পারে। এই অপূর্ণতা মেটানোর জন্য ২০১৮ সালে নির্বাচনী ঋণপত্র চালু করা হয়।
ঋণপত্রটি চালু হওয়ার আগে বিভিন্ন আইনে কিছু প্রয়োজনীয় পরিবর্তন করতে হয়েছিল। পরিবর্তনগুলো করার সঙ্গে সঙ্গে সেগুলোকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে সুপ্রিম কোর্টে মামলা করে ‘অ্যাসোসিয়েশন ফর ডেমক্র্যাটিক রিফর্মস’ ও ‘কমন কজ়’ নামক দু’টি অসরকারি সংস্থা, এবং সিপিআইএম। মামলা এখন পাঁচ জন বিচারপতির সাংবিধানিক বেঞ্চে বিচারাধীন আছে। তাঁদের রায়ের উপরে নির্ভর করছে নির্বাচনী ঋণপত্রের ভবিষ্যৎ।
নির্বাচনী ঋণপত্রের বর্তমান কাঠামোটা এই রকম— প্রতি বছর জানুয়ারি, এপ্রিল, জুলাই এবং অক্টোবর মাসের দশ দিন স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া নির্বাচনী ঋণপত্র নাম দিয়ে একটি বাণিজ্যিক তমসুক ভারতীয় নাগরিক এবং ভারতে নথিভুক্ত বাণিজ্যিক সংস্থার কাছে বিক্রি করে। ক্রয়ের ঊর্ধ্বসীমা নেই। কেনার পনেরো দিনের মধ্যে ক্রেতা তাঁর পছন্দের কোনও রাজনৈতিক দলকে ঋণপত্রটি হস্তান্তর করলে, গ্রহীতা সেই ঋণপত্র স্টেট ব্যাঙ্কে জমা দিয়ে ব্যাঙ্কের কাছ থেকে ক্রয়মূল্যের সমান অর্থ পেয়ে যায়। এই লেনদেনে স্টেট ব্যাঙ্ক, আয়কর বিভাগ এবং গ্রহীতা রাজনৈতিক দলটি ছাড়া আর কেউ ক্রেতার পরিচয় জানতে পারে না।
আমাদের দেশে নির্বাচনে লড়ার জন্য বিপুল অর্থের প্রয়োজন। নির্বাচনী ঋণপত্রের প্রবক্তারা বলছেন, এই বাণিজ্যিক তমসুক বাজারে আসার আগে রাজনৈতিক দলগুলি ভোটের খরচ চালাত মূলত নগদে পাওয়া অনুদান থেকে, যার সিংহভাগই হত অবৈধ। নতুন ব্যবস্থায় দলগুলি যেমন স্বচ্ছ ভাবে নির্বাচনে লড়ার অর্থ সংগ্রহ করতে পারছে, তেমনই ঋণপত্রলব্ধ টাকা তারা স্বচ্ছ ভাবে খরচও করতে পারছে। কারণ, আয়কর বিভাগের কাছে প্রতিটি ঋণপত্র কেনা-বেচার হিসাব থাকছে। দ্বিতীয়ত, যে-হেতু গ্রহীতা এবং আর্থিক কর্তৃপক্ষ ছাড়া আর কেউ দাতার পরিচয় জানতে পারছে না, তাই যিনি দিচ্ছেন তিনি নির্ভয়ে পছন্দের দলকে অর্থসাহায্য করতে পারছেন। যে দলকে তিনি টাকা দিচ্ছেন না, তাদের সম্ভাব্য রাজনৈতিক রোষের তোয়াক্কা তাঁকে করতে হচ্ছে না। পছন্দের দল যদি ক্ষমতায় না থাকে, বা আসন্ন নির্বাচনে যদি সেই দলের ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার আশঙ্কা প্রবল হয়, তা হলেও তিনি নির্দ্বিধায় তাঁর পছন্দের দলকে সাহায্য করতে পারছেন। গণতন্ত্রে এই স্বাধীনতা বিশেষ দামি।
বিপক্ষেও কিছু জোরালো যুক্তি আছে। সমালোচকদের মূল বক্তব্য হল, নির্বাচনী ঋণপত্র ক্ষমতাসীন দলের প্রতি পক্ষপাতদুষ্ট। অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে দেখা গিয়েছে যে, নির্বাচনী ঋণপত্র মূলত কর্পোরেটরাই কিনছে। কেউ বলতেই পারেন যে, তারা ভাবাদর্শের কারণে ততটা কিনছে না, যতটা রাজনৈতিক সুবিধা পাওয়ার আশায় কিনছে। বর্তমান নিয়ম অনুযায়ী ঋণপত্র লেনদেনের ব্যাপারটা সাধারণ ভোটার কিংবা বিরোধী দলগুলি জানতে পারছে না, ফলে অনুদানের বিনিময়ে কোনও কর্পোরেট কোনও অন্যায় সুবিধা পাচ্ছে কি না, সেটাও অজানা থেকে যাচ্ছে।
আশঙ্কা বিশেষ করে ক্ষমতাসীন দলকে নিয়ে, কারণ তাদের পক্ষে একটি কর্পোরেটকে অন্যায় সুবিধা দেওয়া সবচেয়ে সহজ। চাইলে তারা সহজেই রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক থেকে কম সুদে ঋণ পাইয়ে দিতে পারে, কর ছাড়ের ব্যবস্থা করে দিতে পারে, আমদানি শুল্ক কমিয়ে দিতে পারে। অর্থের বিনিময়ে এই সব অন্যায় সুবিধা কতটা দেওয়া হচ্ছে, সেটা জানতে পারলে সাধারণ মানুষ আরও ওয়াকিবহাল হয়ে ভোট দিতে পারতেন। জনমত সংগঠিত করে বিরোধী দলগুলি হইচই বাধাতে পারত। এবং সে সব গণতন্ত্রের পক্ষে শুভ হত। সেটা হচ্ছে না। অর্থাৎ, যে গোপনীয়তাকে নির্বাচনী ঋণপত্রের প্রবক্তারা গুণ হিসাবে দেখাচ্ছেন, সেটা আসলে এর দুর্বলতা— ক্ষমতাসীন দল এবং কর্পোরেটদের মধ্যে অসাধু বিনিময়কে লুকিয়ে রাখার আইনি আচ্ছাদন।
ক্ষমতাসীন দলের প্রতি পক্ষপাতিত্ব আরও আছে। যদি কোনও কর্পোরেট নির্বাচনী ঋণপত্রের মাধ্যমে বিরোধী পক্ষকে কিছু দেয়, কেউ কেউ বলছেন যে, ক্ষমতাসীন দলের কাছে সেটাও গোপন থাকবে না। স্টেট ব্যাঙ্কই হোক বা আয়কর বিভাগ, সকলেই অর্থ মন্ত্রকের অধীন। ক্ষমতাসীন দল চাইলে অর্থ মন্ত্রকের মাধ্যমে নির্বাচনী ঋণপত্র সংক্রান্ত সমস্ত তথ্যই জানতে পারে। এই আশঙ্কা যদি সত্যি হয়, তা হলে ক’টা কর্পোরেট সংস্থা বিরোধী পক্ষকে টাকা দিতে যাবে? তদের কি রাজরোষের ভয় নেই? ফলে নির্বাচনের জন্য বিরোধী দলগুলিকে সেই অবৈধ নগদের উপরেই নির্ভর করতে হচ্ছে। নির্বাচনী ঋণপত্রের অন্যতম সমালোচক অর্থনীতিবিদ এবং রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের ভূতপূর্ব গভর্নর রঘুরাম রাজন ও তাঁর সহযোগী রোহিত লাম্বা বলছেন যে, নির্বাচনী ঋণপত্রের মাধ্যমে প্রাপ্ত বৈধ অর্থ খরচ করছে বলে ক্ষমতাসীন দল টেলিভিশন, খবরের কাগজ, সমাজমাধ্যম ইত্যাদি জায়গায় নিজেদের বিপুল বিজ্ঞাপন দিতে পারছে, যে সুবিধা নগদের উপরে নির্ভরশীল অন্য দলগুলির ততটা নেই।
ক্ষমতাসীন দলের আর একটা সুবিধা। এটা সকলেই জানেন যে, অনেক সংস্থা তাদের অসদুপায়ে অর্জিত অর্থ ভুয়ো কোম্পানি তৈরি করে সেখানে রেখে দেয়। সেই অর্থের একটা অংশ দিয়ে নির্বাচনী ঋণপত্র কেনা যেতেই পারে। আশঙ্কা হয়, একটা ভুয়ো কোম্পানি যদি অসদুপায়ে অর্জিত টাকায় নির্বাচনী ঋণপত্র কিনে সেটা ক্ষমতাসীন দলকে দেয়, কেউ দেখতেও যাবে না যে, কোম্পানিটা ভুয়ো কি না, টাকাটা অসদুপায়ে অর্জিত কি না। কিন্তু ওই একই ঋণপত্র যদি বিরোধী কোনও দলকে দেওয়া হয়, তা হলে ক্ষমতাসীন দল সেটা জানতে পারবে এবং বিবিধ কেন্দ্রীয় এজেন্সিকে কাজে লাগিয়ে সেই ভুয়ো কোম্পানি এবং বেআইনি টাকার স্বরূপ উদ্ঘাটন করতে সচেষ্ট হবে।
নির্বাচনী ঋণপত্রের ব্যাপারে মহামান্য বিচারপতিরা কী সিদ্ধান্ত নেবেন, আমরা জানি না। তবে আন্দাজ করতে পারি যে, সিদ্ধান্ত গ্রহণের কাজটা সহজ হবে না। নির্বাচনী ঋণপত্র একেবারে তুলে দিলে রাজনৈতিক দলগুলি স্বচ্ছ ভাবে অর্থসংগ্রহ করবে কী করে? উল্টো দিকে, গোপনীয়তার শর্তটা দু’ভাবে বদলানো সম্ভব, কিন্তু কোনওটাই সমস্যামুক্ত নয়। প্রথম বিকল্প, গোপনীয়তার সম্পূর্ণ অবসান। এই ব্যবস্থা কায়েম হলে, ঋণপত্রের মাধ্যমে কে কাকে কতটা টাকা দিচ্ছে সেটা সকলেই জানতে পারবে। কিন্তু গোপনীয়তা না থাকলে কর্পোরেটরা রাজনৈতিক দলগুলোকে টাকা দেবে কেন? অভিযোগ, তারা মূলত কিছু সুবিধা পেতেই টাকা দিচ্ছে। তারা যে টাকা দিচ্ছে, সেটা জানাজানি হয়ে গেলে রাজনৈতিক দল তাদের আলাদা করে সুবিধা দিতে ইতস্তত করবে, আর সুবিধা দিতে না পারলে কর্পোরেটরাও রাজনৈতিক দলকে টাকা দেবে না।
দ্বিতীয় বিকল্প, চরম গোপনীয়তা। এই ব্যবস্থায় কেউই দাতার পরিচয় জানবে না, এমনকি গ্রহীতাও নয়। টাকাটা দলের জন্য নির্দিষ্ট একটা এজমালি তহবিলে জমা হয়ে দলের কাছে চলে যাবে। সমস্যা আছে এ ক্ষেত্রেও। যে টাকা দিচ্ছে, সে যদি নিজের পরিচয় জানাতে না পারে, তা হলে টাকা দিয়ে তার লাভ কী? আর লাভ না থাকলে খুব বেশি কর্পোরেট সংস্থা রাজনৈতিক চাঁদা দিতে রাজি হবে বলে মনে হয় না।
স্বচ্ছ ও সৎ ভাবে রাজনৈতিক অর্থসংগ্রহের কোনও সহজ উপায় আছে কি না, জানি না। কিন্তু এটুকু নির্দ্বিধায় বলা যায় যে, আসল সমস্যাটা অর্থসংগ্রহের নয়— ভোটের আগে মরিয়া হয়ে টাকা খরচ করার রাজনৈতিক প্রতিযোগিতার। ভারতে ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনে পঞ্চান্ন থেকে ষাট হাজার কোটি টাকা খরচ হয়েছিল। সেন্টার ফর মিডিয়া স্টাডিজ় জানাচ্ছে, ভোটের ইতিহাসে সারা পৃথিবীর কোথাও কখনও এত খরচ হয়নি। আমাদের দেশে টাকা খরচ করে নিশ্চয় জেতার সম্ভাবনা বাড়ানো যায়, না হলে দলগুলো পাল্লা দিয়ে এত খরচ করবে কেন? যত দিন না সাধারণ মানুষ রাজনৈতিক ভাবে শিক্ষিত হচ্ছেন, রাজনৈতিক দলগুলিকে শুধুমাত্র তাদের কাজের মধ্যে দিয়ে মূল্যায়ন করতে পারছেন, তত দিন এই প্রবণতা থেকেই যাবে।