বাহুবলী ছায়ায় লালিতপালিত পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি
Society

এতই দৃষ্টিহীন ও বধির?

শেখ শাহজাহান...তাজিমুল ইসলাম ওরফে জেসিবি...জয়ন্ত ওরফে জায়ান্ট সিংহ...জামাল সর্দার, একের পর এক নাম। তবে, নাম ও ধাম আলাদা হলে কী হবে, মিলটা অন্য জায়গায়।

Advertisement

তাপস সিংহ

শেষ আপডেট: ০৩ অগস্ট ২০২৪ ০৯:০২
Share:

—প্রতীকী ছবি।

টানটান চিত্রনাট্যের অভাব কোনও দিনই এই বঙ্গে ছিল না। নানা জমানায় মোটামুটি ভাবে সেই চিত্রনাট্য একই থেকেছে, শুধু বদলে গিয়েছে চরিত্রের নাম। লোকসভা নির্বাচন পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সময়ে যে নামগুলি নিয়ে রাজ্য রাজনীতিতে তোলপাড় চলছে, তাতে ভিন্নতর এক সমাজচিত্র চোখের সামনে স্পষ্ট হচ্ছে। সংবাদ শিরোনামে আসছে শুধু সেই সব চরিত্র যারা এক কথায় বাহুবলী বা এলাকার ডন বলে পরিচিত। তলিয়ে ভাবলে বুঝতে পারি, যাদের আমরা ‘আমআদমি’ বলি, সেই তাদের উপরে জনপ্রতিনিধিদের হয়ে যারা নিয়ন্ত্রণ কায়েম রাখে, নিছক ভয়ে যাদের সামনে জোড় হাতে দাঁড়াতে হয়, এ সমাজে তাদের কদর নিঃসন্দেহে অনেক বেশি!

Advertisement

না, সব জনপ্রতিনিধি একই ধরনের নন। কিন্তু যে জনপ্রতিনিধিরা এই সব মানুষের সঙ্গে ‘ঘনিষ্ঠ ভাবে মিশলেও ঘনিষ্ঠ নন’, সেই তাঁদের স্নেহের বা প্রশ্রয়ের হাত এই বাহুবলীদের উপরে থাকলে তারা যে কোন ‘উচ্চতায়’ পৌঁছতে পারে তা একের পর এক ঘটনা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে।

শেখ শাহজাহান...তাজিমুল ইসলাম ওরফে জেসিবি...জয়ন্ত ওরফে জায়ান্ট সিংহ...জামাল সর্দার, একের পর এক নাম। তবে, নাম ও ধাম আলাদা হলে কী হবে, মিলটা অন্য জায়গায়। এরা প্রত্যেকেই শাসক দলের ছত্রছায়ায় লালিত-পালিত বলে অভিযোগ উঠছে। কেউ কেউ আবার সদলবলে মধ্যরাতে প্রোমোটারকে পিটিয়ে আধমরা করে, এলাকায় নির্বিঘ্নে দাদাগিরি করেও দরাজ সার্টিফিকেট পাচ্ছে, ‘ভাল ছেলে, গ্র্যাজুয়েট, ভাল পরিবারের ছেলে’ বলে! কারা দিচ্ছেন এই সব সার্টিফিকেট? তাঁরা প্রত্যেকেই প্রশাসন ও শাসক দলের বিভিন্ন পদাধিকারী!

Advertisement

দলীয় মুখপাত্র বা টেলিভিশন চ্যানেলে বসা পেশাদার রাজনীতিকদের সমস্যা আবার ভিন্ন। তাঁদেরই তো প্রাথমিক ঝড়ঝাপ্টা সামলাতে হয়! প্রাচীন অরণ্য প্রবাদের মতো তাঁরা বলতে থাকেন, “যদি এ রকম কিছু ঘটে থাকে... যদি এ ধরনের কোনও অভিযোগ ওঠে তা হলে পুলিশ-প্রশাসন তা দেখবে... যথাযথ তদন্ত হবে... দোষীরা সাজা পাবে। মনে রাখবেন, আমাদের দল এই ধরনের ঘটনা প্রশ্রয় দেয় না।”

কিন্তু যাবতীয় অভিযোগই কি পুলিশের কাছে বা ‘যথাযথ ফোরাম’-এ পৌঁছতে পারে? আর পৌঁছলেও কি সুবিচার পাওয়া যায়? যাঁরা শেষপর্যন্ত ভয় ভেঙে পুলিশের কাছ যাবেন, সেই তাঁরা শান্তিতে এলাকায় থাকতে পারবেন তো? তাঁদের পরিবারের নিরাপত্তার দায়িত্ব কে নেবেন? অনেক টানাপড়েনের পরে পুলিশ যদি এফআইআর নেয়ও, তার তদন্ত ঠিকঠাক এগোবে তো? গ্রামীণ বা মফস্‌সল এলাকা, কিংবা খাস কলকাতা— প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধে মামলা শুরু হলেও তার সাক্ষ্যপ্রমাণ মিলবে তো? এখন তো চারিদিকে ‘মাস্টারমশাই, আপনি কিন্তু কিছু দেখেননি’-র সমবেত ধ্বনি!

নৈরাজ্যের একটি নিজস্ব সমীকরণ আছে। সে তার নিজের পথে চলে। এবং তাকে সে পথে পরিচালনার জন্য যে শক্তিধর বাহুবলী এবং প্রভাবশালীদের প্রয়োজন, এ সমাজে তাদের কোনও অভাব পড়েনি কোনও কালে। তূণীরের যাবতীয় তির নিক্ষেপ করে, শালীনতা ও ভব্যতার সীমা অনায়াসে পেরিয়ে তাঁরা প্রতিপক্ষকে নস্যাৎ করতে ঝাঁপিয়ে পড়েন!

গত বেশ কিছু দিন ধরে পশ্চিমবঙ্গের আনাচে-কানাচে নানা সালিশি সভা, বাড়িতে ডেকে পাঠিয়ে হাতে-পায়ে শিকল বেঁধে ‘বিচারসভা’ বসানো, ক্লাবে ডেকে ঝুলিয়ে লাঠির বাড়ি, ‘বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক’ রাখার অভিযোগে প্রকাশ্যে সংশ্লিষ্ট মহিলা ও পুরুষটিকে বেধড়ক মেরে হাতেগরম ‘বিচারপর্ব’ চালানো— এই পশ্চিমবঙ্গ সাক্ষ্য থাকছে অনেক কিছুরই। যার সবিস্তার বর্ণনা প্রায় সকলেরই জানা।

কিছু দিন আগে পুলিশের হাতে ‘ধরা পড়া’র পরেও সন্দেশখালির শেখ শাহজাহানের শরীরী ভাষা বুঝিয়ে দিচ্ছিল, সে কার্যত ‘নিরাপদ’। আর সে দিন জয়ন্ত সিংহ থেকে ‘জায়ান্ট’ হয়ে ওঠা কামারহাটির দুষ্কৃতীও হাবেভাবে বুঝিয়ে দিচ্ছিল, গ্রেফতার হলেও তার কিছু আসে যায় না। অত্যাচারের যে সমস্ত ভিডিয়ো (আনন্দবাজার পত্রিকা ভিডিয়োর সত্যতা যাচাই করেনি) ধীরে ধীরে প্রকাশ্যে আসছে এবং ভাইরাল হচ্ছে, তাতে শিউরে উঠেও প্রশ্ন জাগে, এই সব অনাচার অবাধে চলে কী করে? এক শক্তিশালী শাসক দল, সরকার ও তার প্রশাসনযন্ত্র পুরোদস্তুর সক্রিয় থাকা সত্ত্বেও এক দল অপরাধী বিভিন্ন জায়গায় তাদের মুক্তাঞ্চল তৈরি করার সুযোগ পায় কী ভাবে? সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকলে কি যে-কোনও সরকারের দৃষ্টিহীনতা ও বধিরতা আসে?

এলাকাভিত্তিক ‘ধান্দা’ও তো আলাদা রকমের। কোথাও চাষের জমি বেদখল করে ভেড়িতে রূপান্তরিত করা, বেআইনি অস্ত্রের লেনদেন চালানো, কোথাও অবৈধ বালি-পাথরের ব্যবসা করা, সিন্ডিকেট চালানো। কেউ কেউ আবার এতটাই প্রভাবশালী যে সালিশি সভায় বিচার করার পরে মহিলাদেরও বাড়িতে ডেকে এনে পায়ে শিকল বেঁধে বাঁশপেটা করেন! তাঁর স্বামী ও ছেলের সামনেই তাঁকে নিগ্রহ করা হয় বলে এক মহিলার অভিযোগ। অন্য মহিলারা নিগৃহীত হলেও প্রতিবাদ করার সাহস পাননি। কিন্তু এই মহিলা সাহস করে থানায় গিয়ে অভিযোগ দায়ের করেন। কিন্তু তার পরে তিনি কী বলছেন? বলছেন, “থানায় অভিযোগ জানানোর পরে আমায় হুমকি দিয়ে গিয়েছে। আমাকে মেরে ফেলে ফেলুক, তবু মেয়েদের উপরে এই অত্যাচারের বিচার হোক।”

বড্ড গোলমাল ঠেকে এখানেই! যূথবদ্ধ অপরাধীদের বিরুদ্ধে কেউ থানায় গেলেই তাঁর বা তাঁদের প্রাণহানির আশঙ্কা হয় কেন? এখানে তো থানা-পুলিশ আছে, প্রশাসন আছে, আদালত আছে? এটা তো গুজরাত বা উত্তরপ্রদেশ নয়! বিজেপি-শাসিত অন্য কোনও রাজ্যও নয়! এটা পশ্চিমবঙ্গ। এখানে ‘সামান্য দু’-একটি ঘটনা’ ঘটলে পুলিশ-প্রশাসন সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা করে, অন্তত রাজ্যের শাসক দলের নেতানেত্রীরা তো তেমনই দাবি করেন! কেউ কোনও প্রশ্ন তুললেই তো তাঁরা সমস্বরে বলতে থাকেন, আসলে এই রাজ্যের উন্নয়নকে রুখে দিতে চক্রান্ত চলছে। কোথাও কোনও অনিয়ম নেই। যেটুকু আছে, দল তাকে সমর্থন করে না।

রাজনীতির আঙিনায় ‘হোয়াটঅ্যাবাউটারি’র বড় বেশি চর্চা হয়। সংক্ষেপে বললে এর অর্থ, কোনও অস্বস্তিকর প্রসঙ্গ এড়াতে তার অভিমুখ অন্য দিকে ঘুরিয়ে দেওয়া। যেমন, এ রাজ্যের কোনও অনিয়মের কথা তুললে সঙ্গে সঙ্গে যোগী-রাজ্য বা গুজরাতের কথা তোলা। ঠিক যে ভাবে রাজ্যের সিপিএম নেতৃত্ব একদা সকাল-বিকাল ‘কেন্দ্রের চক্রান্ত’র তত্ত্ব আওড়াতেন।

মুশকিলটা হল, বিষবৃক্ষের বীজ বপণের পরে বিষফলের কথা মনে করাতে চান না রোপণকারীরা। বরং এড়িয়ে যেতে চান এই প্রসঙ্গ যে, নির্বাচনে জেতার জন্য বাহুবলীদের ব্যবহার করতে হয় তাঁদের। রাজনীতি, বস্তুত এক শ্রেণির রাজনীতিককে একটি সমান্তরাল রোজগারের রাস্তা খুলে দেয়। সেই রোজগার নানা পথে। যে কারণে এ বারের ২১ জুলাইয়ের মঞ্চ থেকে তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলতে বাধ্য হন, “তৃণমূল কংগ্রেস সেবার মঞ্চ। এখানে আমি বিত্তবানকে চাই না, বিবেকবানকে চাই। কারণ, পয়সা আসে, চলে যায়। সেবার কোনও বিকল্প নেই।”

প্রেক্ষাপট সম্পূর্ণ ভিন্ন, সময়কালও। তবু ভিন্ন চেহারার বৈষম্যবাদ ও ‘গণ’র হুমকি-লাঞ্ছিত এ সমাজে দাঁড়িয়ে আবেল মিরাপোলের কথা মনে পড়ে। আমেরিকায় বর্ণবৈষম্যবাদ ও গণপিটুনি দিয়ে কালো মানুষদের মারার প্রতিবাদে ইহুদি গীতিকার ও কবি আবেল গত শতকের ত্রিশের দশকে তাঁর বিখ্যাত গান ‘স্ট্রেঞ্জ ফ্রুট’-এ লিখেছিলেন, ‘ব্লাড অন দ্য লিভস অ্যান্ড ব্লাড অ্যাট দ্য রুট’।

বিবেক জাগ্রত হোক!

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement