মিত্রসকাশে: ক্রেমলিন প্রাসাদে প্রধানমন্ত্রী মোদী ও রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিনের আলাপ, মস্কো, ৯ জুলাই। পিটিআই।
জুতো জাপানি, পাতলুন বিলিতি, মাথায় লাল টুপিটা রুশ দেশের— রাশিয়ার শহর গ্রাম খামারে কিংবদন্তি হয়ে যাওয়া শ্রী ৪২০ ছবির এই গানটিকে স্মরণ করলেন মোদী তাঁর বহুচর্চিত মস্কো সফরের প্রথম দিনেই। সেই সঙ্গে রাজ কপূর, মিঠুন চক্রবর্তীর কথা উল্লেখ করে ভারত-রাশিয়া সম্পর্কের মেদুর, মায়াঘেরা সময়কে ফিরিয়ে আনতে চেষ্টা করলেন, যেমনটা যে কোনও ভারতীয় রাষ্ট্রনেতাই মস্কোয় পা দিয়ে করে থাকেন।
কিন্তু এ বড় সুখের সময় নয়, এ বড় আনন্দের সময় তো নয় বিশ্ব রণনীতিতে। দেওয়ালে দেওয়াল, কার্নিসে কার্নিস লেগে গিয়েছে গাজ়া, ইউক্রেন, ইরান, ইথিয়োপিয়া, সাব-সাহারান আফ্রিকায়। রণরক্ত বিফলতা হিংসার লড়াইয়ে এই গ্রহ বহুধাবিভক্ত হয়ে ফিরিয়ে এনেছে ঠান্ডা যুদ্ধের স্মৃতি। আর গত দু’বছর সেই ক্রমশ সরু হয়ে আসা তারে হাঁটতে হাঁটতে এ বার এনডিএ-র নতুন সরকারের সামনে আসা চ্যালেঞ্জ বৃহত্তর হয়ে উঠছে, প্রধানমন্ত্রী মোদীর মস্কো সফরের পর।
মোদীর যে শরীরী ভাষা গত দশ বছর ধারাবাহিক পুনরাবৃত্ত হওয়ার পর নেহাতই নৈমিত্তিক বলেই ধরে নিয়েছে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়, এ বার সেটাই বড় বেশি চোখে পড়ে গিয়েছে আমেরিকা, তৎসহ অবশ্যই ইউক্রেন এবং বেজিং-এরও। তার কারণ যখন আষ্টেপৃষ্ঠে পুতিনকে জড়িয়ে ধরেছেন মোদী তাঁর আলিঙ্গনের কূটনীতি-বশে, তখন ইউক্রেনের শিশু-হাসপাতাল থেকে অসুস্থ এবং দগ্ধ দেহগুলিকে উদ্ধার করার কাজ চলছে।
রাশিয়ার ওই হামলায় শুধু হাসপাতালটিই নয়, সে দেশের অত্যাবশ্যক স্বাস্থ্য পরিষেবার কাঠামোও ভেঙে পড়েছে বলে খবর। সে দেশের শিশু-হাসপাতালে রাশিয়ার ক্ষেপণাস্ত্র আক্রমণের সময়কালটা এমনই বাছা হয়েছে, যা মোদীর রাশিয়া সফরের সঙ্গে খাপে খাপে মিলে গিয়েছে। বিষয়টি নিঃসন্দেহে কাকতালীয়, রাশিয়া অন্য দেশের লাভক্ষতি ভেবে এই হামলা চালাচ্ছে না। কিন্তু দৃশ্য তৈরির কূটনীতি, যে পরিপ্রেক্ষিতের পার্থক্যে সম্পূর্ণ বিপরীত অর্থ ধারণ করে, সেই কাণ্ডজ্ঞানটুকু রাখা উচিত ছিল সাউথ ব্লকের।
তবে মস্কোর চোখ দিয়ে দেখলে, মোদীর এই সফর যেন নৈবেদ্যর উপর বাড়তি নারকেল নাড়ুটি! কারণ প্রধানমন্ত্রী মোদী এই সফরের দিনক্ষণে সম্মতি জানানোর সময়ই নেটোর শীর্ষ সম্মেলনের নির্ঘোষ, পশ্চিমের সমস্ত সংবাদপত্রের অগ্রভাগে। এমতাবস্থায় রাশিয়া যে বিবিক্ত হয়ে যায়নি গোটা বিশ্ব থেকে, এটা বোঝানোর একটা দায় ছিল রাশিয়ার প্রেসিডেন্টের।
মোদীকে পাশে নিয়ে, ব্যাটারিচালিত গাড়িতে তাঁর বাসভবন ঘুরে দেখানোর ভিডিয়ো, পুতিনের রাজনীতির জন্য যতটা লাভজনক, ভারতের জন্য বোধ হয় ততটা নয়। ভারতের সঙ্গে রাশিয়ার বিশেষ সুবিধাসম্পন্ন কৌশলগত সম্পর্কের ব্র্যান্ডিং করেছেন পুতিন বড় মুখে, পশ্চিম থেকে ছুটে আসা বিষবাণগুলির সামনে এ একটা সুবিধাজনক বয়ান তো বটেই। কারণ, এটাও ভুললে চলবে না ভারত আমেরিকার কৌশলগত অংশীদারও বটে।
ভারতীয় কর্তারা অবশ্যই দাবি করছেন, আগে তো বটেই, সদ্য তৃতীয় ইনিংস শুরু করার পরও, ভারসাম্যের রাজনীতি অটুট রাখতে চেষ্টার কোনও কার্পণ্য করছে না নয়াদিল্লি। অতি সম্প্রতি সুইৎজ়ারল্যান্ডে শান্তি প্রক্রিয়ায় যোগ দিয়েছে ভারত। বিদেশ মন্ত্রকের অফিসাররা সেখানে শান্তির পক্ষেই বার্তা দিয়েছেন। কিন্তু রাশিয়া-বিরোধী যৌথ ঘোষণায় সই করেননি তাঁরা, বরং বলেছেন রাশিয়াকে বাদ দিয়ে এই শান্তি আলোচনা করে কোনও লাভ নেই।
ডোনাল্ড ট্রাম্প যদি নভেম্বরে ক্ষমতায় আসেন, তা হলে পুতিনকে আলোচনার টেবিলে বসাতে পারলেও পারতে পারে সাউথ ব্লক, এমন একটি বাতাবরণ ভাসিয়ে রাখা হয়েছে বাতাসে। রাশিয়া সফরের আগে মোদী নিজে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জ়েলেনস্কির সঙ্গে জি৭ গোষ্ঠীর আমন্ত্রণমূলক সম্মেলনে পার্শ্ববৈঠকে বসেছেন।
তবে ভারসাম্য রক্ষার জন্য যে মূল্য চোকাতে হয়, তা বিলক্ষণ দিতে হচ্ছে নয়াদিল্লিকে। ২০২২ সালে যখন নয়াদিল্লির ‘ইউক্রেন-দ্বন্দ্ব’ (যা ‘ইউক্রেন ডিলেমা’ বলে কূটনৈতিক জগতে পরিচিত হয়ে গেছে ইতিমধ্যে) শুরু হয়, তখন তার ছিল বেশ কয়েকটি কাঁটা। যার মধ্যে প্রধান পাঁচটি কাঁটা হল, জ্বালানি, খাদ্য, সার এবং আমেরিকা ও চিন। জ্বালানির সমস্যা ভারতকে পোহাতে হয়নি, রাশিয়া থেকে সস্তায় অশোধিত তেল আমদানিকারী রাষ্ট্রের মধ্যে শীর্ষ জায়গা নিয়েছে ভারত।
কিন্তু শত্রুতা বেড়েছে বেজিং-এর সঙ্গে। ওয়াশিংটন নিজেদের ভোট নিয়ে ব্যস্ত, তারা ‘কোয়াড’কে অবজ্ঞা করে এবং ভারতের আবেদন অগ্রাহ্য করে, অস্ট্রেলিয়া জাপান ব্রিটেনকে নিয়ে নিজেদের ভারত প্রশান্ত মহাসাগরীয় ঘুঁটি সাজাচ্ছে। মোদীর রাশিয়া সফরের পর যে কড়া ভাষায় নয়াদিল্লিতে নিযুক্ত আমেরিকার রাষ্ট্রদূত এরিক গারসেটি বিবৃতি দিয়েছেন, তা কিছুটা অভূতপূর্ব তো বটেই।
চিনের বিষয়টি আরও একটু জটিল। ভারতের জন্য যদি বেজিং চ্যালেঞ্জ হয়, তা হলে রাশিয়ার কাছেও তা সুমধুর নয়। পুতিন যখন গত মাসে উত্তর কোরিয়ার কিম জং-উনকে আলিঙ্গন করেছিলেন, চিন তা বাঁকা চোখে দেখেছে। রাশিয়া তার নিজের যে চাল সাজাচ্ছে, তাতে ভারত একটি বড় অংশ, সেটাও শি জিনপিংয়ের কাছে খুশির খবর নয়। ফলে ভারত-রাশিয়া ঘনিষ্ঠতাকে ভাঙার একটা চোরা চেষ্টা তাঁদেরও রয়েছে।
ভারতের ‘ইউক্রেন দ্বন্দ্ব’-এর আরও একটি দিক, শান্তি প্রস্তাব এবং যুদ্ধ বন্ধের জন্য লাগাতার সওয়াল করে যাচ্ছে ভারত ঠিকই, কিন্তু দীর্ঘ দিন হয়ে গেল, রাশিয়া তাতে কর্ণপাত করেনি, তাকে শান্তির টেবিল পর্যন্ত নিয়ে আসা একা ভারতের পক্ষে কত দূর সম্ভব, সেটাতেও সন্দেহ তৈরি হচ্ছে। এ বারে মোদী, পুতিনকে সামনে বসিয়ে যা বলেছেন, তা নিঃসন্দেহে তারিফযোগ্য। সুকৌশলে নিরবচ্ছিন্ন তেল সরবরাহের জন্য পুতিনকে বার বার ধন্যবাদ দেওয়ার পর সরাসরি বলেছেন, নিষ্পাপ শিশুর মৃত্যু হৃদয়ে রক্তক্ষরণ ঘটায়। বোমা-বন্দুক-গুলির মধ্যে সমাধান নিহিত নেই।
এক কথায়, ২০২২ সালে তিনি যা বলেছিলেন পুতিনকে, তার থেকে স্বর একটু চড়িয়েছেন মোদী। সেই সঙ্গে তাঁর দাবি, পুতিনের বাসভবনে চার ঘণ্টা খোলামেলা আলোচনায় ঐকমত্য হয়েছে, হিংসা পুতিনও চান না। কিন্তু এর কোনও প্রতিমন্তব্য পুতিন করেননি, মোদীর বক্তব্যের সময় তাঁকে অস্থির আঙুল দিয়ে চেয়ারের হাতলে হাত বোলাতে দেখা গিয়েছে মাত্র। গোটা বিশ্ব এখনও জানে না রাশিয়ার বাসভবনে ইউক্রেন নিয়ে কী খোলামেলা আলোচনা হয়েছিল মোদী ও পুতিনের।
অন্য দিকে, নেটো প্রস্তাব দিয়েছে ইউক্রেনে অস্ত্র উৎপাদন বাড়ানোর জন্য, কিভ-কে সামরিক ভাবে শক্তিশালী করার জন্য। সব মিলিয়ে ভারত তার ভারসাম্যের যে কূটনীতি এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে, তাতে ঘরোয়া রাজনীতির একাংশে তারিফ মিলছে ঠিকই, কিন্তু বাইরে সাফল্য আসছে না।
নতুন সরকার শুরুর এক মাসের মধ্যে নতুন এনডিএ সরকার আঁচ পাচ্ছে এই সময়খণ্ড আসলে আরও গভীরতর যুদ্ধের ভিতরে সেঁধিয়ে যেতে পারে। এমতাবস্থায় ভারসাম্য টিকিয়ে রাখা বড় সহজ কাজ নয়। মোদীর রাশিয়া সফর বাইরে থেকে দ্বিপাক্ষিক হলেও তাকে ঘিরে যে বহুপাক্ষিক ও বহুমাত্রিক অস্বস্তি তৈরি হয়েছে, তার অবসানও সহজ লক্ষ্য নয়। ভারত-রাশিয়া সম্পর্কে যে কেবলমাত্র দেশের জাতীয় নিরাপত্তা ও স্বার্থেরই প্রকাশ, এই তত্ত্ব পশ্চিম বিশ্বকে বোঝাতে আরও অনেকটা পথ হাঁটতে হবে নরেন্দ্র মোদীকে। সেটিতে অস্বস্তির দিক হল, জাতীয় স্তরে তিনি ও তাঁর দল আগের তুলনায় এখন কমজোরি। গত বারের মতো নিরঙ্কুশ সংখ্যার দাপট তাঁর হাতে আর নেই। এই পরিস্থিতিতে বিদেশনীতিতে দাপট ধরে রাখা তাঁর পক্ষে মুশকিল।