আগের প্রজন্মের যাঁরা বিদেশে গিয়েছেন, তাঁদের কাছে নানান অভিজ্ঞতার কথা শুনেছি। ফাইল চিত্র।
যখন উচ্চতর গবেষণার জন্য প্রথম বিদেশে পাড়ি দিলাম, তখন ভারতের গড় জাতীয় আয় ছিল ৬০০ ডলারের আশেপাশে। আর্থিক উদারীকরণ হয়েছে মাত্র ১৩ বছর। ভারত ধীরে ধীরে আর্থিক উন্নতির মুখ দেখছে, কিন্তু তা-ও খুব সামান্যই। ফলে ভারতীয় হিসেবে অন্য দেশে মানুষ আমাকে কী চোখে দেখবে, তা নিয়ে একটু আশঙ্কা ছিল। আগের প্রজন্মের যাঁরা বিদেশে গিয়েছেন, তাঁদের কাছে নানান অভিজ্ঞতার কথা শুনেছি। কেউ বলেন, গরিব বলে ভারতীয়দের একটু নিচু চোখে দেখা হয়, যদিও একটা বাহ্যিক কৃত্রিম সম্মান দেখানোও হয়। কিন্তু আগের প্রজন্মের অনেকের মধ্যেই একটা চাপা হীনম্মন্যতার ভাব দেখেছি।
বিদেশে পৌঁছনোর তিন দিন পর এক শ্বেতাঙ্গ ব্যক্তি জিজ্ঞাসা করলেন, আমি কোন দেশ থেকে এসেছি? আমি একটু নিচু গলায় দেশের নাম বললাম। তিনি চোখ বড় বড় করে বললেন, “ইন্ডিয়া? গ্রেট কান্ট্রি অব সফটওয়্যার প্রফেশনালস!” কিঞ্চিৎ হতচকিত হয়ে সে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা-গুরু’কে ঘটনাটি বললাম, যিনি আবার জন্মসূত্রে ভারতীয়— “ও দাদা, গ্রেট কান্ট্রি বলছে গো, কুলি-মজুরদের দেশ বলছে না।” তিনি হেসে বললেন, ১৯৯১-এর পর থেকে ভারত এবং ভারতীয়দের নিয়ে বিদেশিদের ধারণা কিছুটা বদলেছে। এবং তা প্রাথমিক ভাবে ভারতীয়দের ‘সফটওয়্যার প্রফেশনাল’ হয়ে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ার মাধ্যমে হয়েছে। আস্তে আস্তে তা গবেষণা ও অন্যান্য ক্ষেত্রেও ছড়াচ্ছে। অনস্বীকার্য যে, বিজ্ঞান, অর্থনীতি, সাহিত্য, চলচ্চিত্র ও অন্যান্য ক্ষেত্রে ভারতীয়দের আন্তর্জাতিক খ্যাতি আগেই এসেছিল। কিন্তু সে যৎসামান্য আন্তর্জাতিক খ্যাতি ভারতীয়দের নিয়ে বিদেশিদের সামগ্রিক ধারণা পাল্টানোর জন্য হয়তো যথেষ্ট ছিল না।
অর্থনীতির ছাত্র হিসেবে একটি কথা মনে হয়: আর্থিক ক্ষমতা একটি বিরাট ক্ষমতা। অনেকের কাছে এখনও এই সত্যটি একটু অপ্রিয়— “পয়সাই সব? সে আবার কী!” আমাদের দেশের এখনও পিছিয়ে থাকার কারণ, আমরা এখনও কম বিত্তশালী। ভারত এখনও একটি নিম্ন-মধ্যবিত্ত দেশ। কিছু দিন আগে অবধি আমরা নিম্নবিত্ত ছিলাম। এখন কিছুটা উন্নত হয়ে আমরা নিম্ন-মধ্যবিত্ত হয়েছি। আন্তর্জাতিক স্তরে একটি দেশের সম্মান বা ‘ইজ্জত’ তার বিত্তের উপরই প্রাথমিক ভাবে নির্ভরশীল, সে যে যা-ই বলুক, ভাল লাগুক বা না লাগুক। আর বিত্তশালী হওয়ার মধ্যে এত অপরাধবোধের কী আছে? একটি দেশ যত বিত্তশালী হবে, বিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান, সাহিত্য, শিল্পকলা, গবেষণা, খেলাধুলা বিভিন্ন ক্ষেত্রে বেশি বেশি বিনিয়োগ করা যাবে। বিভিন্ন দেশের প্রতিভা আমাদের দেশে ভিড় করবে এবং সমস্ত ক্ষেত্রের গুণগত প্রসার ঘটবে। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে আরও খ্যাতি আসবে। একটি দেশের পক্ষে এটাই তো কাম্য।
আমাদের দেশের বেশ কয়েক জন শিল্পপতি বিশ্বের সবচেয়ে ধনীদের মধ্যে এখন স্থান পান। যা আগে ভাবাই যেত না। অনেকে বলবেন, এতে সাধারণ মানুষের কী এল-গেল? কিছুটা এসে যায়, কারণ এঁরাই শিল্পের ও কর্মক্ষেত্রের প্রসার ঘটান। এঁরাই চাকরি তৈরি করেন। শুধু চায়ের কাপে তুফান তোলা আর সমাজমাধ্যমে ‘মুখেন মারিতং জগৎ’ করার থেকে তা ঢের ভাল। এঁদের মধ্যে কেউ কেউ আবার পরিকাঠামো উন্নয়নে বিনিয়োগ করেন। অনেকের হয়তো জানা নেই যে, ভারতের পরিকাঠামো উন্নয়নে বিনিয়োগ করার লোক খুব কম। পরিকাঠামো থেকে লাভের গুড় পেতে সময় লাগে অনেক বেশি। সবাই চটজলদি লাভ চান। আর এই মুহূর্তে ভারতের পরিকাঠামো উন্নয়ন পুরোটাই সরকার করবে, তা ভাবলে ভুল হবে। বেসরকারি পুঁজি চাই।
তাই কেউ যদি পরিকাঠামো উন্নয়নে বিনিয়োগ করে থাকেন, তাঁর মুণ্ডপাত অন্তত আমাদের ভারতীয়দের কম করা উচিত। বিদেশের কোনও ‘শর্ট সেলার’ এসে আমাদের বিরাট উপকার করল, এমন ভাবা মূর্খামি হবে। তবে এর ফলে যদি সেই ব্যক্তির ব্যবসা সংক্রান্ত কোনও কর্মপন্থার উন্নতিসাধন হয়, তা হলে সবার মঙ্গল। কিন্তু ‘ভারতীয় কাঁকড়া’ হয়ে তাদের টেনে নামানোর প্রয়োজন আছে কি? পুঁজিপতি মানেই খারাপ, আর বাকিরা সবাই সাধু, এমন ধারণা ভিত্তিহীন।
একটি দেশের যত উন্নয়ন হয়, তারা বিত্তশালী হয় আর সে দেশের জনসাধারণ অনেক বেশি আত্মবিশ্বাসী হয়, তাদের হীনম্মন্যতা কমে। যেমন আমরা এখন আগের তুলনায় অনেক কম হীনম্মন্যতায় ভুগি। অবশ্য একটি দেশ বিত্তশালী হওয়ার সঙ্গে সেই বিত্তের ভাগ যাতে সমাজের সর্বশ্রেণি পায়, তা দেখার দায়িত্ব সেই দেশের সরকারের। অর্থাৎ, বিত্তের বণ্টনের কিছুটা দায়িত্ব সরকারের উপর বর্তায়, যদিও বণ্টন যে সব সময় সমবণ্টন হতে হবে, তার কোনও মানে নেই, কারণ সবার ক্ষমতা বা প্রতিভা এক রকম নয়। যাঁরা প্রতিভাধর, তাঁরা হয়তো বাজারের নিয়মেই কিছুটা বেশি পাবেন। কিন্তু মোটের উপর দেশের প্রগতিতে সবার ভালই হওয়া উচিত, হীনম্মন্যতা কমা উচিত।
আমাদের দেশ এমন একটি সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে, যেখানে বহির্বিশ্ব আমাদের উন্নয়নকে কিছুটা সম্মানের চোখে দেখছে। কিছু প্রতিবেশী রাষ্ট্র যখন আর্থিক বিপর্যয়ের সম্মুখীন, আমাদের অবস্থা যথেষ্ট স্থিতিশীল। অর্থনীতির বিচারে আমরা বিশ্বের পঞ্চম, যদিও মাথাপিছু আয়ের নিরিখে আমরা বেশ কিছুটা পিছিয়ে। যেটুকু প্রগতি আমাদের হয়েছে তাতে যেমন আমরা সম্ভ্রম পাই, তেমনই কিছু শ্রেণির ঈর্ষার উদ্রেক করি। তাই আমাদের দেশকে ছোট করে দেখানোর চেষ্টাও খুব কম হয় না। আমাদের দেশে বেশ কিছু আর্থসামাজিক সমস্যা আছে, যা অন্য অনেক উন্নত দেশেও আছে। কিন্তু শুধু সমস্যাগুলির দিকে আঙুল তুলে ভারতকে খাটো করে দেখানোর চেষ্টা হালে কিছুটা হলেও বেড়েছে।
বাইরের লোক তো সে চেষ্টা করবেই। ঘরের লোক যদি নিজের ক্ষুদ্র স্বার্থে সে চেষ্টা করে? আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি ৭৫ বছর হল। যাদের থেকে স্বাধীনতা পেলাম, যারা আমাদের দেশ থেকে প্রায় ৫০ লক্ষ কোটি ডলার চুরি করে, শোষণ করে প্রায় ধ্বংস করেছিল, সেই দেশে গিয়ে যদি কেউ বলেন যে, ভারতে অনেক সমস্যা, ভারতে গণতন্ত্র নেই, আপনারা হস্তক্ষেপ করুন, তা হলে? এটি একটি সুচিন্তিত পদক্ষেপ দেশকে হেয় করার। আবার একাধারে বোকামিও বটে। উনি কি বলতে চাইছেন, “আপনারা এসে আমায় ক্ষমতায় বসিয়ে দিয়ে যান, আমাদের পরিবারতন্ত্র আর চলছে না, দয়া করে সাহায্য করুন?” এতে উদ্দেশ্যসাধন হবে? রাজনৈতিক ক্ষমতা যেন তেন প্রকারেণ ফিরে পাওয়াটাই সব নয়। দেশের সমস্যার কথা দেশের মানুষের কাছে বলুন, তাঁদের নিজের মতের দিকে টেনে আনার চেষ্টা করুন, নিজের জনপ্রিয়তা বাড়ান, জনগণ ঠিকই ভোট দেবে। তার জন্য প্রাক্তন মনিবদের কাছে করজোড়ে ‘হে প্রভু, সাহায্য করুন’ বলার প্রয়োজন নেই। এ তো হেরে যাওয়া। আমরা কি তা হলে সেই প্রাক্-স্বাধীনতা যুগে ফিরে যাওয়ার চেষ্টা করছি, যখন কিছু ব্রিটিশদাস ফুলে-ফেঁপে উঠত ব্রিটিশদের পদলেহন করে?