ইন্দিরা গাঁধী থেকে নরেন্দ্র মোদী— পরিবেশ রক্ষার্থে ‘ভাল’ কাজ করলেও কি পরিবেশবিদদের কাছে ‘প্রাপ্য সম্মান’ পান না? পশ্চিমবঙ্গে আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনে দলগুলির কাছে এ বারেও পরিবেশের প্রশ্ন ব্রাত্য— এই অভিযোগ সামনে আসামাত্রই এমন উল্টো প্রশ্ন উঠতে আরম্ভ করেছে (‘পরিবেশচিন্তা যখন রাজনীতি’, ২-৩)। যেমন, সামনে আনা হচ্ছে গরিব মহিলাদের জন্য মোদীর উজ্জ্বলা গ্যাস প্রকল্প, যার কারণে মহিলাদের নাকি উনুনের ধোঁয়ার দূষণ থেকে বহুলাংশে রেহাই মিলেছে, বা অধুনা উত্তরাখণ্ডে গাছ কাটা বন্ধে ইন্দিরা গাঁধীর ভূমিকার কথা।
উজ্জ্বলা প্রকল্পে দারিদ্রসীমার তলায় থাকা মহিলাদের ঘরে ভর্তুকিতে গ্যাস সিলিন্ডার পৌঁছে দেওয়া সংখ্যার নিরিখে হিট। দেশে গ্যাস সংযোগ আছে, এমন পরিবারের সংখ্যা গত কয়েক বছরে ৫৮ থেকে বেড়ে ৯৮ শতাংশ হয়েছে। কিন্তু তার পর? এত পরিবারে গ্যাস পৌঁছলেও গত পাঁচ বছরে গ্যাসের চাহিদা বেড়েছে মাত্র ২০ শতাংশ! কারণ, প্রথম বার বেশ খানিকটা ভর্তুকি মিললেও, তার পর থেকে গরিব মানুষকে কড়ায় গন্ডায় টাকা মিটিয়ে গ্যাস কিনতে হচ্ছে ও গ্যাসের দাম ক্রমেই বাড়ার কারণে প্রতি ছ’টি পরিবারের মধ্যে একটির আর দ্বিতীয় বার গ্যাস কেনার সামর্থ্য থাকছে না। এক-তৃতীয়াংশের বেশি পরিবার ফেরত গিয়েছে আগে ব্যবহার করা দূষণ সৃষ্টিকারী জ্বালানিতে। ফল, উজ্জ্বলা নিয়ে এত ঢক্কানিনাদ সত্ত্বেও ভারত এখনও বায়ুদূষণে মৃত্যুর ক্ষেত্রে বিশ্বে প্রথম সারিতে। প্রায় একই রকম ছবি স্বচ্ছ ভারত ও গঙ্গা শোধন প্রকল্পে। সরকারি হিসেবেই স্বচ্ছ ভারত প্রকল্পে পরিষেবা দেওয়ার ক্ষেত্রে সারা দেশের গড় নম্বর ৩১.৩৮। অর্থাৎ, ডাহা ফেল। আর গঙ্গার দূষণ মুক্তি? ২০২০ সালের মে মাস অবধি ২৮,০০০ কোটি টাকার উপর বরাদ্দ করলেও, যার প্রায় এক-চতুর্থাংশ ইতিমধ্যেই খরচ হয়ে গিয়েছে, গঙ্গার গঙ্গাপ্রাপ্তিকে এখনও ‘ইউ টার্ন’ করানো যায়নি। জি ডি আগরওয়ালের মতো বিজ্ঞানী নির্মল স্রোতের দাবিতে অনশন করে মারা গিয়েছেন। কিন্তু বারাণসী থেকে জিতে আসা নরেন্দ্র মোদী বা তাঁর সরকারের বিশেষ হেলদোল নেই।
তবে সব দোষ প্রধানমন্ত্রীকে দেওয়া উচিত হবে না। ‘জল ধরো, জল ভরো’ প্রকল্প প্রথম ক্যাবিনেট মিটিংয়ে পাশ হয়ে আশা জাগিয়ে শুরু করলেও পরিবেশ উন্নয়নের নামে এ রাজ্যেও গত দশ বছরে যা হয়েছে, তা হল মূলত সৌন্দর্যায়ন। শুদ্ধ বাতাস থেকে বহতা নদী, মাটির তলার জলের সংরক্ষণ থেকে মেডিক্যাল জঞ্জালের ঠিকমতো অপসারণ— কোনওটাই যথার্থ গুরুত্ব পায়নি। পরিবেশ দূষণের কারণে বার বার রাজ্যের উপর পরিবেশ আদালতের শাস্তি নেমে এসেছে। আসলে মোদীই হন, বা মমতা— কারও উন্নয়নের ধারাপাতে পরিবেশ নেই।
পরিবেশকে ব্রাত্য করে সত্যিই কি তাঁরা উন্নয়ন করতে পারছেন? সরকারি তথ্যই বলছে, না। নীতি আয়োগের তথ্যভিত্তিক পরিবেশকেন্দ্রিক সংবাদমাধ্যম ডাউন টু আর্থ সম্প্রতি যে ‘স্টেট অব ইন্ডিয়া’স এনভায়রনমেন্ট’ নামে রিপোর্ট প্রকাশ করেছে, তাতে ২০২০ সালে টেকসই উন্নয়নের মার্কশিটে মোদীর (অর্থাৎ, ভারতের) নম্বর ৬০; সারা পৃথিবীতে ১১৭ নম্বর। রাজ্যের তালিকায় পশ্চিমবঙ্গ দেশের মধ্যে ১৩ নম্বর স্থানে। মমতার নম্বরও মোদীর সমান, ৬০। ২০৩০ সালে যেখানে পৌঁছতে হবে, মোদী ও মমতা দু’জনেই তার থেকে অনেক দূরে।
পরিবেশকে গুরুত্ব না দিলে কী হতে পারে, তা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে উত্তরাখণ্ড, যেখানে তথাকথিত উন্নয়নের চাপ নিতে না পেরে আট বছরের মধ্যে দু’টি আকস্মিক বন্যায় মারা গিয়েছেন কয়েক হাজার মানুষ। এই সেই অঞ্চল, যেখানে প্রায় পাঁচ দশক আগের চিপকো আন্দোলন গোটা পৃথিবীর পথিকৃৎ। বলে রাখা ভাল যে, ইন্দিরা গাঁধীর ‘সক্রিয়তা’র কারণে নয়, চিপকো আন্দোলন সফল হয়েছিল স্থানীয় মানুষদের চাপে। আন্দোলনের প্রাণপুরুষ সুন্দরলাল বহুগুণার কাছ থেকে কয়েক বছর আগে সরাসরি শোনা, কী ভাবে গঢ়বাল পাহাড় জুড়ে আন্দোলন, অনশন করে ও সরকারের উপর চাপ বাড়িয়ে গাছ কাটা বন্ধ করতে হয়। প্রতিবাদীদের কথা মেনে নেওয়ার মানসিকতার কারণে ইন্দিরা গাঁধী বাহবা পেতে পারেন, কিন্তু ওইটুকুই।
এখনও অবধি পরিবেশ নিয়ে যেটুকু সদর্থক কাজ হয়েছে, মূলত আদালতের চাপে বা পরিবেশকর্মীদের আন্দোলনের ফলে। পরিবেশপ্রেমীদের চাহিদা খুব অল্প। সরকার, তা সে কেন্দ্রীয় হোক, বা রাজ্যের, যেন পরিবেশের ক্ষেত্রে নিজেদের তৈরি নিয়ম সরাসরি বা নাক ঘুরিয়ে নিজেরাই না ভাঙেন, বা ভাঙতে সাহায্য না করেন! উন্নয়নের স্টিমরোলার চালাতে গিয়ে যেন মনে রাখেন যে, পরিবেশ না বাঁচলে খাতা-কলমের উন্নয়নও হাঁটু ভেঙে পড়বে।