—প্রতীকী ছবি।
মারাত্মক এক ওজনের চাপে আমরা আজ পিষ্ট। ব্যস্ত, উদ্বিগ্ন ও সচেষ্ট— শরীর রূপান্তর নিয়ে। এই অভিপ্রায়ের মূলে রয়েছে শরীরের পণ্যায়ন, পরিবেশনা ও অনুপ্রাণিত-অনুকরণ। রয়েছে খাদ্য-নিয়ন্ত্রণ, প্রসাধন, রূপচর্চা, প্রয়োজনে ওষুধ ও অস্ত্রের প্রয়োগও। আছে আকার, আয়তন নিয়ে মগ্নতা। আছে অনুশীলন, অর্থ ও সময় ব্যয়, আর তা থেকে পাওয়া বিপুল আত্মতুষ্টির অনুভব, যার কোনও শেষ নেই। কারণ, কামনার ভিত্তিই হল চির-অতৃপ্ততা, ‘আরও চাই’ মনোভাব। এই তত্ত্ব ও সত্যটি বাহ্যিক রূপের ক্ষেত্রেও সমান ভাবে খাটে। আর ঠিক সেই যুক্তিতেই, ব্যক্তি-স্বাধীনতার পছন্দের আবরণ হয়ে ওঠে প্রতিযোগিতামূলক জেল্লা আর অহংয়ের ধারক ও বাহক।
আমরা সহজেই ভুলে যাই, শরীরকেন্দ্রিক এই আত্ম-উন্নতির অনুপ্রেরণার পিছনে যে দৃশ্যগত সূত্রগুলি রয়েছে, তারা আমাদের দৈনন্দিন জীবনের নাগালের কতটা বাইরে। যে তারকা বা মডেল সুগন্ধি, স্বপ্ন বা আবাসন বেচতে প্রলুব্ধ করছেন, সেই মহিমা তো তাঁর নিজস্ব নয়। তার পিছনে রয়েছে চড়া কৃত্রিম আলো, প্রসাধন, যান্ত্রিক সম্পাদনার কারসাজি, বিপুল পুঁজির সমাবেশ। যে পুঁজির লক্ষ্য আমাদের মনোযোগে ভাগ বসানো। মোহ ও আচ্ছন্নতার প্রলেপে আমাদের ভুলিয়ে রাখাই বিজ্ঞাপন ও বাজারের অন্যতম উদ্দেশ্য। তার ডাকে আমাদের ক্রেতা-সত্তা সহজেই উত্তেজিত ও জাগ্রত হয়। আমরা বিশ্বাস করে ফেলি পণ্যের প্রতিশ্রুতিতে, সাড়া দিই তার আহ্বানে। আমরা মেনে নিই বেদাগ ত্বকের আশ্বাস, সৌন্দর্য ও বিলাসের আরও কত প্রকরণ— লাবণ্য, মসৃণতা, ঔজ্জ্বল্য সংক্রান্ত সহস্র বিজ্ঞাপনী দাবি।
এই সব দাবির মধ্যে এক নিবিড় রীতিগত মিল আছে। শরীরকে পরিণত করতে হবে এক উন্নত ও উৎকৃষ্ট পণ্যে— এই তার বাণিজ্যিক দর্শন। সেটাই যেন জীবনের লক্ষ্য, সাফল্যের মাপকাঠি; উত্তেজনার চাবিকাঠিও সেটাই। সেটাই দৃষ্টি আকর্ষণের মূলমন্ত্র; পরম যৌন প্রাপ্তিও। শরীরকে সযত্নে সাজিয়ে গুছিয়ে রাখলে শুধু চলবে না; রাখলে, তবেই তা হতে পারে প্রদর্শনযোগ্য বা পরিবেশনের জন্য প্রস্তুত। বাজার, বিজ্ঞাপন ও পণ্যেরা এ কাজটা বিভিন্ন স্তরে নিষ্ঠার সঙ্গে বেচে।
প্রথমেই সে প্রতিনিয়ত মনে করায়, আপনার শরীরে বহু ঘাটতি: ব্রণ, দাগ, চর্বি, অবাঞ্ছিত রোম, চুল পাতলা হয়ে আসা, চামড়ার রুক্ষতা, ত্বকের শ্যামবর্ণ, মুখের আদল, নাকের গড়ন, ভোঁতা চিবুক, অপর্যাপ্ত বাঁক, থলথলে মাংস, আরও কত কী। অবিলম্বে প্রয়োজন স্ব-নিয়ন্ত্রণ, সেই সব সামগ্রীর ব্যবহার যা ওই খামতি মুছে বা ঢেকে দেবে, বাড়াবে আত্মবিশ্বাস। নয়তো লজ্জায় পড়তে হবে জনসমক্ষে। আর ওই সামগ্রীগুলোর ব্যবহারে নিমেষে হয়ে ওঠা যাবে অন্যের চোখে লোভনীয়। অর্থাৎ, সমস্যাগুলি চিহ্নিত বাজার-বিজ্ঞাপন-পণ্য দ্বারা, আবার ওই ত্রয়ীই আপনাকে বেচবে সহজ সমাধান, যা কিনবেন আপনি। এই পুরো প্রক্রিয়াটার শুরুতে আবেদন, মাঝখানে ক্রয়, শেষে অতৃপ্তি ও বর্ধিত চাহিদা।
এ এক অদ্ভুত খেলা, অনন্ত ফাঁদ। শরীর-উন্নয়ন পরিকল্পনায় সমস্যাও অফুরন্ত, সমাধানও অশেষ। একটাতে সাফল্য লাভ করামাত্র আর একটার দিকে মন চালিত হতে থাকে। সাময়িক প্রাপ্তি হলেও শেষে নিজেদের নিয়ে থেকে যেতে হয় চির অতৃপ্ত, আরও পরিবর্তনে মগ্ন, উদ্বিগ্ন। বাজার যে আদর্শ লক্ষ্যের নির্মাণ করে, তা সাধারণ মানুষের থেকে এতটাই দূরে যে পাওয়া দুঃসাধ্য হয়ে ওঠে, অথবা সেই লক্ষ্যটি এত দ্রুত বদলে যায় যে আমরা হয়ে উঠি উদ্ভ্রান্ত।
সঙ্গী হয় এক গভীর অনিশ্চয়তাও। আমি কি পারলাম যথেষ্ট ফর্সা হতে? মাথার চুলে কি যথেষ্ট ঢেউ উঠল? বা, কতটা পেশিবহুল হলে পর্যাপ্ত পুরুষালি বলে গণ্য হওয়া যায় সমাজে? সদ্য বাজারে-আসা বাইকটা কিনলে কি বাড়বে নিজের যৌন আকর্ষণ? অমুক সুগন্ধিটি কিনলে কি মেয়েরা ঝাঁপিয়ে পড়বে সত্যি, যেমনটা দেখায় বিজ্ঞপনে? এই প্রশ্নগুলির সৃষ্টিকর্তা বাজার। আবার সেই বাজারই উত্তর হিসাবে ছুড়ে দেয় এক বা একাধিক পণ্য। সাময়িক উত্তর মিললেও, প্রশ্নগুলি থেকে যায়। তা না হলে তো বিক্রিই বন্ধ হয়ে যাবে। বস্তুত, উত্তর দেবে বলেই তো বাজার এই প্রশ্নগুলি তৈরি করে।
পুরুষতান্ত্রিক রূপচর্চা ও তার মানদণ্ডের চেহারাটা খানিকটা এ রকমই। যাঁরা এই বাঁধাধরা ছাঁচকে অবজ্ঞা করেন, তাঁরা কম আকর্ষণীয় বা অপ্রীতিকর। সশক্তিকরণের আড়ালে পণ্য-সংস্কৃতি এ ভাবেই নির্মাণ করে এক ধরনের উৎপীড়ন, নিঃসঙ্গতাও। আদর্শ সৌন্দর্যের রূপরেখা তৈরি করে, বাতিল করে দেয় এমন সবাইকে যাঁরা বাজারের বাঁধাধরা ছকে নিজেদের গড়তে অস্বীকার করেন, কিংবা গড়তে পারেন না। পণ্য-সংস্কৃতি বাধ্য করে প্রতিষ্ঠিত সৌন্দর্যের ‘আদর্শ মূর্তি’দের শ্রেষ্ঠ মান্য করে, তাঁদের অন্ধ অনুকরণ করতে— কেনাকাটার মাধ্যমে। পণ্যেরা হীনম্মন্যতায় ভোগায় সবাইকে। আর নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতে ভুগতেই ক্রমে ভোগী হয়ে উঠি আমরা।