অবলুপ্ত সেই সব শিক্ষকের।
সোশ্যাল মিডিয়ার কল্যাণে নিয়মিতই চোখে পড়ে, সত্তর-আশি-নব্বইয়ের দশকে স্কুল পাশ করে বেরোনো মানুষের কাছে শৈশব-কৈশোরের বাংলা মিডিয়াম স্কুল মূলত একটা নস্টালজিয়া। কিন্তু কদাচিৎ-ই সেই স্মৃতিতে স্থান হয় পিরিয়ডের পর পিরিয়ড অতুলনীয় ভাবে পড়িয়ে চলা সেই সব অবলুপ্ত শিক্ষকের, যাঁরা অন্তত আজকের নিরিখে ছিলেন যেন গ্রহান্তরের জীব।
১৯৯০-এর দশকে এক বাংলা মিডিয়াম স্কুলের অষ্টম শ্রেণির ঘরে, গরমের ছুটির অব্যবহিত আগে বাংলার মাস্টারমশাই ঢুকলেন হাতে পঞ্চাশটি শব্দের এক দীর্ঘ তালিকা নিয়ে। বললেন, “এই শব্দগুলোর প্রত্যেকটা দিয়ে একটা করে বাক্য লিখতে হবে, এটাই গরমের ছুটিতে মূল বাড়ির কাজ। কিন্তু বাবাসকল, বাক্যগুলি তোমাদের নিজেদের লিখলে চলবে না, প্রত্যেকটা বাক্যকে একটা করে রবীন্দ্রনাথের গান থেকে নিতে হবে, বুঝলে?” অন্তত কয়েক জন ছাত্র সে বারের গরমের ছুটিতে গীতবিতান ঘেঁটে ঘেঁটে বার করেছিল সেই সব বাক্য, আর সেটা করতে গিয়ে সারা জীবনের মতো বাঁধা পড়েছিল রবিগানের অপ্রমেয় মাধুর্যে।
বাংলা রচনার কোনও এক ক্লাসেই মাস্টারমশাই শুনিয়েছিলেন কবি কালিদাসের সেই শুষ্কং কাষ্ঠং আর নীরস তরুবরের গল্প। বলেছিলেন, কোনও কাঠখোট্টা বিষয়ের উপরে রচনাকেও হতে হবে ‘নীরস তরুবর’, কিন্তু শুষ্কং কাষ্ঠং কদাপি নয়। এমনই এক ক্লাসে শ্রাবণমেঘে আকাশ কালো করে নেমে এসেছিল বৃষ্টি। মাঠের ধারের ক্লাসরুমে বসে ছাত্ররা লেখার চেষ্টা করছিল দুপুরবেলা হঠাৎ আসা বৃষ্টি নিয়ে একটি রচনা। অসাধারণ লিখে ফেলেছে, এই বিশ্বাসে উজ্জ্বল এক কিশোর তার খাতাটি নিয়ে উঠে যায় স্যরের কাছে মঞ্চের উপর। তার পর লাল ফাউন্টেন পেনের আঁচড়ে আঁচড়ে মরীচিকার মতো মেলাতে থাকে তার সেই প্রত্যয়। এমনকি রচনার শিরোনামটি-ও রেহাই পায় না— ‘হঠাৎ বৃষ্টিতে এক দিন’ কথাগুলো নিপুণ দাগ টেনে কেটে, মাস্টারমশাই লিখে দিলেন, ‘শ্রাবণের এক অকালসন্ধ্যা’— “বাবাসকল, যা-ই লেখো না কেন, সাহিত্যগুণ থাকা চাই!”
সেই সব সাদামাটা স্কুলে মাস্টারমশাই পাটিগণিতের বড় বড় অঙ্ক ধরে তার মধ্যে গল্প এনে ফেলতেন। বেশ কিছু শ্রমিক একটা বাড়ি তৈরি করতে শুরু করার কিছু দিন পরে, এক দেশোয়ালি ভাইয়ের মুখে গ্রামে খুব ওলাওঠা হচ্ছে খবর পেয়ে একই গ্রামের জনাদশেক মজুর ফিরে গেলেন, বাড়তি কাজের বোঝা নিয়ে বাকিরা কেমন বিপদে পড়লেন, এই সব গল্পের মধ্যে দিয়েই ঐকিক নিয়মের সূত্রগুলো কখন যেন গেঁথে যেত মাথায়। তেমনই এক মাস্টারমশাই ছাত্রদের বলতেন, “অঙ্ক হচ্ছে ছদ্মবেশী শয়তান, উত্তরটা তার ভিতরেই লুকিয়ে আছে, শুধু খুঁজে নেওয়ার মতো চোখ চাই।” কী রকম সেই চোখ? তার অনুষঙ্গ হিসেবে আসত গণিতবিদ্যার রাজপুত্র কার্ল ফ্রেডেরিক গাউস-এর ছোটবেলার এক গল্প। ক্লাসে গোলমাল পাকানোয় বালক গাউসকে শিক্ষক এক মজার শাস্তি দেন, ১ থেকে ১০০ পর্যন্ত সংখ্যা যোগ করার শাস্তি। অন্তত এক ঘণ্টার শান্তি— কারণ সদ্য যোগ, বিয়োগ, গুণ, ভাগ শেখার বয়সে এতগুলো সংখ্যা যোগ করতে সময় তো লাগবেই। কিন্তু এক মিনিটের মধ্যেই গাউস বলে দিলেন, উত্তর হবে ৫০৫০। কী করে করলে, এ প্রশ্নের উত্তরে বালক গাউস বললেন, তিনি দেখেছেন ১ আর ১০০ যোগ করলে হবে ১০১, তেমনই ২ আর ৯৯-তে ১০১, ৩ আর ৯৮-এর যোগফল-ও ১০১। অতএব, ১ থেকে ১০০-র মধ্যে জোড়ে জোড়ে এ রকম সংখ্যা নিলে, মোট ৫০-টি জোড়া পাওয়া যাবে যাদের প্রত্যেকটার যোগফল ১০১। তাই তিনি ১০১ কে ৫০ দিয়ে গুণ করে দিয়েছেন!
নবম শ্রেণির বার্ষিক পরীক্ষার কয়েক দিন আগে মাস্টারমশাই ক্লাসে ঢুকলেন একটা ফুটবল নিয়ে। ছাত্রদের চোখের সামনেই স্কেচপেন দিয়ে বলটার উপরে এঁকে ফেললেন একটা ত্রিভুজ। তার পর গল্পের ছলে বলে গেলেন, কেন সেই ত্রিভুজের তিনটে কোণের যোগফল ১৮০ ডিগ্রি হবে না। বললেন এক আশ্চর্য শূন্যস্থানের কথা, যেখানে কোনও সরলরেখাই কল্পনা করা যায় না, ঠিক যেমন ফুটবলের গায়েও আসলে টানা যায়নি একটিও সরলরেখা। বোঝালেন, এমনকি আলোরও রেহাই নেই— তাকেও বক্রপথেই যেতে হবে সেই শূন্যস্থানের মধ্যে দিয়ে। মিনিট চল্লিশেকের পিরিয়ডে খুব সহজ করে বুঝিয়ে দিলেন ইউক্লিডীয় শূন্যস্থানের সঙ্গে আইনস্টাইনের স্থান-কালের ধারণার পার্থক্য, ছুঁয়ে গেলেন বৃত্তীয় ত্রিকোণমিতির কিছু মৌলিক উপাত্তকে। আর, অন্তত কিছু ছাত্রের মধ্যে চাগিয়ে দিলেন একটা আগ্রহ— ভবিষ্যতে সর্বোচ্চ স্তরের পদার্থবিদ্যা বা অঙ্ক নিয়ে পড়ার উৎসাহ। আর একটু উঁচু ক্লাসে যখন অঙ্কের এক তরুণ শিক্ষক অসীম শ্রেণি-র অভিসৃতি বোঝানোর সময় গেয়ে উঠতেন ‘সীমার মাঝে অসীম তুমি, বাজাও আপন সুর’, আরও মজবুত হত সেই আগ্রহের বনিয়াদ।
সেই স্কুলের প্রবীণতম ইতিহাসের মাস্টারমশাই-কে অনেকটা ইতিহাসের মতোই দেখতে ছিল— সাদা ধুতি-পাঞ্জাবি, প্রাচীন ও দীর্ঘ কালো একটি ছাতা নিয়ে ক্লাসে আসা মানুষটি অনর্গল রোমিলা থাপার, ইরফান হাবিব বা রণজিৎ গুহর লেখা থেকে উদ্ধৃতি দিতে পারতেন। নবম দশমের সদ্য-কিশোরদের বোঝাতে চাইতেন ইতিহাসবিদদের নৈর্ব্যক্তিক, নিরপেক্ষ, এবং বিশ্লেষণধর্মী দৃষ্টিভঙ্গি কেমন হওয়া উচিত; বোঝাতেন, ইতিহাস মানেই শুধু বিজেতাপক্ষের বা ক্ষমতাসীনদের কল্পগল্প নয়।
ঝাঁকড়া চুল নিয়ে স্কুলে আসার অপরাধে প্রেয়ার লাইনেই যে ছেলেটার মাথার বেশ কয়েকগাছি চুল ছিঁড়ে নিলেন দোর্দণ্ডপ্রতাপ ভূগোল স্যর, ৪-৫ দিন স্কুলে না আসায় তার বাড়িতেই হঠাৎ এক সকালে হাজির হলেন উদ্বিগ্ন সেই শিক্ষক। এক দশক পরে, সেই ছাত্র যখন এক অতিবিখ্যাত সরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞানী, তখন এক দিন রাস্তায় দেখা হল পুরনো সেই স্যরের সঙ্গে। তিনি অবসর নিয়েছেন তত দিনে, কিন্তু পেনশন চালু হয়নি। প্রণাম করার পর বৃদ্ধ মানুষটি খুঁটিনাটি খবর নিলেন, তার পর আধময়লা পাঞ্জাবির ঝুলপকেট থেকে বার করলেন পার্স। কুড়ি টাকার একটা নোট বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, “তোদের এক সময় কত বকুনি দিয়েছি, মারধর করেছি। এইটা রাখ, একটু মিষ্টি কিনে খাস বাবা।” নিঃস্বার্থ ভালবাসার এই মুদ্রাগুলিও কি এঁদের করে তোলেনি বহু জীবনের বাতিঘর?
ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউট, কলকাতা