বহিষ্কার-বিক্ষোভ: কনফেডারেশন অব মেঘালয় সোশ্যাল অর্গানাইজ়েশন-এর প্রতিবাদ বৈঠক। শিলং, ফেব্রুয়ারি ২০২০
মেঘালয় রেসিডেন্ট অ্যাক্ট। ইনার লাইন পারমিট। বাঙালি বিতাড়ন। মেঘালয় রাজ্য নিয়ে আলোচনায় কিন্তু এখনও শোনা যায় না এই শব্দগুলো। অথচ, বাঙালির রোম্যান্টিকতার শিলং আর ‘প্রাচ্যের স্কটল্যান্ড’ নেই। ‘শেষের কবিতা’-র সেই ছোট্ট ঘুমন্ত পাহাড়ি শহর এখন অ-জনজাতি সম্প্রদায়ের ‘বধ্যভূমি’-তে পরিণত। এনআরসি বা সিএএ-র ফলে উত্তর-পূর্বের সব জনজাতি-অধ্যুষিত রাজ্যই বাঙালিদের ভাবে ‘বাংলাদেশি’; খাসি স্টুডেন্টস ইউনিয়ন ও খাসি ভূমিপুত্রদের জাতিগত অসন্তোষের ফলে মেঘালয়ের বাঙালিদের দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গিয়েছে। মেঘালয়ের আদি বাসিন্দাদের ভিটে-মাটি আঁকড়ে থাকতে দেওয়া হচ্ছে না। এই রক্তাক্ত ভূমিতে রাষ্ট্রের আইন-কানুন চলে না। পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি সেই দুর্দশার খবর রাখে কি?
বাঙালি জাতিসত্তা নিয়ে বর্তমান বিরোধিতার সূচনা গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে। বাংলাদেশের লাগোয়া দুটো ছোট জনপদ ইছামতী আর ভোলাগঞ্জে সাত প্রজন্ম ধরে আট হাজারেরও বেশি বাঙালি হিন্দু পরিবারের বাস। বাংলাদেশে চুনা পাথরের রফতানি তাঁদের বংশানুক্রমিক ব্যবসা। নয়া নাগরিকত্ব বিল সংসদে পাশ হওয়ার পর এই জনপদ-সহ কালীবাড়ি, কালাটেক অঞ্চলে বাঙালি বিতাড়ন প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। বিরোধে যোগদান করেছে ফেডারেশন অব খাসি জয়ন্তিয়া অ্যান্ড গারো পিপলস, এবং কয়েকটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। নির্বিকার স্থানীয় প্রশাসন ও রাজ্য সরকার। ত্রাণের ক্ষেত্রে একমাত্র ভরসা রামকৃষ্ণ মিশন, নভেম্বরে খাসি উৎসবের দিনে তাদের গেটেও তালা পড়েছিল। এপ্রিল মাসে বাইরের রাজ্য থেকে পড়তে আসা ৫০০ ছাত্রকে এনআইটি হস্টেল ছেড়ে যেতে বাধ্য করা হয়। লকডাউনের সময়ে ঘেরা মাঠে গেট বন্ধ করে লোহার রড দিয়ে পেটানো হয় বাঙালি ছেলেদের। প্রতিবাদে ফেসবুকে পোস্ট লিখে রোষের মুখে পড়েন সমাজকর্মী প্যাট্রিশিয়া মুখিম। এর পর এক বাঙালি ড্রাইভারকে স্ক্রু-ড্রাইভার দিয়ে খুঁচিয়ে মারা হয়। এ সব নৃশংস ঘটনায় শাস্তি দূরস্থান, প্রতিবাদও হয় না। স্থানীয় কাগজে খবরও নেই।
কেন এক শতাব্দীর সহাবস্থানের পর জাতিসত্তার দোহাই দিয়ে অন্য ভাষাভাষী মানুষদের ‘অনুপ্রবেশকারী’ বলছেন মেঘালয়ের ভূমিপুত্রেরা? এই বিরোধ কি নাগরিকত্ব বা জমির উপর অধিকারের প্রশ্নে? প্রসঙ্গত স্মরণীয় ১৯৭৯-র ‘বঙাল খেদা’ আন্দোলনের দিনগুলি, যদিও ১৯৭২ সালেই মেঘালয় আলাদা রাজ্য হয়ে গিয়েছিল।
শাসনকাজের প্রয়োজনে তৎকালীন অসমের রাজধানী শিলং-এ শিক্ষিত বাঙালিদের উঁচু পদে নিয়োগের প্রথা শুরু করে ব্রিটিশ সরকার। এই গোষ্ঠীই সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতিতে চালিকাশক্তি হয়ে ওঠে। বাঙালি ‘বাবু’/ ‘ভদ্রলোক’ বিরোধিতা মেঘালয়ে নতুন নয়। ১৯৫২ সালে উত্তর-পূর্বাঞ্চল সফরে নেহরু তা অনুভব করেন। কিন্তু এই সঙ্কটকে তিনি দুই সম্প্রদায়ের জমি, চাকরি সংক্রান্ত বিবাদ হিসেবে দেখেন। পরে তা ভুল প্রমাণিত হয়। ১৯৬০ ও ১৯৭২ সালে অফিস বা উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে বাংলা ভাষার অনুপস্থিতি নিয়ে অসম সরকারের সঙ্গে বাঙালি সংগঠনগুলোর বিরোধ বাধে। তখনও বাঙালিদের বিরুদ্ধে গর্জে ওঠে জনজাতিগুলি। ১৯৭৯-র আন্দোলনের পর এই বিরোধিতার চরিত্র পাল্টায়, বদলাতে থাকে ‘বহিরাগত’ শব্দের সংজ্ঞাও। এর মধ্যে আগে যে দেশান্তর ও নাগরিকত্বের ধারণা ছিল, তার জায়গা নেয় জাতিসত্তা। বাঙালি মানেই ‘বহিরাগত’— এই ধারণার উৎপত্তি তখনই।
১৯৭৯-তে বাঙালি-খাসি বিরোধিতার প্রত্যক্ষদর্শী দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজতত্ত্বের শিক্ষক নবনীপা ভট্টাচার্য। তিনি এর তুলনা টেনেছেন নাৎসি বীভৎসতা ‘লেবেনসরাউম’-এর সঙ্গে, যেখানে লক্ষ্য ছিল মিশ্র জনজাতি অধ্যুষিত অঞ্চলগুলি। অ-জনজাতি গোষ্ঠীগুলি সরকারের কাছে আবেদন করে সহায়তা চেয়ে, স্মারকলিপি জমা দেয়, কিন্তু কাজ হয় না। শিলং টাইমস উপন্যাস সংক্রান্ত এক আলোচনায় লেখক নীলাঞ্জন চৌধুরী জানিয়েছিলেন, ১৯৭৯-তে কী ভাবে তাঁদের শিলং-এর বাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয়। শিলং-এ বড় হওয়া শিক্ষক সজল নাগ বলেন, ছোটবেলায় খাসি জনজাতির মানুষেরা ছিল গল্পের জুজু বুড়ির মতো। দুষ্টুমি করলে বড়রা বলতেন, খাসিরা ধরে নিয়ে যাবে। বাইরে বেরোলে অনুশাসন ছিল, কোন জায়গা পর্যন্ত যাওয়া যাবে। বাইরে যাওয়া বারণ ছিল খাসি উৎসবের দিনে।
১৯৭৯-র দাঙ্গায়, দুর্গাপুজোর সময়ে ৩৪ জন বাঙালিকে হত্যা করা হয়। ডাউকিগামী বাসে হত্যা করা হয় ১১ জনকে। ১৯৮৭ এবং ১৯৯২ সালে লক্ষ্য হন নেপালি ও বিহারিরা, আঁচ এড়াতে পারেননি বাঙালিরাও। ১৯৯২-এ এক বাঙালি গর্ভবতী মহিলাকে বাড়ি থেকে বার করে স্বামী-সন্তানের সামনে গণধর্ষণ করা হয়, যৌনাঙ্গে বাঁশ ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। প্রতিবাদ হয় না, বিচারের প্রশ্নই নেই! পুজোয় এক মহিলাকে পেট্রল বোমা মেরে খুন করা হয়। গুয়াহাটি থেকে শিলং-এর রাস্তায় মারোয়াড়ি ব্যবসায়ীকে গাড়ির ভিতর জ্যান্ত পুড়িয়ে মারা হয়। এর পর যাঁদের সাধ্য বা যোগাযোগ আছে, তাঁরা মেঘালয় ত্যাগ করেন। কিন্তু অ-জনজাতিদের হত্যা করা হলেও কেন্দ্রীয় বা রাজ্য সরকারের তরফে বিচারের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি, যা ১৯৮৪ শিখবিরোধী দাঙ্গা বা ২০০২ গুজরাত দাঙ্গার সময়ে বা কাশ্মীরি পণ্ডিতদের জন্যে হয়েছিল।
একুশ শতকে মেঘালয়ে বাঙালিদের ‘ডখার’ (বিদেশি) তকমা দেওয়া হয়েছে। ৮০ শতাংশ সরকারি চাকরির উপর জনজাতির অধিকার। যে ২০ শতাংশ চাকরি অ-জনজাতি সম্প্রদায় পেতে পারেন, আসলে তার ১ শতাংশও তাঁরা পান না। ষষ্ঠ তফসিলের নিয়ম অনুসারে মেঘালয়ের অধিকাংশ জায়গায় অ-জনজাতিরা জমি, বাড়ি কিনতে পারেন না। পুরনো, অভিজাত, শিক্ষিত বাঙালি পরিবারের অর্ধেকই অন্য রাজ্যে বা বিদেশে পাড়ি দিয়েছেন। এক সময় বাঙালি-অধ্যুষিত লাবান অঞ্চলে এখন ৫০টি পরিবারও নেই। নয়া নাগরিকত্ব বিল আসার পরেই অরুণাচলপ্রদেশ, নাগাল্যান্ড ও মিজোরামের আদলে মেঘালয়তেও ইনার লাইন পারমিট চালু করার জন্য চাপ বেড়েছে। প্যাট্রিশিয়া মুখিমের মতো নিরপেক্ষ স্বরকে স্তব্ধ করার চেষ্টা চলছে। হাই কোর্টের বিচারপতিও রায় দেওয়ার ক্ষেত্রে অনেক সময় জাতিসত্তার ঊর্ধ্বে উঠতে পারছেন না।
শেষ ঘটনা এই ফেব্রুয়ারির। সরকারি অনুমতি নিয়ে ৮ জন মুসলমান বাঙালি শ্রমিককে অসম থেকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল দক্ষিণ-পশ্চিম খাসি হিল সংলগ্ন সেন্ট জ়েভিয়ার্স কলেজে, নির্মাণকাজের জন্য। কলেজ ক্যাম্পাসে তাঁদের ঘরে ঢুকে, ধারালো অস্ত্র দিয়ে ঘুমন্ত সেই শ্রমিকদের মধ্যে খুন করা হয় এক জনকে, সাত জন গুরুতর জখম হন। ঐতিহ্য মেনে প্রশাসন নির্বিকার। ক্ষতিপূরণও দেওয়া হয়নি গরিব মানুষগুলোকে। বরং বলা হয়েছে, কেন্দ্রীয় সরকার প্রস্তাবিত ট্রেন লাইন ঢুকতে দেওয়া হবে না, যাতে ‘বিদেশি’ বাঙালি শ্রমিক ঢুকতে না পারে।
মেঘালয় মাতৃতান্ত্রিক। খাসি পুরুষরা তেমন কাজ করেন না, রাজ্যে আয়কর জমা করেন অ-উপজাতিরাই। কিন্তু তাঁদেরকে আক্রমণ করা হচ্ছে, সব ক্ষেত্রে তাঁরা ব্রাত্য। মেঘালয়ের প্রাক্তন মন্ত্রী পল লিংডো এক বার বলেছিলেন, খাসিরা সাম্প্রদায়িক নন। মেঘালয়ে কখনও ‘নেলি’-র মতো হত্যাকাণ্ড হয়নি। ‘নেলি’-তে এক সঙ্গে হত্যা করা হয়েছিল ২০০০-এর বেশি বাঙালিকে। কিন্তু ১৯৭৯ থেকে বর্তমান সময়ে মেঘালয়ে হত্যা করা হয়েছে আরও অনেক বেশি মানুষকে। প্রত্যেক মাসেই কিছু ঘটনা ঘটে, কেন্দ্রীয় সরকার সব জেনেশুনে নির্বিকার। মেঘালয়ের মুখ্যমন্ত্রীর কাছে জবাবদিহি চাইছেন না। মিডিয়াতেও কোনও খবর নেই।
সমস্যাটা আসলে কী? ১৯৬০ ও ১৯৭৯ সালের আক্রমণে দুই মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায় ও জ্যোতি বসু বাঙালিদের পাশে দাঁড়ান। ১৯৬০-এর দশকে অসমে মারোয়াড়িদের পক্ষে সরব হন রাজস্থানের মুখ্যমন্ত্রী মোহনলাল সুখাড়িয়া। ১৯৯২ সালে মেঘালয়ে বিহারিদের উপর আক্রমণের পর বিহারের মুখ্যমন্ত্রী লালুপ্রসাদ যাদব তাঁদের পাশে দাঁড়ান। শিলং-এর ৪০-৫০টি পঞ্জাবি পরিবারের জন্য পঞ্জাব থেকে ছুটে এসেছিলেন মন্ত্রী-বিধায়কেরা। কিন্তু এখন উত্তর-পূর্বে বাঙালিদের রাজনৈতিক শক্তি নেই, বাইরে থেকে সমর্থনেরও কেউ নেই। আশ্চর্যের বিষয়, যে হিন্দু বাঙালির সুরক্ষার প্রশ্নে নাকি নয়া নাগরিকত্ব আইন আনা হয়েছে, বিজেপি সরকার বা কোনও হিন্দুত্ববাদী সংগঠন সেই মানুষগুলোর সমর্থনে নেই। গত বছর মেঘালয়ের রাজ্যপাল তথাগত রায় অবশ্য মন্তব্য করেছিলেন যে, মেঘালয়ে বাঙালিদের অবস্থা কাশ্মীরি পণ্ডিতদের থেকেও খারাপ। কিন্তু জোরজুলুম বাড়লে যে প্রতি বারের মতো তাঁরা আবার পশ্চিমবঙ্গমুখী হবেন, সেটা কেউ বলছেন না!
বাঙালিদের মেরে বলা হচ্ছে, এরা ‘বাংলাদেশি’। যদি তা সত্যিও হয়, তা হলেও এঁদের হত্যার অধিকার কি কারও আছে? একবিংশ শতকে পৃথিবী যখন ‘হিউম্যান রাইটস’ নিয়ে সরব, মেঘালয়ের হতভাগ্য বাঙালিদের কণ্ঠস্বর দিল্লি দরবারে পৌঁছয় না? তাঁদের ‘মন কি বাত’ নিয়ে কারও মাথা-ব্যথা নেই?
উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলো যখন গঠিত হচ্ছিল, একমাত্র মেঘালয়ের ক্ষেত্রেই জাতিসত্তার ঊর্ধ্বে গুরুত্ব পেয়েছিল স্থানিক পরিচয়। আর এখন চলছে তাকে ‘খাসিল্যান্ড’ বলে তুলে ধরার চেষ্টা।
ইতিহাস বিভাগ, ডায়মন্ড হারবার মহিলা বিশ্ববিদ্যালয়