দৃশ্য: গাঁধীজির ডান্ডি অভিযান বিষয়ক প্রদর্শনীতে নরেন্দ্র মোদী। আমদাবাদ, মার্চ ২০২১। পিটিআই
আজকাল ভোটের খবর রাখতে গিয়ে অন্য নানা খবরে মন দেওয়া হচ্ছে না। এ দিকে এরই মধ্যে প্রধানমন্ত্রী মোদী ভারতের স্বাধীনতার পঁচাত্তর বছর পূর্তি-উৎসব আয়োজনের কথা জানালেন। বললেন, ২০২২-এর এক বছর আগে থেকেই শুরু হবে ‘অমৃত মহোৎসব’। তাতে স্বাধীনতা সংগ্রামের ‘স্পিরিট’-এর কথা মনে করা হবে, আর যাঁরা সেই সংগ্রামে আত্মত্যাগ করেছিলেন, তাঁদের স্মরণ করা হবে। পাঁচটি স্তম্ভে ভাগ হবে সেই অনুষ্ঠান, যার মধ্য দিয়ে তুলে ধরা হবে সনাতন ভারতীয় ধারা আর আধুনিক ভারতের গৌরবের মিশেল।
কে জানে কেন, শুনতে শুনতে মনে হচ্ছিল, এ যেন ভারতের কথা নয়, এ যেন তাঁর দলের প্রচার, তাঁর সরকারের প্রচার। ভোটের বাজারেই যে এই ঘোষণা, তারও হয়তো একটা মানে আছে, কেননা যদি এক বছর ধরে অনুষ্ঠান চলতে চলতে পঁচাত্তরতম বছরটিতে পৌঁছোনো হয়, তা হলেও হাতে আছে অগস্ট অবধি পাঁচ মাসের বেশি। তার মধ্যেই যে তাড়াহুড়ো করে ঘোষণা এসে গেল, তাতে মনে হয় নেতাজির ১২৪তম জন্মদিনটি নিয়ে হইচই-এর পরেই এই পরবর্তী ‘লক্ষ্য’ জরুরি হয়ে পড়েছিল।
তবে এক দিক দিয়ে সেটা স্বাভাবিক। নরেন্দ্র মোদীর অমৃত উৎসব-এ সত্যিকারের ভারতের গৌরব উদ্যাপন হওয়ার কথাও ছিল না। ভারত নামে যে রাষ্ট্রটির জন্ম হয়েছিল ১৯৪৭ সালে, তার আদর্শ, কৃতিত্ব, প্রতিশ্রুতি সবই তো ছিল তাঁদের মানসপৃথিবী থেকে অনেক দূরবর্তী। যে সব নীতির উপর দাঁড়িয়ে এ দেশ নিজেকে নির্মাণ করেছিল, তাঁরা তো সযত্নে সেগুলোকে উল্টে-পাল্টে ভেঙে দিয়েছেন। তা হলে উদ্যাপন করাটা হবে কার এবং কিসের। যতই হম্বিতম্বি করুন তাঁরা, তথ্যপ্রমাণ পাল্টে ফেলে, ধ্বংস করে, ইতিহাসটা আবার নতুন করে না লেখা পর্যন্ত আমরা জানি, বিজেপির পূর্বসূরিরা কতটাই প্রান্তিক ছিলেন স্বাধীনতার দীর্ঘ সংগ্রামে। সাভারকরের মতো হিন্দুত্ববাদী নেতারা দেশের স্বার্থের উপরে রেখেছিলেন নিজের ও দলের স্বার্থকে, ঠিক যেমন করেছিলেন কট্টর মুসলিম নেতারা। বাস্তবিক, ভারত নামক দেশটাকে পঙ্গু হয়ে জন্মাতে হয়েছিল এই ধর্মভিত্তিক রাজনীতির ঘায়ে, আর জন্মমুহূর্তেই তাকে ঘোর অসুখ বলে মেনে নিতে হয়েছিল। আজ সেই ধর্মরাজনীতিরই ধারক বাহক প্রচারক আমাদের প্রধানমন্ত্রী: ১৯৪৭-এর ভারতকে তিনি উদ্যাপন করবেনই বা কী করে। তিনি তাই ভারত কী ছিল, তার উদ্যাপন করবেন না, তাঁরা ভারতকে কী ভাবে পাল্টাচ্ছেন, তার উৎসব করবেন।
পাঁচটি কর্মধারার কথা বলেছেন মোদী, যেগুলো থেকে তাই কিছুই বোঝা যায় না সেই সাতচল্লিশের ভারতকে। অথচ সত্যিই যদি পঁচাত্তর বছর ‘পঞ্চশীল’ আমাদের ভাবতে হত, সেই আদর্শ বা নীতিগুলিকে উদ্যাপন করতে হত, যেগুলি আজকের ভারত-শাসকরা মুছে দিতে কোমর বেঁধে নেমেছেন। সেই পাঁচটি আদর্শ: গণতন্ত্র, উদারতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, উন্নয়নের সাম্য ও সামাজিক ন্যায়। এবং— জাতীয়তা। হ্যাঁ, জাতীয়তা। আজকে এই শব্দটির একমাত্রিক ব্যবহারে অভ্যস্ত হয়ে-ওঠা আমরা নিশ্চয় ভুলে যাচ্ছি যে, এই হিন্দুত্ববাদী রাজনীতিকরাই ‘জাতীয়তা’র একমাত্র ঠেকা নেননি, জাতীয়তা-র উপর ভিত্তি করেই দেশ স্বাধীন হয়েছিল, কেবল সেটা ছিল অন্য জাতীয়তা, তার আদর্শ-উদ্দেশ্য ছিল অন্য, তার ভাষা ও ভাব ছিল ভিন্ন।
লক্ষণীয়, পাঁচটি আদর্শই কেমন পরস্পরের উপর নির্ভরশীল। নতুন দেশ ভারতের নির্মাতারা খেয়াল করেছিলেন যে গণতন্ত্র তখনই ঠিক ভাবে কাজ করে, যখন তার মধ্যে ‘লিবারাল’ ভাবটি রক্ষা করা যায়, নয়তো তা পরিণত হয় সংখ্যাগুরুবাদে, অর্থাৎ যার সংখ্যা বেশি তার জোর বেশি, এই জবরদস্তির মধ্যে। উদারতন্ত্র এই বিপদটাকেই আটকানোর অস্ত্র— যার জোর কম, তাকেও সমান সম্মান ও পরিসর দেওয়ার নীতি। এই জন্যই এর্দোয়ানের তুরস্ক বা পুতিনের রাশিয়া পদ্ধতিতে গণতান্ত্রিক হয়েও সত্যিকারের গণতন্ত্র হয়ে উঠতে পারে না।
প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর একটা বিতর্কিত কাজের কথা এই প্রসঙ্গে মনে করা যাক। বাক্স্বাধীনতার অধিকার রক্ষা গুরুতর জেনেও তিনি বাক্স্বাধীনতার সীমা-বিষয়ক সংবিধান সংশোধন বা ‘ফার্স্ট অ্যামেন্ডমেন্ট’-এর পক্ষে সওয়াল করেছিলেন, যা পাশ হয়েছিল ১৯৫১ সালে। তাঁর ও তাঁদের মনে হয়েছিল, বিদ্বেষ বা ঘৃণার উচ্চারণ শেষ পর্যন্ত স্বাধীনতার পরিবেশ নষ্ট করতে পারে। সদ্য-স্বাধীন দেশ ভোলেনি, কী হতে পারে হিংসাত্মক প্রচারের ফলাফল। প্রসঙ্গত, ঠিক একই ভাবে বাক্স্বাধীনতার সঙ্গে বিদ্বেষের স্বাধীনতার ফারাক করতে হয়েছিল আমেরিকাকেও। গণতন্ত্রের উল্টো কামড় থেকে গণতন্ত্রকে রক্ষা করাটা জরুরি, গণতান্ত্রিক দেশের স্থপতিরা সেটা ভেবেছিলেন, কেননা তাঁরা একটা সর্বজনের হিতের প্রকল্পে উদারতাকে প্রয়োগ করতে চাইছিলেন। ‘অভিমুখ’টা গুরুতর। এবং সেই অভিমুখটা নৈতিক। তাই, স্বাধীনতার সীমা তৈরির বিপদ আছে জেনেও তখনকার পরিস্থিতিতে কাজটা গুরুতর ছিল। ভারত নামে দেশটির নৈতিক অভিমুখ দেখিয়ে দেয় এই কঠিন সিদ্ধান্ত।
ধর্মনিরপেক্ষতাকেও এ ভাবেই দেখা সম্ভব। একে ছাড়া গণতন্ত্র সম্পূর্ণ হতে পারে না। ভারতের জন্মের সময় নেহরু, অম্বেডকরদের মত ছিল, ‘কমপোজ়িট কালচার’ (বহুত্ববাদ) এবং ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ ছাড়া ভারতভূমির প্রতিটি অধিবাসীর নিরাপত্তা ও অধিকার নিশ্চিত করা যাবে না। দেশে বসবাসকারী মানুষ (‘টেরিটোরিয়ালিটি’ বা ভূমি-পরিচিতির সূত্রে) নাগরিক অধিকারে মণ্ডিত হবেন, সেটাই হবে গণতন্ত্র। অর্থাৎ ধর্মনিরপেক্ষতা নেই, কিন্তু গণতন্ত্র আছে— এমন কোনও অভিমুখে ভারত মোটেই হাঁটবে না। আজকের সিএএ-দর্পিত, সংখ্যালঘুবিদ্বেষী রাষ্ট্র, যেখানে মুসলিম বালককে হিন্দু মন্দির থেকে জল খেলে পিটিয়ে মারা হয়, আর নির্যাতনকারীর পক্ষে দাঁড়ায় শাসক— তাকে দেখলে পুরনো ভারতের প্রতিষ্ঠাতারা এক কথায় বলতেন, সাতচল্লিশ-জাতক দেশ আর আজকের দেশ এক নয়, এদের জেনেটিক গঠনই আলাদা।
ধর্মনিরপেক্ষ মানে কি সব ধর্ম থেকে সমান দূরত্ব? বিষয়টা একটু জটিল। নেহরু বলেছিলেন, সেকুলার শব্দটা কত বিভিন্ন অর্থে বিভিন্ন সংস্কৃতিতে ব্যবহার হয়। পশ্চিমের বহু দেশেই এর মানে ধর্মের বিরুদ্ধতা। ভারতের ক্ষেত্রে, এর অর্থ সব ধর্মকে সমান ভাবে দেখা। পরবর্তী কালে বিশ্লেষকরা বলেন, নেহরুও স্পষ্ট ব্যাখ্যা করে যাননি। আসলে সব ধর্মকে সমান জায়গায় আনার জন্য কখনও কখনও এগিয়ে-থাকা ধর্মসমাজ আর পিছিয়ে-থাকা ধর্মসমাজকে একটু আলাদা করে দেখতে হয়, ভারতীয় রাষ্ট্র সেটাই বিশ্বাস করে এসেছে। সমাজতাত্ত্বিক ক্রিস্তোফ জাফ্রেলো-র ভাষায়, ভারত ধর্মের ক্ষেত্রে ‘ইকুই-ডিসট্যান্স’-এর বদলে ‘প্রিন্সিপলড ডিসট্যান্স’ মেনে চলে। অর্থাৎ, নৈতিকতার একটা মানদণ্ড তৈরি, এবং তার ভিত্তিতে বিভিন্ন গোষ্ঠীর সঙ্গে বিভিন্ন বোঝাপড়া— এটাই তার অভীষ্ট। তাই হিন্দু পার্সোনাল ল’ না থাকলেও মুসলিমদের শরিয়তি আইন থাকে, এটা আজকের শাসকদের চোখে সংখ্যালঘু তোষণ হলেও সে দিনের ভারতের চোখে সঙ্গত ছিল সামাজিক ন্যায়ের নিরিখে। অবশ্যই এই বিবেচনার ভিত্তি ছিল এক গভীর নৈতিকতাবোধ। এমন একটা নৈতিকতা ছাড়া— ধর্ম কেন, কোনও বিষয়েই নিরপেক্ষতা সম্ভব নয়, গণতান্ত্রিক নিরপেক্ষতাও নয়। এটাই ছিল স্বাধীন পাকিস্তান ও স্বাধীন ভারতের প্রথম পার্থক্য, ভারতের প্রধান নৈতিক ভিত্তিভূমি। ইন্দিরা গাঁধীর সময়ে ‘সেকুলার’ শব্দটি সংবিধানে ঢোকে বলে যাঁরা গাল দেন, তাঁদের মনে রাখতে হবে, ১৯৪৭-এ জন্মলগ্ন ও ১৯৫০-এর সংবিধান-লগ্নের বহু প্রতিজ্ঞা ও অনুজ্ঞায় ধরা ছিল এই একটি মৌলিক নীতি: ধর্মনিরপেক্ষতা। এ কোনও নতুন সংযোজন নয়, ভারতের সবচেয়ে প্রথম আয়োজন।
অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও সংরক্ষণ নীতির ক্ষেত্রেও একই যুক্তি। সাম্য এবং সামাজিক ন্যায়ের অভিমুখটিকে বাদ দিয়ে দিলে এই দুইয়েরই কোনও অর্থ থাকে না এ দেশে। জাতগোষ্ঠীতে দীর্ণবিদীর্ণ দেশ যথার্থ ভাবে গণতান্ত্রিক হতে চাইছিল বলেই অম্বেডকরের নেতৃত্বে ভারত সংরক্ষণ নীতি চালু করেছিল। এবং সাম্যের যুক্তিতে দারিদ্র দূরীকরণ ও অর্থনৈতিক সুযোগ নির্মাণের কার্যক্রম তৈরি করেছিল। পরবর্তী কালে একেই যোগ করা হল সংবিধানে, বলা হল সমাজতন্ত্রের লক্ষ্য। সমাজতন্ত্র শব্দটি নিয়ে যাঁদের আপত্তি, তাঁরাও হয়তো মানবেন, একেবারে গোড়ায় সংবিধানে প্রতিশ্রুত সাম্যের নীতিটি কিন্তু ছিল উদার, বৃহৎ এবং গভীর, যে নামেই তাকে ডাকা হোক না কেন। সেই ভারতে আজ যদি দলিতকে কথায় কথায় নির্যাতন করা হয়, দরিদ্রকে বঞ্চনা করে ধনবানের হাতে আরও ধন ও ধনের সুযোগ জড়ো করার ব্যবস্থা হয়, তবে এত ঘটা করে সাতচল্লিশের ভারতকে উদ্যাপন না করলেই চলে।
আর, এই সব আদর্শ এক সঙ্গে মিলেমিশেই সে দিন তৈরি হয়েছিল ভারতের ‘জাতীয়তা’। আজকের শাসকরা বোঝাতে চান, জাতীয়তা বস্তুটির ধারক-বাহক কেবল তাঁরাই। তাঁদের মতের সঙ্গে এ-দিক ও-দিক অমিল হলেই সেটা অ্যান্টি-ন্যাশনাল। জাতীয়তাবাদের নামে এর চেয়ে বেশি অনাচার আর কিছু হতে পারে না। পঁচাত্তর বছর পূর্তির আগে আমরা যেন মনে করি, ভারতের জন্মের সময়ে কিন্তু জাতীয়তাবাদকে ভাবা হচ্ছিল সম্পূর্ণ অন্য ভাবে, তার আদর্শ ও উদ্দেশ্য ছিল এ-দিক ও-দিক সকলকে নিয়ে চলা। জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে ‘জনগণমন’ গানটির নির্বাচন ‘ভুল করে’ হয়ে যায়নি— হিন্দু-বৌদ্ধ-শিখ-জৈন-পারসিক-মুসলমান-খৃস্টানী সকলের কথা অকারণে বন্দিত হয়নি।
রমিলা থাপর লিখেছেন, “ফর ইন্ডিয়ানস অব মাই এজ, হু গ্রু আপ ইন দ্য কাস্প অব ইনডিপেন্ডেন্স, ন্যাশনালিজ়ম ওয়াজ় ইন দি এয়ার উই ব্রিদড্” (অন ন্যাশনালিজ়ম)। তাঁদের সেই ন্যাশনালিজ়ম-এর উল্টো দিকে ছিল কমিউনালিজ়ম, যা কিনা সর্বতো পরিত্যাজ্য। ভারতভূমিকে যাঁরা ‘শেয়ার’ করেন, আগে-পরে-এখন-তখন যখনই আসুন না কেন তাঁরা, সেই ভূমির জন্য তাঁদের দায়দায়িত্ব বোধ, আবেগ-উদ্দীপনার নামই ছিল জাতীয়তাবাদ।
অথচ আজ, এর উল্টো দিকে যাঁরা, তাঁরাই নাকি ন্যাশনাল। পঁচাত্তর বছরের উৎসব সোজাসুজি এই কথাটা দিয়েই শুরু হওয়া দরকার।
তাই ভোটঋতুতেও অন্য খবরে কান পাতা চাই!