Migrant Workers

কার কত ক্ষতি, কতটা পূরণ

২০১১ সালের জনগণনায় পশ্চিমবঙ্গের পরিযায়ী শ্রমিকের সংখ্যা ছিল ছ’লক্ষ, অসরকারি মতে এখন ওই সংখ্যা হবে সত্তর লক্ষ থেকে এক কোটি।

Advertisement

নব দত্ত

শেষ আপডেট: ০১ নভেম্বর ২০২৩ ০৫:২৮
Share:

প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।

পরিযায়ী শ্রমিকদের পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ‘কর্মসাথী’ প্রকল্পে এখনও পর্যন্ত প্রায় চোদ্দো লক্ষ আবেদন জমা পড়েছে। নভেম্বরের গোড়ায় তালিকা যাচাইয়ের কাজ শুরু হবে। এখনও পর্যন্ত তেত্রিশ হাজার শ্রমিক নথিভুক্ত হয়েছেন। গত তিন মাসে মৃত্যুজনিত সহায়তা দেওয়া হয়েছে প্রায় পঁচাশি জনের ক্ষেত্রে। এঁদের মধ্যে রয়েছেন অগস্টে মিজ়োরামে রেলওয়ে ব্রিজ ভেঙে নিহত তেইশ জন শ্রমিক, যাঁরা মালদহের বাসিন্দা।

Advertisement

পশ্চিমবঙ্গের প্রায় প্রতিটি জেলা থেকে অন্যান্য রাজ্যে কাজের খোঁজে যাচ্ছেন মানুষ। মালদহ, মুর্শিদাবাদ, কোচবিহার, বীরভূম, হাওড়া থেকে ভিন রাজ্যে কাজ করতে যাওয়া শ্রমিকের সংখ্যা বেশি। বেঙ্গালুরু শহরে বর্জ্য আলাদা করার কাজ করেন চোদ্দো হাজার শ্রমিক, যাঁদের অধিকাংশই বাংলার। কাশ্মীরে রয়েছেন রাজ্যের প্রায় তিন হাজার শ্রমিক। কত বাঙালি মেয়ে গৃহশ্রমিকের কাজ করতে অন্য শহরের যান, সেই সংখ্যাটা এখনও স্পষ্ট নয়। মরসুমি কৃষি কাজে বাংলার দক্ষ চাষিদের কদর আছে। গয়না শিল্পে সোনা-রুপোর কাজ, জরির কাজ করতে দক্ষ কারিগরেরা যেমন যাচ্ছেন, তেমনই যাচ্ছেন সাফাই, নির্মাণের অদক্ষ কাজে। উত্তরপ্রদেশের বিদ্যুৎ শিল্পে বাংলার বহু শ্রমিক আছেন। সম্প্রতি দেখছি, ডুয়ার্সের চা বাগানের কর্মীরা বেশি মজুরির টানে ভুটানের কারখানায় যাচ্ছেন।

২০১১ সালের জনগণনায় পশ্চিমবঙ্গের পরিযায়ী শ্রমিকের সংখ্যা ছিল ছ’লক্ষ, অসরকারি মতে এখন ওই সংখ্যা হবে সত্তর লক্ষ থেকে এক কোটি। তেমনই, ওই জনগণনায় ভারতে পরিযায়ী শ্রমিক ছিল সাড়ে তিন কোটি। কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়নের দাবি, সংখ্যাটা পনেরো কোটি। এ থেকে আন্দাজ হয়, পরিযায়ী শ্রমিকদের প্রকৃত পরিস্থিতি আন্দাজ করার কাজের সূচনা হয়েছে মাত্র। সেখানেও সমস্যা এই যে, শ্রমিকদের সম্পর্কে আহরিত বিভিন্ন তথ্যের মধ্যে সমন্বয়ের কোনও উদ্যোগ করা হয়নি। যেমন, কেন্দ্রীয় সংস্থার (এনএসএসও) সমীক্ষা অনুসারে ভারতে নথিবদ্ধ নির্মাণ-শ্রমিক আছেন পাঁচ কোটি। কিন্তু এঁদের মধ্যে কত জন অন্য রাজ্যে কাজ করছেন, তা বোঝার উপায় নেই।

Advertisement

পশ্চিমবঙ্গে পরিযায়ী শ্রমিকের নথিভুক্তি চলছে, যাতে তাঁরা সরকারি অনুদান পেতে পারেন। কিন্তু শ্রমিকদের অধিকারের সুরক্ষার জন্য ঠিকাদারদের নথিভুক্তিই বেশি জরুরি ছিল না কি? আন্তঃরাজ্য পরিযায়ী শ্রমিকদের জন্য আইনে বলা হয়েছে, নির্ধারিত মজুরি, অন্য রাজ্যে কাজ করার জন্য ভাতা, বাড়িতে যাতায়াতের ভাতা, কর্মক্ষেত্রে বাসস্থান, নিখরচায় চিকিৎসা, চুক্তি শেষে সমস্ত প্রাপ্য মিটিয়ে দেওয়া, এই সবই ঠিকাদারের দায়িত্ব। প্রত্যেক শ্রমিককে ছবি-সহ পাসবই দেবেন ঠিকাদার, সেখানে উল্লেখ থাকবে, কোথায়, কবে থেকে কাজ করছে ওই শ্রমিক, কত মজুরি প্রাপ্য হচ্ছে, ইত্যাদি।

এই আইন ঠিকাদার ও নিয়োগকর্তার উপরে নজরদারির ভূমিকা দিয়েছে সরকারকে। নির্দিষ্ট দায়িত্ব পালন না করলে ঠিকাদারের বিরুদ্ধে বিধিসম্মত ব্যবস্থা করার কথা সরকারের। বাস্তবে কিন্তু ঠিকাদার ও নিয়োগকর্তারা শ্রমিকের প্রাপ্য মজুরি, বা দুর্ঘটনা, মৃত্যুজনিত ক্ষতিপূরণ দেওয়ার দায় এড়ালে তাঁদের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থাই করে না সরকার। আইন ফাঁকি দেওয়ার জন্য শাস্তি হয় না কারও। উল্টে ভিন রাজ্যে শ্রমিক আহত বা নিহত হলে ক্ষতিপূরণের অঙ্গীকার করেছে সরকার। এতে আখেরে কার স্বার্থ সুরক্ষিত হল? যে টাকা শিল্পপতি এবং ঠিকাদারদের দেওয়ার কথা, তা কেন করদাতা দেবেন? লক্ষণীয়, রাজ্য সরকার ‘কর্মসাথী’ প্রকল্প করে ক্ষতিপূরণের দায় গ্রহণ করেছে, কিন্তু ন্যায্য মজুরি ও অন্যান্য অধিকার বিষয়ে পরিযায়ী শ্রমিক-কল্যাণ পর্ষদ কোনও ঘোষণাই করেনি।

আক্ষেপ এই যে, বিরোধীরা এই প্রশ্নগুলি তোলেন না। তাঁরা কেবলমাত্র অভিযোগ তোলেন যে, ঘরে কাজ নেই, তাই রাজ্য থেকে বিপুল পরিমাণে শ্রমিক নিরাপত্তা ছাড়াই কাজ করতে গিয়ে মারা যাচ্ছেন। অস্বীকার করার উপায় নেই যে, রাজ্যে কাজের অভাব রয়েছে। একশো দিনের কাজও বন্ধ। কিন্তু শুধুমাত্র রাজ্যের আর্থিক দুরবস্থার জন্যই শ্রমিক ভিন রাজ্যে যাচ্ছেন, এমন বলা চলে না। পণ্য, পুঁজি ও শ্রম, এই তিনের অবাধ চলাচল হয় চাহিদা ও জোগানের তত্ত্ব মেনেই। কেবল আর্থিক পশ্চাৎপদতার জন্য নয়। পরিযাণের ফলে দক্ষ, অর্ধদক্ষ ও অদক্ষ শ্রমিকদের মধ্যে কাজের সঠিক বণ্টন হয়, পরিযায়ীর পাঠানো অর্থে পারিবারিক আয় বাড়ে। নীতি আয়োগ বলেছে, পরিযাণ উন্নয়নের অবিচ্ছেদ্য অংশ, সরকার কখনও কাজের জন্য শ্রমিকের অন্যত্র যাত্রার বিরোধিতা করবে না, বরং তাকে উৎসাহিত করবে।

সংবিধানে শ্রম যৌথ তালিকাভুক্ত, যার সুযোগ নিয়ে ঊনত্রিশটি শ্রম আইনের বদলে চারটি লেবার কোড তৈরি করল কেন্দ্রীয় সরকার, এবং সারা দেশে কাজের সর্বনিম্ন মজুরি বেঁধে দিল। অথচ পরিযায়ী শ্রমিকদের দায়িত্ব রয়ে গেল কেবল রাজ্যগুলির উপরে— যে রাজ্য থেকে শ্রমিক আসছেন, এবং যেখানে কাজ করছেন। এই দু’টি রাজ্যের সরকার যদি শ্রমিকের মজুরি, বাসস্থান, রেশন, চিকিৎসা, ক্ষতিপূরণ প্রভৃতি প্রাপ্য নিশ্চিত করতে না পারে, তা হলে কেন্দ্রীয় সরকার দায়িত্ব নেবে না কেন? ‘এক দেশ, এক পরিবার, এক ভবিষ্যৎ’— এই আদর্শ কি পরিযায়ী শ্রমিকদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়?

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement