পরিযায়ী শ্রমিকদের সঙ্কটের কেন্দ্রে রয়েছে মজুরি হ্রাস। ফাইল চিত্র।
ওড়িশার লিঙ্গরাজ শেতি গত ১৮ বছর ধরে সুরাতের বস্ত্রশিল্পে কাজ করছেন। লকডাউনে কাজ হারিয়ে বাড়ি ফেরার পর, জীবনে প্রথম, একটি শ্রমিক সংগঠনের সদস্য হন। সংগঠনটি লকডাউনে আটকে-পড়া শ্রমিকদের খাবার, জল, মাস্ক, স্যানিটাইজ়ার জোগান দিয়েছিল, বকেয়া মজুরি আদায়ে সাহায্য করেছিল, ২০২০-র নভেম্বরে শ্রমিকদের ফেরানোর জন্য ট্রেনের ব্যবস্থাও করেছিল। মজুরি, উন্নত কাজের পরিবেশ, নিরাপত্তা ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা, দরকষাকষিতে নানা ভাবে সাহায্য করছে সংগঠনটি। পরিযায়ীরা ইউনিয়ন তৈরির গুরুত্ব সম্পর্কে আরও সচেতন হচ্ছেন, বললেন লিঙ্গরাজ।
পরিযায়ী শ্রমিকদের সঙ্কটের কেন্দ্রে রয়েছে মজুরি হ্রাস। সমীক্ষা দেখিয়েছে যে, লকডাউনের তিন সপ্তাহ অতিক্রান্ত হওয়ার পরে আটক শ্রমিকদের ৯০ শতাংশের হাতেই দৈনন্দিন জীবনধারণের প্রয়োজনীয় নগদ অর্থ ছিল না। আন্তর্জাতিক শ্রম সংগঠনের প্রতিবেদন অনুসারে, ২০২০ সালে ভারতে সংগঠিত শ্রমিকের মজুরি যেখানে ৪% কমেছিল, সেখানে অসংগঠিত শ্রমিকদের মজুরি কমার হার ছিল ২৩%, যা সবচেয়ে বিপন্ন করেছে পরিযায়ী শ্রমিকদের। লকডাউন শুরু হওয়ার পর কেন্দ্রীয় সরকার, এবং রাজ্য সরকারগুলো বেশ কিছু কল্যাণমূলক পরিকল্পনার কথা ঘোষণা করে, যেমন বিনামূল্যে রেশন, স্বল্প ভাড়ায় আবাসনে থাকার ব্যবস্থা, দক্ষতা বৃদ্ধির প্রশিক্ষণ, সরাসরি অর্থ দান, ইত্যাদি। কিন্তু এই সব প্রকল্প প্রয়োজনের তুলনায় যথেষ্ট ছিল না, রূপায়ণের গতিও ছিল শ্লথ, দায়সারা।
করোনা অতিমারি পরিযায়ী শ্রমিকদের প্রতি প্রশাসনের উদাসীনতা ও অপ্রস্তুতিকে বেআব্রু করে দিয়েছে। কথা হয়েছিল, জাতীয় পর্যায়ে পরিযায়ী শ্রমিকের এক সুসংহত তথ্যভান্ডার গড়ে তোলা হবে। সেই কাজ এখনও বিশ বাঁও জলে। সাফল্যের মধ্যে, সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ অনুসারে চালু হয়েছে ‘এক দেশ এক রেশন কার্ড’ প্রকল্প। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, পরিযায়ী শ্রমিকের জন্য তা খুব একটা ফলপ্রসূ হয়নি। পরিযায়ী শ্রমিকেরা বেশির ভাগই পরিবার ছেড়ে একা থাকেন বলে নিজেদের রেশন নিজেরা তোলায় খুব একটা আগ্রহী নন। তাঁরা বরং চান, প্রাপ্য শস্যটুকু পরিবারের কাজে লাগুক।
পরিযায়ী শ্রমিকদের সুলভ ভাড়ায় বাসস্থানের ব্যবস্থা করার প্রকল্প ঘোষিত হয় ২০ জুলাই, ২০২০। প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনার (শহর) আওতায় প্রকল্পটি ঘোষিত হয়। ৩১ মে, ২০২২ পর্যন্ত পাওয়া তথ্যে দেখা যাচ্ছে, তেরোটা রাজ্যে এই ধরনের ৮৩,৫৩৪টি পরিকল্পিত আবাসনের মধ্যে মাত্র ৫,৪৮৭টি পরিযায়ী শ্রমিকদের থাকার জন্য হস্তান্তর করা হয়েছে। অর্থাৎ ঘোষণার দু’বছর পরে প্রকল্পের রূপায়ণের হার ৬.৫৫%।
পরিযায়ী শ্রমিকের জীবন-জীবিকার সুরক্ষার জন্য নির্মিত ‘আন্তঃরাজ্য পরিযায়ী শ্রমিক আইন ১৯৭৯’ যে খাতায়-কলমেই রয়ে গিয়েছে, সে সত্যটাও সামনে এনেছিল অতিমারিতে তাঁদের ভয়ানক বিপন্নতা। আইনের প্রয়োগ হওয়ার আগেই অবশ্য পাশ কাটানোর নানা ফন্দি চালু হয়ে গিয়েছে। যেমন, ঠিকাদার সরাসরি না গিয়ে গ্রামে আড়কাঠিদের পাঠাচ্ছে, যারা ভিনরাজ্যে যাওয়ার জন্য অগ্রিম টাকা দিচ্ছে, কোথায় গিয়ে উঠতে হবে সে ব্যবস্থাও করে দিচ্ছে। তার পর সেখান থেকে তাঁদের নিয়ে গিয়ে কাজ করাচ্ছে, যেন ওই পরিযায়ী শ্রমিকরা কাজের খোঁজে ভ্রাম্যমাণ শ্রমিক, ঠিকাদারের সঙ্গে হঠাৎ যোগাযোগ হয়েছে। এমন নানা উপায়ে চলছে ছদ্মপাচার, আইনি দায়বদ্ধতাকে নস্যাৎ করার চেষ্টা।
কোভিডের সময় পশ্চিমবঙ্গেও পরিযায়ী শ্রমিকের বিপুল প্রত্যাবর্তন আমরা দেখেছি। ঘরে-ফেরা শ্রমিকদের বিকল্প কর্মসংস্থান তৈরি করা হবে, এমন অনেক প্রচার হয়েছে। কাজের কাজ বিশেষ কিছু হয়নি। নির্মাণ, বিদ্যুৎ, গহনা শিল্পের সঙ্গে যুক্ত যে সব উচ্চ মজুরির দক্ষ শ্রমিক ফিরে এসেছিলেন, তাঁদের জন্য ১০০ দিনের কাজ উপযুক্ত বিকল্প ছিল না। তাই পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতেই ফের শুরু হয়েছে ফিরে যাওয়া। অথচ, অনেকেরই ইচ্ছে ছিল নিজের এলাকাতেই কিছু করার। মুর্শিদাবাদের সাগরদিঘিতে অতি উৎসাহে আপেল চাষের ব্যবস্থা করতে যাওয়া হয়েছিল, বাস্তবজ্ঞান-বর্জিত সেই উদ্যোগ মুখ থুবড়ে পড়েছে। আপেল চাষের মরসুম শুরু হতেই শ্রমিকেরা ফিরেছেন কাশ্মীরে, আবারও প্রাণ হাতে করে। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে কৃষিসঙ্কট। এ বছর বর্ষা কম হওয়াতে গত বছরের তুলনায় আমন ও আউশ চাষের জমি কমেছে প্রায় তিন লক্ষ হেক্টর। গত বছরের ডিসেম্বর থেকে ১০০ দিনের কাজের মজুরিও বন্ধ হয়ে রয়েছে। ফলে চাষের কাজ ছেড়ে নির্মাণের কাজ, বা নিদেনপক্ষে দিনমজুরির কাজ করতেও পাড়ি দিতে হচ্ছে বাইরে।
আবার কোন সঙ্কটে এই শ্রমিকদের বিতাড়িত, অপমানিত হতে হবে, কে বলতে পারে? অপূর্ণ অঙ্গীকারগুলোর কী হল, সে হিসাব কষতে হবে তখন আবার— যদি না তার আগেই নানা রাজ্যে পরিযায়ী শ্রমিকরা সংগঠিত ভাবে তাঁদের চাহিদাগুলোকে রাজনৈতিক দাবিতে পরিণত করতে পারেন।