সবচেয়ে পরিবেশবান্ধব যান, তবুও পুলিশের চক্ষুশূল সাইকেল
Cycle

গরিবের বাহন বলেই

৩ জুন ছিল বিশ্ব সাইকেল দিবস— সাইকেল, যা কিনা এখন পরিবেশচর্চায় উচ্চাসনে অধিষ্ঠিত। আর কলকাতায় এই পরিবেশবান্ধব বাহনের সঙ্গে প্রতি দিন যুক্ত লক্ষাধিক শ্রমজীবী মানুষ।

Advertisement

মোহিত রায়

শেষ আপডেট: ২০ জুন ২০২৩ ০৪:৪১
Share:

—প্রতীকী চিত্র।

সওয়া এক শতক আগের কথা। সবে কলকাতায় সাইকেল এসেছে, এবং তিন ‘স্যর’ শহরের রাস্তায় সাইকেল চালাচ্ছেন— জগদীশচন্দ্র বসু, প্রফুল্লচন্দ্র রায় ও নীলরতন সরকার। এই তিন জন আজ শহরের রাস্তায় সাইকেল চালালে কলকাতা পুলিশের আইনের যে ধারায় অভিযুক্ত হতেন, সে আইনেরও শতবর্ষ পার হয়ে গেছে। কলকাতায় মোটরগাড়ি আসে ১৮৮৬ সালে। তিন বছর পরে, ১৮৮৯-এ আসে সাইকেল। এর বেশ আগেই ‘ক্যালকাটা পুলিশ অ্যাক্ট ১৮৬৬’ জারি হয়েছে। এখনও চালু। যদিও এই আইনে কলকাতার পথে হাতি, উট, ঘোড়া ও ঘোড়ায় টানা গাড়িসংক্রান্ত বেশ কিছু নিয়মকানুন আছে, কিন্তু সাইকেল নিয়ে কিছু নেই। ১৯১০ সালে এই আইনে অন্তর্ভুক্ত ৬৬ (৪ক) ধারায় বলা আছে, প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারে, এমন কিছু যদি কেউ রাস্তায় রাখে, তা হলে অভিযুক্তকে অর্থদণ্ড দিতে হবে। বর্তমানে কলকাতা পুলিশের কাছে সাইকেল একটি প্রতিবন্ধকতা, ফলে কলকাতার বিভিন্ন পথে সাইকেল-আরোহীরা সব সময়ই এই দণ্ডাজ্ঞা ভীতি নিয়েই সাইকেল চালাতে বাধ্য হন।

Advertisement

৩ জুন ছিল বিশ্ব সাইকেল দিবস— সাইকেল, যা কিনা এখন পরিবেশচর্চায় উচ্চাসনে অধিষ্ঠিত। আর কলকাতায় এই পরিবেশবান্ধব বাহনের সঙ্গে প্রতি দিন যুক্ত লক্ষাধিক শ্রমজীবী মানুষ। তাঁদের জীবিকা অর্জনের একটি প্রধান সহায় সাইকেল। কিন্তু গত প্রায় দু’দশক ধরে কলকাতার রাস্তায় সাইকেল আরোহীরা বারংবার দণ্ডিত হচ্ছেন— তাঁদের সীমিত আয়ে ভাগ বসাচ্ছেন আইনরক্ষকেরা, বার বার আবেদন সত্ত্বেও আমলা-মন্ত্রীরা উদাসীন। ২০০৮ সালে ৩৮টি প্রধান পথে সাইকেল নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়েছিল। ২০১৩-য় তেমন রাস্তার সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ১৭৮। সে সময় থেকেই কলকাতা সাইকেল-আরোহী অধিকার ও জীবিকা রক্ষক কমিটি বার বার প্রশাসন, পুলিশ আধিকারিক ও মন্ত্রীদের কাছে আবেদন জানিয়েছে। কিছু নিষেধাজ্ঞা কমলেও খুব একটা ফারাক হয়নি— এখনও কলকাতার ৭২টি রাস্তায় সাইকেল নিষিদ্ধ।

কলকাতার সাইকেল চালক কারা? তালিকাটি দীর্ঘ। বাজারে বাজারে বিভিন্ন জিনিস সরবরাহ কর্মী, হোম ডেলিভারি, কুরিয়ার সার্ভিস, ইলেকট্রিক মিস্ত্রি, কাঠের মিস্ত্রি, বিভিন্ন অফিসের সিকিয়োরিটি গার্ড, গৃহ-পরিচারিকা, বিভিন্ন জিনিসের ফেরিওয়ালারা রয়েছেন সেই তালিকায়। এ ছাড়া বিভিন্ন অফিসে কাজ করেন, এমন অনেকে মানুষ সাইকেলেই অফিস যান। দোকান-অফিসের বিপুলসংখ্যক কর্মীর দুপুরের খাবার সরবরাহ করেন সাইকেল চালকেরাই। এই সাইকেল চালকদের অনেকের যাতায়াতের পরিধিটি স্থানীয়, অনেকের আবার সারা শহর জুড়ে। গণেশ টকিজ় অঞ্চলের দুধের বাজার এক বিশাল ব্যাপার। সেখান থেকে সাইকেল করে দুধ, ছানা সরবরাহ হয় সারা শহরে। সেই দুগ্ধ সরবরাহকারী সাইকেল চালকদের চিন্তা, কতগুলো থানা এলাকা পার করতে হবে। এ ভাবেই বড়বাজার অঞ্চলের বিশাল বাজার থেকে হাজার কিসিমের জিনিস ছোট ব্যবসায়ীরা কিনে সাইকেলে নিয়ে যান শহর ও শহরতলির বিভিন্ন স্থানে। পেস্ট কন্ট্রোলের কাজ করেন যিনি, তাঁর কর্মক্ষেত্র টালা থেকে টালিগঞ্জ। তাঁকেও হিসাব রাখতে হয় এই সব থানার। এই বিশালসংখ্যক মানুষের কাছে সাইকেল হচ্ছে সবচেয়ে কম খরচে জীবিকা উপার্জনের উপায়। এই যাতায়াত বাস-অটোতে করা মানে দিনে অন্তত পঞ্চাশ টাকার ধাক্কা, মাসে দেড় হাজার টাকা— অনেকের আয়ের ২০-২৫ শতাংশ। কৃষ্ণলাল গঙ্গোপাধ্যায় সাইকেলে বই থেকে মেশিন, অনেক পণ্য সরবরাহ করছেন প্রায় পঞ্চাশ বছর। স্বল্প আয়েও কিনেছেন বেশ কয়েকটি সাইকেল। পারিবারিক সূত্রে বাড়িতে আছে এখনও ব্যবহারযোগ্য একশো বছরের পুরনো সাইকেল। সে সাইকেল নাকি ব্যবহার করেছেন ত্রিশের দশকের বিপ্লবীরা। উনি জমিয়ে রেখেছেন কলকাতা পুলিশের সাইকেল জরিমানার রসিদগুলি— এই রসিদের বিশেষত্ব হল, তাতে জরিমানার টাকার কথা লেখা থাকে না।

Advertisement

কলকাতার প্রধান পথগুলিতে ও পূর্ব প্রান্তের ই এম বাইপাসে সাইকেল নিষিদ্ধ, যদিও সেগুলিই দ্রুত যাতায়াতের পথ। যে কোনও দিন সেখানে অনেক সাইকেল দেখাও যাবে। সাইকেল চালকদের মধ্যে দু’টি দল আছে। শোনা যায়, যাঁরা নিয়মিত জিনিসপত্র সরবরাহ করেন, তাঁরা তাঁদের পথের সব ক’টি থানার সঙ্গে একটা মাসিক ভাতার বন্দোবস্ত করে নেন। বাকিরা ভাগ্যের ভরসায় চলেন, যেখানে যেখানে বেশি ধরপাকড় হয়, সেখানে একটু সাবধানে চলতে হয়। যদিও আইনের ধারায় দণ্ড ৫০ টাকার, কিন্তু একশো টাকাই দিতে হয়। পুলিশ সব সময় সক্রিয় থাকে না, জীবনানন্দীয় প্যাঁচার কায়দায় ‘ধরা যাক দু-একটা ইঁদুর এবার’ ভেবে মাঝে মাঝে সাইকেল ধরে— অর্থের রসিদ না থাকায় সে টাকা কে পায়, তা বলা বাহুল্য। সারা দিনের আয়ের এক তৃতীয়াংশ ঢুকে যায় দেড়শো বছরের পুরনো আইনের গহ্বরে, যেখানে সাইকেলের নামও নেই।

সাইকেলে এত অনীহা কেন কর্তাদের? এক কথায় উত্তর: এটা গরিব মানুষের পরিবহণ বলে। অবশ্য পরিচিত উত্তর দু’টি— এক, সাইকেলে দুর্ঘটনা বাড়বে; দুই, পথে যানবাহনের গতি কমে যাবে। সাইকেলের দুর্ঘটনার তথ্য এর উল্টোই বলে। ২০২১ সালের কেন্দ্রীয় পথ-পরিবহণ দফতরের তথ্য বলছে যে, পথ-দুর্ঘটনায় সাইকেলে মৃত্যু মাত্র দুই শতাংশ; সবচেয়ে বেশি মোটরসাইকেল-স্কুটারে— ৪১ শতাংশ। কেউ কি বলছেন যে, মোটরসাইকেল-স্কুটার শহরের পথে বন্ধ করতে হবে? কলকাতার একটি বড় অংশে রাস্তায় কোনও ফুটপাত নেই, সে রাস্তায় বাস লরি থেকে সব রকমের গাড়ি চলে। উল্লিখিত সমীক্ষার তথ্য বলছে, পথচারীদের মৃত্যু ১৭ শতাংশ। তা হলে সেই সব পথ কি পথচারীদের জন্য নিষিদ্ধ করতে হবে? দ্বিতীয়ত, গতির প্রশ্নে সাইকেলকে দায়ী করাও একেবারে অযৌক্তিক। গত দশ বছরে একটি সমীক্ষা অনুযায়ী কলকাতার রাস্তায় গাড়ি বেড়েছে চার গুণ, মোটরসাইকেল-স্কুটার বেড়েছে আট গুণ। এত অতিরিক্ত গাড়ির ফলে পথে যানবাহনের গতি কমে যাবে, তা কি ভাবা হয়েছে? না। ভাবলে নতুন গাড়ি কেনার উপর নিষেধাজ্ঞা হত। কয়েকটি প্রধান রাস্তা ছাড়া প্রায় সব পথেই গাড়ি রাখার (পার্কিং) সরকারি ব্যবস্থা থাকে। তখনও গতির কথা মনে আসে না। ইস্টার্ন মেট্রোপলিটন বাইপাস ক্রমশ প্রশস্ত হল, লেন বাড়ল, কিন্তু কেউ সাইকেল লেনের কথা ভাবল না। এটা আমাদের পুলির প্রশাসনের চিন্তার দীনতা, সাইকেলের তাতে কোনও ভূমিকা নেই। টালিগঞ্জ থেকে শহরের কেন্দ্রের প্রধান রাজপথ যথেষ্ট প্রশস্ত, তাতে সাইকেল লেন রাখলে কোনও সমস্যা হবে না। পুলিশ প্রশাসন এতটাই অদক্ষ যে, তারা কলকাতার রাস্তায় লেন বরাবর গাড়ি চালানো চালু করতে পারেনি, হর্ন বাজানো বন্ধ করতে পারেনি। আজকের ক্যামেরা-অধীন রাস্তায় শুধু প্রশাসনের সদিচ্ছা থাকলেই এগুলো সম্ভব। তা হলেই সাইকেল লেন নিরাপদ থাকবে।

এই কয়েক হাজার সাইকেল কলকাতার বায়ুদূষণ খানিক হলেও কমাচ্ছে। এঁরা যদি তেল-পোড়ানো মোটরচালিত যানবাহনে যেতেন, তা হলে যে পরিমাণ কার্বন ডাইঅক্সাইড ও অন্যান্য দূষণ নির্গত হত, তার একটা আর্থিক মূল্যায়ন করে বরং এই সাইকেল চালকদের বার্ষিক পরিবেশ ভাতা দেওয়া উচিত। পথ-নিরাপত্তার জন্যএঁদের সরকারের পক্ষ থেকে রঙিন জ্যাকেট দেওয়া উচিত। প্রতিটি মেট্রো স্টেশনে সাইকেল স্ট্যান্ড রাখা প্রয়োজন, যেখানে সাইকেল রেখে বা সেখান থেকে সাইকেল নিয়ে মেট্রো রেল ব্যবহার করে এক জন নাগরিক শহরকে দূষণমুক্ত রাখতে সাহায্য করতে পারেন। শুধু পুলিশ নয়, নগর পরিকল্পনাকার ও পথ-প্রযুক্তিবিদদের এই বিষয়ে প্রশাসনকে সাহায্য করা উচিত।

আর্থিক বিষয়, শ্রমজীবী মানুষের জীবিকা,এবং পরিবেশ— এই ত্রিফলা আলোয় আমাদের পুলিশ, পরিকল্পনাকার ও প্রশাসনের চিন্তা আলোকিত হোক।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement