Society

ফেলে আসা সেই সময়

আবাদের জমি থেকে নৌকায় ধান আসত বাড়ির গোলায়। গ্রামের একমাত্র দুর্গাপুজো হত বাড়ির চণ্ডীমণ্ডপে, সকল গ্রামবাসী অংশগ্রহণ করতেন।

Advertisement

শিখা সেনগুপ্ত

শেষ আপডেট: ২৪ মার্চ ২০২৩ ০৬:৪৬
Share:

বাবা জোর দিয়ে বলতেন তিনি জন্মেছেন এ বাড়িতে, অখণ্ড ভারতবর্ষে। ফাইল চিত্র।

পূর্ববঙ্গের খুলনা জেলায়, কপোতাক্ষ তীরের গ্রাম রাড়ুলীর বিখ্যাত রায়চৌধুরী পরিবারের প্রাচীন চক-মিলানো জমিদারবাড়িতে জন্ম। সেজো ঠাকুরদামশায় বিজ্ঞানী আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়, গ্রামে তাই পরিবারটিকে মানুষ সম্মানের চোখে দেখত। বাবা ছিলেন গ্রামে আচার্য-প্রতিষ্ঠিত হাই স্কুলের শিক্ষক, ছাত্রগতপ্রাণ। গ্রামের মানুষ ও ছাত্রেরা তাঁকে মাথায় তুলে রাখত। বোধবুদ্ধি হওয়ার পর থেকে দেখেছি দেশটার নাম পূর্ব পাকিস্তান। অবশ্য বাবা জোর দিয়ে বলতেন তিনি জন্মেছেন এ বাড়িতে, অখণ্ড ভারতবর্ষে। আজ দেশটার নাম পাকিস্তান হলেও তার সাত পুরুষের ভিটেমাটির উত্তরাধিকার মিথ্যা হয়ে যায় না। কিন্তু আমি যে-হেতু খণ্ডিত বাংলায়, অস্থির সামাজিক-রাজনৈতিক সময়ে জন্মেছিলাম, চার পাশের পরিস্থিতি বয়সের তুলনায় আমাদের অনেক পরিণত করেছিল। তখন ভাবতেও পারিনি, এই মাটি থেকে আমাদের উৎখাত হতে হবে।

Advertisement

আবাদের জমি থেকে নৌকায় ধান আসত বাড়ির গোলায়। গ্রামের একমাত্র দুর্গাপুজো হত বাড়ির চণ্ডীমণ্ডপে, সকল গ্রামবাসী অংশগ্রহণ করতেন। মাঝেমধ্যে বাইরে থেকে কারা যেন এসে প্রচার করত, এটা পাকিস্তান, মুসলমানদের দেশ, এখানে বেশি হিঁদুয়ানি চলবে না। ১৯৬৫ সালে বাড়ির কাছে বাগেরহাটে ভয়ানক দাঙ্গা বেধে গেল, একতরফা বহু হিন্দু নিধন হল। তার পরে শুরু হল ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ। তবু তার মধ্যেই জীবন চলতে থাকে। আমাদের স্কুলে প্রথমে গাইতে হত জাতীয় সঙ্গীত, ‘পাক সার জমিন সাদ বাদ, কিসওয়ারে হাসিন সাদ বাদ’— অর্থ না বুঝে এই উর্দু গান গাইতে ছোটবেলাতেই মন বাদ সাধত, প্রায়ই আমি ঠোঁট নাড়াতাম না। স্কুলের মাস্টারমশাই ও দিদিমণিরাও ছিলেন বাঙালি চেতনার পন্থী, তাঁরাও কিছু বলতেন না। এর পরেই হত প্রার্থনাসঙ্গীত ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি’, সব মেয়ে গাইত উৎসাহের সঙ্গে, গলা খুলে। বাড়িতে মায়ের কাছে অনুযোগ করতাম, আমরা কেন উর্দু গান গাইব? মা খুলনার করোনেশন গার্লস ইংলিশ হাই স্কুল থেকে এনট্রান্স পাশ করা শিক্ষিতা, সে কালের রাজনৈতিক, সামাজিক অবস্থা সম্বন্ধে সচেতন। তিনিই আমাদের বলতেন ১৯৫২-র একুশে ফেব্রুয়ারি ভাষা আন্দোলনে কী ভাবে রফিক বরকতেরা শহিদ হয়েছিলেন সে গল্প; এও বলেছিলেন, চাপিয়ে দেওয়া এই উর্দু শাসন বেশি দিন টিকতে পারে না। মায়ের কাছে শুনতাম, ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ বলেছেন, বাংলাকে অন্তত প্রাদেশিক ভাবে রাষ্ট্রভাষা করা হোক। কেন পোস্টকার্ডে, ফর্মে শুধু উর্দু আর ইংরেজি থাকবে! তা তো হলই না, উল্টে জিন্না সাহেব ঢাকায় এসে বললেন ‘জননী’ ‘পূজা’ এ ধরনের শব্দ ব্যবহার করা যাবে না, এমনকি বাংলা কথা আরবি হরফে লিখতে হবে। মা বলতেন, এই যে তোরা নজরুলের ‘চল চল চল’ কবিতায় ‘সজীব করিব গোরস্থান’ পড়িস, এটা ঠিক নয়— কবি আসলে লিখেছিলেন, ‘সজীব করিব মহাশ্মশান’।

বাবার কাছে আসতেন পাশ করে যাওয়া ছাত্ররা। কাছারির ঘরে বসে বলতেন, “স্যর, এ অবস্থা চলতে পারে না, আমরা চলতে দেব না।” এঁরা সবাই পরে মুক্তিযোদ্ধা হয়েছিলেন। একুশে ফেব্রুয়ারি সরকার স্কুল ছুটি না দিলেও, এলাকার সব স্কুল কার্যত ছুটি থাকত। তবে আমরা সবাই স্কুলে যেতাম। টেবিলের উপর বই রেখে তৈরি হত শহিদ স্মারক। শিক্ষক, ছাত্রছাত্রী সবাই গান আবৃত্তি বক্তৃতায় পালন করতাম ভাষা শহিদ দিবস। মায়ের শেখানো, ‘মোদের গরব মোদের আশা, আ মরি বাংলা ভাষা’ গান গাইতাম। সরকারি ইউনিয়ন বোর্ডেও পালিত হত ভাষা দিবস। দেশ তখন কার্যত পশ্চিম পাকিস্তানের অধীন, যে-হেতু এলাকার সবাই মুক্তচিন্তা ও বাঙালি সংস্কৃতিতে বিশ্বাসী, তাই অনেক প্রতিকূলতা সহ্য করেও চলত সপ্তাহব্যাপী অনুষ্ঠান। একুশে ফেব্রুয়ারি দিনটিতে আমরা ছাত্রছাত্রীরা তো বটেই, এলাকার মানুষও জুতো পরতেন না। রাস্তায় সবাই খালিপায়ে হাঁটতাম। এ দিন কেউ সাইকেলে চড়তেন না, সবাই হাঁটতেন।

Advertisement

১৯৭০ সাল পর্যন্ত এমনই চলছিল। বাঙালি চেতনার প্রতি শ্রদ্ধাবোধে আন্দোলন তীব্রতর হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের সময় বাবার মুক্তিযোদ্ধা ছাত্রেরা আমাদের বাড়ি পাহারা দিতেন। কিন্তু রাজাকারদের সাহায্য নিয়ে খানসেনারা প্রায় আমাদের গ্রামের কাছে চলে আসে, তখন মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে তুমুল লড়াই চলছে। মনে আছে, আলম নামে বাবার এক মুক্তিযোদ্ধা ছাত্র যুদ্ধে মারা গিয়েছিলেন। অন্য ছাত্রেরা রাতারাতি আমাদের অন্য পথ দিয়ে, নৌকা কালো কাপড়ে ঢেকে এক মুসলমান মাঝির সঙ্গে এ-পার বাংলায় আসার ব্যবস্থা করে দেন। নিরাপত্তাহীনতায় ভোগা আমার মা আর কিছুতেই পরে ফিরে যেতে চাননি। আমরাও আর কখনও ফিরে যাইনি বাংলাদেশে। রাড়ুলীর বাড়ি, বিজ্ঞানীর বাড়ি বলে এখন অধিগ্রহণ করেছে সে দেশের সরকার। এখন অন্তরের উৎসারিত দীর্ঘশ্বাসই শুধু সম্বল।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement