Loan

ঋণ কি কখনও অনুদান হয়

অতিমারিদীর্ণ অর্থনীতির দাওয়াই হিসেবে ঋণ কতটা কার্যকর, তা নিয়ে অর্থনীতিবিদদের মধ্যে মতভেদ আছে।

Advertisement

অগ্নিরূপ সরকার

শেষ আপডেট: ২০ জুলাই ২০২১ ০৫:০৪
Share:

গত ২৮ জুন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন অতিমারিক্লিষ্ট দেশবাসীর সাহায্যার্থে যে একগুচ্ছ আর্থিক দাওয়াই ঘোষণা করলেন, তার অন্যতম হল ক্রেডিট গ্যারান্টি প্রকল্প। এই প্রকল্প অনুযায়ী ক্ষুদ্রঋণ সংস্থাগুলি শহরাঞ্চলের ২৫ লক্ষ ছোট ঋণগ্রহীতার প্রত্যেককে ১.২৫ লক্ষ টাকা অবধি ধার দিতে পারবে। ঋণের টাকা জোগাবে ব্যাঙ্ক। ক্ষুদ্রঋণ সংস্থাগুলি ব্যাঙ্কের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে সেই টাকা শহরের ছোট ঋণগ্রহীতাদের ধার দেবে। এবং সেই ঋণের উপর থাকবে সরকারি গ্যারান্টি বা মুচলেকা। কোনও কারণে ঋণগ্রহীতা টাকা শোধ করতে না পারলে সরকারই সেই টাকা ব্যাঙ্ককে মিটিয়ে দেবে।

Advertisement

অতিমারিদীর্ণ অর্থনীতির দাওয়াই হিসেবে ঋণ কতটা কার্যকর, তা নিয়ে অর্থনীতিবিদদের মধ্যে মতভেদ আছে। অর্থ মন্ত্রকের মুখ্য উপদেষ্টা কৃষ্ণমূর্তি সুব্রহ্মণ্যমের মতো সরকারি অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন যে, ঘোষিত ঋণ প্রকল্পটি অন্য যে কোনও বিকল্পের থেকে শ্রেয়। উল্টো দিকে অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায় বা রঘুরাম রাজনের মতো অর্থনীতিবিদদের মতে, এই অতিমারির সময় গরিব মানুষকে সরাসরি নগদ অনুদান দেওয়াটাই সমীচীন। এ নিয়ে বেশ কিছু দিন তর্ক-বিতর্ক চলছে।

সরকারি প্রবক্তারা বলছেন যে, ঋণ প্রকল্পটি যে হেতু ক্ষুদ্রঋণ সংস্থাগুলির মাধ্যমে রূপায়িত হচ্ছে, সরাসরি নগদ অনুদানের তুলনায় এটি অনেক বেশি সংখ্যক গরিব মানুষের কাছে পৌঁছবে। তাঁদের বক্তব্য, শহরের গরিব সংক্রান্ত সরকারি তথ্যে প্রচুর ঘাটতি আছে। বিশেষ করে পরিযায়ীদের সম্বন্ধে সরকারের জ্ঞান খুবই সীমিত। অপর পক্ষে ক্ষুদ্রঋণ সংস্থাগুলি, নিজেদের ব্যবসার স্বার্থেই, শহরের গরিবদের সম্বন্ধে সমস্ত দরকারি তথ্য সংগ্রহ করে তাঁদের কাছে পৌঁছে যাবে। ফলে ঋণ প্রকল্পটির ব্যাপ্তি সরাসরি নগদ অনুদান প্রকল্পের তুলনায় অনেক বেশি হওয়ার সম্ভাবনা। তার থেকেও বড় কথা, ঋণ প্রকল্পটি করদাতার কষ্টার্জিত অর্থের সম্যক ও দক্ষ ব্যবহার নিশ্চিত করবে, যেটা সরাসরি অনুদানে সম্ভব নয়।

Advertisement

যাঁরা ঋণ গ্রহণের যোগ্য, মুখ্য আর্থিক উপদেষ্টা তাঁদের তিন ভাগে ভাগ করছেন। প্রথম ভাগে রয়েছেন এমন মানুষ, যাঁরা ঋণ পাওয়ার যোগ্য হলেও ঋণ নিতে উৎসাহী নন। হয়তো তাঁরা অন্য কোনও জায়গা থেকে ঋণ পেয়েছেন, কিংবা হয়তো বর্তমানে তাঁদের আর্থিক অবস্থা কিছুটা স্থিতিশীল। দ্বিতীয় ভাগে যাঁরা রয়েছেন, তাঁরা অতিমারির কারণে সাময়িক ভাবে আর্থিক সঙ্কটে পড়েছেন। অতিমারি কেটে গেলে এঁদের আর্থিক অবস্থার উন্নতি ঘটবে এবং এঁরা ঋণের টাকা ফিরিয়ে দিতে সক্ষম হবেন। তৃতীয় ভাগের মানুষ শুধু যে এখন আর্থিক অনটনে ভুগছেন তা-ই নয়, ভবিষ্যতেও এঁদের অবস্থার বিশেষ উন্নতি হবে না।

ধরা যাক, ঋণ শোধ না করলে ঋণখেলাপিকে একটা চড়া মূল্য দিতে হবে। সে ক্ষেত্রে প্রথম ভাগের মানুষ ঋণ নেবেন না; দ্বিতীয় ভাগের মানুষ ঋণ নিয়ে ফেরত দেবেন; তৃতীয় ভাগের মানুষ ঋণ নেবেন, এবং ঋণ শোধ করতে নেহাত অপারগ বলে অনিচ্ছা সত্ত্বেও ঋণখেলাপি হবেন। প্রত্যেকটি ঋণে যে হেতু সরকারি মুচলেকা আছে, ঋণখেলাপিদের ঋণ ব্যাঙ্ককে মিটিয়ে দেবে সরকার।

সরকারের প্রবক্তারা বলছেন, মুচলেকা অনুযায়ী এই মিটিয়ে দেওয়া ঋণ কার্যত নগদ অনুদানের মতোই। কিন্তু সরাসরি নগদ অনুদানের সঙ্গে এর তফাত আছে। সরাসরি নগদ অনুদানের ক্ষেত্রে দরকার থাকুক বা না থাকুক, পূর্বোক্ত তিনটি ভাগের মানুষই সরকারি অনুদান পাচ্ছেন। ঋণ প্রকল্পে অনুদান পাচ্ছেন শুধুমাত্র তৃতীয় ভাগের মানুষ, যাঁরা প্রকৃতই গরিব এবং যাঁদের সত্যি সত্যিই অনুদানের প্রয়োজন আছে। অর্থাৎ ঋণদান প্রকল্পে করদাতার অনেকগুলো টাকা বেঁচে যাচ্ছে। অনুদানও ঠিক জায়গায় ঠিক মতো পৌঁছচ্ছে।

একটু ভেবে দেখলে কিন্তু সরকারি যুক্তির ফাঁকগুলো চোখে পড়বে। প্রথমত, গণবণ্টন ব্যবস্থা বা অন্যান্য উন্নয়নমূলক প্রকল্প চালু রাখার জন্য সরকারকে শহরের গরিবদের ভাল করে চিহ্নিত করতেই হবে। সেই তথ্য অনায়াসে নগদ অনুদান প্রকল্পে ব্যবহার করা যেতে পারে।

দ্বিতীয়ত, ঋণদান প্রকল্পটি সরকারের পরিকল্পনামাফিক শুধুমাত্র প্রকৃত অভাবীদের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে গেলে ঋণখেলাপের মাসুলটা চড়া হতে হবে। কারণ, ঋণখেলাপের মূল্য সামান্য হলে সব ভাগের মানুষই ঋণ নেবেন এবং নিয়ে ফেরত দেবেন না। এর তাৎপর্য হল, যাঁরা ঋণ নিয়ে ফেরত দিতে পারছেন না, তাঁদের পরবর্তীকালে সত্যি সত্যিই একটা চড়া মাসুল দিতে হচ্ছে। এই মাসুল ভবিষ্যতে ঋণ না পাওয়ার মাধ্যমে দিতে হতে পারে, কিংবা সামাজিক বয়কটের মাধ্যমে। মনে রাখতে হবে, এই ঋণখেলাপিরা সমাজের দরিদ্রতম গোষ্ঠী। বস্তুত, ঋণখেলাপের মাসুল চড়া হওয়ার কারণে যাঁরা ঋণ ফেরত দিচ্ছেন, বা দিতে বাধ্য হচ্ছেন, তাঁরাও কিন্তু গরিব মানুষ। ঋণশোধ করতে গিয়ে এঁদেরও কম কষ্ট হচ্ছে না। ধারের টাকা শোধ করতে গিয়ে এঁদের সঞ্চয় এবং ভবিষ্যৎ জীবনযাত্রা ব্যাহত হচ্ছে। দক্ষতা এবং করদাতার অর্থ সাশ্রয়ের অজুহাতে এই দরিদ্রতম মানুষদের এতটা বিড়ম্বনার মধ্যে ঠেলে দেওয়াকে কি শ্রেয় নীতি বলা চলে?

অন্য দিকে, যদি ঋণগ্রহীতারা বিশ্বাস করেন যে, ভবিষ্যতে রাজনৈতিক চাপের মুখে পড়ে সরকার ঋণখেলাপিদের সব ঋণ মকুব করে দেবে, খেলাপের জন্য কোনও মাসুলই কাউকে দিতে হবে না, তা হলে প্রয়োজন এবং ঋণশোধের ক্ষমতা নির্বিশেষে সকলেই ধার নেবেন এবং কেউই শোধ দেবেন না। তার থেকে সরাসরি অনুদান দেওয়াই ভাল।

অর্থনীতি বিভাগ, আইআইটি গুয়াহাটি

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement