—প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।
নগরজীবনে নতুন আতঙ্কের নাম ডেঙ্গি। শারদ উৎসবের মতোই এখন বাৎসরিক ক্যালেন্ডারে জায়গা করে নিয়েছে এই রোগ। স্বাস্থ্য পরিকাঠামোর অপ্রতুলতায় হাসপাতালে ঠাঁই না মেলায় ইতিমধ্যেই প্রাণ হারিয়েছেন অনেকে। অন্য দিকে, পুরসভার কর্তারা ডেঙ্গির খবর চাউর হতেই মশা মারার তেল, ব্লিচিং পাউডার নিয়ে বেরিয়ে পড়েছেন। ফলে ডেঙ্গির মরসুমে এখন সাজো সাজো রব! সরকারি স্তরে বিজ্ঞাপনী সতর্কতা জারি হয়েছে বাড়ির আশেপাশে জমা জলের আধার পরিষ্কার রাখা থেকে শুরু করে মশারি টাঙিয়ে থাকা নিয়ে। কিন্তু এমন সতর্কতা খানিকটা বাড়িতে আগুন লাগার পর দমকল বাহিনীর তৎপরতার মতোই।
ইতিমধ্যে পৃথিবী জুড়ে সংক্রমণের নিরিখে ডেঙ্গিকে এক বিপজ্জনক শহুরে ব্যাধি হিসাবে চিহ্নিত করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। জলবায়ু পরিবর্তনের দাপটে আর্দ্র আর উষ্ণ আবহাওয়ার সঙ্গে বাড়ছে ডেঙ্গির দাপট। ফলে, পশ্চিমবঙ্গেও এখন কেবল বর্ষা নয়, শরৎ-হেমন্ত ছাড়িয়ে শীত অবধি প্রসারিত হচ্ছে ডেঙ্গির থাবা। মারণরোগ হিসাবে ডেঙ্গির মশার জন্ম আবহাওয়া-নির্ভর হলেও সেই সংক্রমণের প্রসারের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে দ্রুত এবং বেলাগাম নগরায়ণের প্রভাব। এর পরিপ্রেক্ষিতে ডেঙ্গি মোকাবিলায় তার চিকিৎসা পরিকাঠামো গড়ে তোলা যেমন জরুরি, তেমনই জরুরি ডেঙ্গি প্রতিরোধে বছর জুড়ে উপযুক্ত পুর পরিকল্পনা। সিঙ্গাপুর, ভিয়েতনামের মতো বেশ কিছু দেশের সমীক্ষায় প্রমাণিত যে, শহর কিংবা শহরতলির জনঘনত্বের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গি ভাবে জড়িয়ে রয়েছে সংক্রমণ প্রসারের হার এবং ঝুঁকি। কলকাতা শহরের গড় জনঘনত্ব প্রতি বর্গ কিলোমিটারে প্রায় ২৫০০০ জন। আর এই শহরের ৩২% মানুষ বস্তিবাসী, যেখানে জনঘনত্ব আরও বেশি। তাই ডেঙ্গির মতো রোগের সংক্রমণ কেবল অতি উচ্চ জনঘনত্বের কলকাতা মেগাসিটি নয়, বরং উত্তর চব্বিশ পরগনা, হাওড়া, দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার মতো জেলার নগরায়িত অঞ্চলে কিংবা উত্তরবঙ্গের দার্জিলিং, মালদহে তুলনায় বেশি।
গবেষণায় প্রমাণিত যে, ডেঙ্গির মশার গড়পড়তা ওড়ার ক্ষমতা দু’শো মিটারের মতো। শহর কিংবা শহরতলিতে জনঘনত্ব বেশি হওয়ার অর্থ বাড়ির ঘনত্ব বৃদ্ধি। অর্থাৎ, কোনও এলাকায় গা ঘেঁষাঘেষি করে দাঁড়িয়ে থাকা বাড়ির সংখ্যা বৃদ্ধি। ফলে সমানুপাতে বৃদ্ধির সম্ভাবনা মশার কামড়ে সংক্রমিত মানুষের। এমন অঞ্চলগুলিতে স্থানাভাবের কারণে নিকাশি নালাও অপ্রতুল। প্রায়শই বাড়ির ভিতরের খোলা নর্দমা দিয়ে ব্যবহৃত জল এবং বর্জ্য পুরসভার নিকাশি নালায় গিয়ে পড়ে। বহু ক্ষেত্রে পুরসভার নালাগুলি ঢাকা কিংবা ভূগর্ভস্থ না হওয়ায় নালার আনাচেকানাচে জমা জল মশার আঁতুড়ঘরে পরিণত হয়। এমনকি শহরের ভূগর্ভস্থ নালাগুলির সুড়ঙ্গপথে নিয়মিত পলি পরিষ্কার না হলে সেখানেও ডেঙ্গির মশা বাসা বাঁধতে পারে। পুরসভাগুলির আশু লক্ষ্য হওয়া উচিত, উপগ্রহ চিত্রের ভিত্তিতে শহরের জনবহুল এলাকাগুলি চিহ্নিত করে সেগুলির নিকাশির সংস্কারকে অগ্রাধিকার দেওয়া।
ওয়র্ড এলাকায় পাইপে পাঠানো পুরসভার পরিস্রুত জল সরবরাহের উপর নির্ভর করতে পারে এই সংক্রমণ। জল সরবরাহের পরিমাণ অপ্রতুল হলে পানীয় জল থেকে শুরু করে স্নানের জল বাড়িতে জমিয়ে রাখার প্রবণতা বাড়ে। এলাকায় জমা জলের বিপদও কম নয়। এ ক্ষেত্রে শহরের নিচু এবং জল জমতে পারে, এমন অঞ্চলগুলিকে চিহ্নিত করা জরুরি। কলকাতা সংলগ্ন দক্ষিণ দমদম পুরসভা এবং বিধান নগর পুরসভার একাংশ এমন বৈশিষ্ট্য সম্বলিত। জনঘনত্ব, জমা জলের বিপদ, অপ্রতুল নিকাশি এবং পানীয় জলের অভাব সম্বলিত অভিন্ন এক মানচিত্র তৈরি করতে পারলে সেটা কার্যত ডেঙ্গির ঝুঁকিপ্রবণ এলাকার মানচিত্র হয়ে উঠবে। কিন্তু এর জন্য প্রয়োজন সঠিক তথ্যের আদানপ্রদান। যে কোনও সংক্রমণের ভৌগোলিক এলাকাভিত্তিক আক্রান্ত এবং মৃত্যুর সঠিক তথ্য না জানলে বিপদের উৎসস্থল সম্পর্কে অন্ধকারে থাকতে হয়। ফলে কঠিন হয়ে ওঠে বিপর্যয় মোকাবিলা। তাই ওয়র্ড ভিত্তিক বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে সংক্রমণের সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে সরকার এবং পুরসভার স্বাস্থ্য, পুর পরিষেবা এবং পরিকাঠামোর তদারককারী সংস্থাগুলির মধ্যে সমন্বয় জরুরি।
বাড়িতে জল জমিয়ে রাখার জন্য তৈরি কংক্রিট কিংবা প্লাস্টিকের জলের ট্যাঙ্কেও লুকিয়ে থাকতে পারে এই বিপদ। কারণ, ওই উঁচু জায়গায় ট্যাঙ্কের জলের নিত্য দেখভাল কার্যত সম্ভব হয় না। জলের ট্যাঙ্কে ঢাকনা লাগানো থাকলেও সেটির জল ‘ওভার ফ্লো’ করা পাইপের রন্ধ্র গলে মশার যাতায়াতে বাধা থাকে না। যে কাঠামোগুলি সারা বছর চোখের আড়ালে থাকে, সেখানে ‘ড্রোন’ ক্যামেরা ব্যবহার করে জমা জলের নিয়মিত হদিস রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। এই প্রযুক্তিতে বহু বন্ধ কারখানা কিংবা পরিত্যক্ত জমির জমা জল এবং আবর্জনার হদিস মেলা সম্ভব। নজর রাখতে হবে শহরের বিভিন্ন থানা সংলগ্ন কিংবা গ্যারাজ সন্নিহিত অঞ্চলে দাঁড়িয়ে থাকা বিকল মোটরগাড়ির ভিতরে জমা জলের উপরেও। শহর-শহরতলি জুড়ে উন্নত নিকাশি এবং জল সরবরাহ গড়ে না তুলতে পারলে জলবাহিত কিংবা মশাবাহিত সংক্রমণের হাত থেকে মুক্তি নেই।
‘মরণকালে হরিনাম’-এর মডেল নয়, জনসচেতনতা গড়ার ক্ষেত্রে ধারাবাহিক উদ্যোগ করতে হবে সরকার, পুরসভা এবং অসরকারি সামাজিক সংস্থাগুলিকে।