পশ্চিমবঙ্গে শিক্ষক নিয়োগ ঘিরে যে সব বিতণ্ডা, তাতে একটা খটকা লাগে। পুরো ব্যাপারটা একটিমাত্র প্রেক্ষিতে দেখা হয়: বহু মানুষের চাকরি আটকে যাচ্ছে। এটা অবশ্যই গুরুতর, কিন্তু আরও বড় একটা বঞ্চনা নিয়ে সকলে নীরব: শিক্ষকের অভাবে লক্ষ লক্ষ ছেলেমেয়ের লেখাপড়ার ক্ষতি হচ্ছে। একই সমস্যার দুই পিঠ, কিন্তু আমাদের দৃষ্টি একটাতেই আবদ্ধ।
অসন্তোষের বড় কারণ শাসককুলের তথ্য প্রকাশে তীব্র অনীহা— এ ক্ষেত্রে হবু শিক্ষকদের প্রাপ্ত নম্বর। এই লুকানো-ছুপানো সব সময় কুমতলবে নয়, বরং মজ্জাগত ভীতি আর গা বাঁচাবার তাগিদে— কিসে কী বিপত্তি হয়, অজানতে কোন ঘুঁটি কেঁচে যায়। ফলে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে জনগণকে দূরে রাখা, অন্ধকারে রাখা হয়ে দাঁড়ায় জনসেবকদের অভ্যস্ত পন্থা। এটা বিশেষ দল বা গোষ্ঠীর বৈশিষ্ট্য নয়, শাসকবর্গের ‘ডিফল্ট সেটিং’। এ দিকে তথ্যের অভাবে জনমানসে অবিশ্বাস-অনুমান-সন্দেহের পারদ তুঙ্গে ওঠে, লোকে এক দিকে মকদ্দমা অন্য দিকে বিক্ষোভ-প্রতিরোধের শরণ নেয়।
তথ্য কুক্ষিগত রাখার, ব্যাখ্যায় অপারগতার এই বিকারের ফলে ২০১৪ সালের নিয়োগ প্রক্রিয়া চলে ২০২১ অবধি, ২০১৭-র পরীক্ষার ফল আজও অঘোষিত থাকে। আদালতের ঠেলায় যে তথ্য কিস্তিতে বেরোচ্ছে, গোড়া থেকেই তা ষোলো আনা কর্তৃপক্ষের মজুতে, সেটাই শিক্ষক নির্বাচনের ভিত্তি। আয়তনে যতই বিশাল হোক, তার হিসাব কষা এবং ওয়েবসাইটে তুলে দেওয়ার প্রযুক্তিও মামুলি।
দল-মত-নির্বিশেষে শাসকের আর এক বিকার, আমাদের সব প্রাপ্তিকে তাদের কীর্তি বা বদান্যতা হিসেবে দেখানো। মেধার জোরে বা অধিকারবশত কেউ কিছু পেল, এমন ধারণা তারা আমল দেয় না, কারণ তার পরিবর্তে কিছু দাবি করা যায় না। নিয়মমাফিক নৈর্ব্যক্তিক ভাবে শিক্ষক নিয়োগ হচ্ছে, পরিচালনার এই স্বাভাবিক ছন্দে শাসকের লাভ নেই, যেমন আছে বলতে পারলে, “এতগুলি মানুষকে আমরা চাকরি দিলাম।” নিয়োগপদ্ধতি হয়তো ন্যায্য ও যথাযথ; কিন্তু সেটা বরদান বা দৈব অনুগ্রহের আদলে দেখালে নিয়োগপ্রাপ্তদের বশে আনা যায়।
গণতন্ত্রে শাসকরা নিজেদের স্বার্থেই নাগরিকদের সন্তুষ্ট রাখতে চায়; সেটাই গণতন্ত্রের মৌলিক শক্তি। মুশকিল হল, সন্তুষ্টির উপায় যেমন সত্যিকারের উন্নয়ন হতে পারে, তেমনই হতে পারে নানা মনোমোহিনী কৌশল— যাতে প্রজারা খুশি হয়, কিছু ব্যক্তির উপকারও হয়, কিন্তু বৃহত্তর সামাজিক মঙ্গল মান্যতা পায় না। শিক্ষক নিয়োগ হোক বা না হোক, শিক্ষার্থীদের স্বার্থ দুই ক্ষেত্রেই সমান অবান্তর।
সদ্য প্রকাশিত ইউডাইস রিপোর্ট বলছে, ২০১৯-২০’তে পশ্চিমবঙ্গে ছাত্র-শিক্ষক অনুপাত ছিল প্রাথমিকে ২৯:১, উচ্চ প্রাথমিকে ২৭:১; সারা ভারতে ২৬:১ ও ১৮:১। অর্থাৎ, শোচনীয় ঘাটতি সেই উচ্চ প্রাথমিক স্তরে, যা নিয়ে আজকের আলোড়ন। প্রাথমিকেও অবনতি হয়েছে— ২০১৫-১৬’তে রাজ্যে অনুপাত ছিল ২৫:১। ওই বছর বাংলায় ১৮.৮৭% শিক্ষক পদ খালি ছিল।
অভাব পূরণ করেছে নগণ্য বেতনের অস্থায়ী পার্শ্বশিক্ষক বাহিনী— ২০১৫-১৬’য় মালদহে ৪০%-এর বেশি পদে, দার্জিলিং আর উত্তর দিনাজপুরে প্রায় ৫০%। আমরা যে শুনি রাজ্যে প্রয়োজনের অতিরিক্ত শিক্ষক, তা এই পার্শ্বশিক্ষকদের ধরে। উপরন্তু স্কুলে-স্কুলে শিক্ষক বণ্টনে অসাম্যের চূড়ান্ত। ২০১৫-১৬ সালে মাত্র এক জন শিক্ষক ছিলেন বাংলার ৩.৭% স্কুলে; প্রাথমিকে ৪% অর্থাৎ ২,৭৭৪টায়, তার ১৪টায় দু’শোর উপর ছাত্র। (তার পর অবশ্য কিছু সামঞ্জস্য আনা হয়েছে।) এক বার শোনা গেল, রাজ্যের সরকারপোষিত স্কুলে মাধ্যমিক স্তরে গড়ে স্কুলপ্রতি এক জনও স্থায়ী অঙ্কের শিক্ষক নেই। এমনও শোনা গেল, মেয়েদের এক স্কুলে স্থায়ী শিক্ষকের সংখ্যা শূন্য। অন্তত গোঁজামিল দিয়ে তার বিহিত হল, যখন শিক্ষকের অভাবে মাধ্যমিক পরীক্ষা বন্ধ হওয়ার উপক্রম; প্রশাসনিক দাবি মান্যতা পেল— পঠনপাঠনের দাবির বদলে।
গত দশ বছরে বাংলার স্কুলপড়ুয়ারা, বিশেষত মেয়েরা, নানা সরকারি প্রকল্পে লাভবান হয়েছে। তার মধ্যে কন্যাশ্রী প্রকল্পটি অসাধারণ। বাস্তব উপকারের চেয়েও বড় এর মূল ভাবনা ও মডিউলার গঠন, যা নানা দিকে অল্পে অল্পে বাড়িয়ে অশেষ ফলপ্রসূ হতে পারে। উপরন্তু এর ভাবমূর্তিতে একটা মানবিক দায়বদ্ধতার ছাপ আছে, যা সরকারি প্রকল্পে বিরল। ‘সবুজ সাথী’র সাইকেল পেয়ে ছাত্রদের (আর উপরি লাভে অবশ্যই তাদের পরিজনের) চলাচলের সুবিধা ছাড়াও বিশেষ করে মেয়েদের যে আত্মপ্রত্যয় বেড়েছে, তার মূল্য কম নয়। পিছিয়ে-পড়া জনগোষ্ঠীর জন্য বিশেষ প্রকল্প চালু হয়েছে। এক কথায়, স্কুলপড়ুয়াদের বেশ কিছু আর্থসামাজিক ও মানসিক অবলম্বন মিলেছে, যা অত্যন্ত জরুরি ছিল। উন্নতি হয়েছে বহু স্কুলভবন ও কিছু বাহ্য পরিকাঠামোর— সর্বত্র সমান নয়, কোথাও আদৌ হয়নি হয়তো, তবু বলার মতোই উন্নতি।
প্রত্যেকটা উন্নতির দরকার ছিল, প্রত্যেকটা মূল্যবান। তবু ‘বাহ্য’ শব্দটা চলে এল। যে উন্নতি জরুরি কিন্তু দৃশ্যমান নয়, সেগুলির খতিয়ান মোটেও উজ্জ্বল নয়। কেরলে ৮৭% স্কুলে ইন্টারনেট আছে, দিল্লিতে ৮৫%, বাংলায় ১০%, উত্তরপ্রদেশের চেয়েও কম। শিক্ষক নিয়োগও কি ‘অপটিক্স’-এর অভাবে উপেক্ষিত? শিক্ষকদের ‘এই নাও চাকরি’ বলা চলে, ছাত্র-অভিভাবকদের ‘এই নাও শিক্ষা’ বলায় চটক নেই।
আসল সমস্যা মনোভাবের। তার এক শোচনীয় নজির— অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের মতো কলকাতা পুরসভার স্কুলগুলি করোনাকালে মিড-ডে মিলের সামগ্রী বিতরণ করছে। ভাগ্যিস করছে, নইলে কিছু শিশু না খেয়ে থাকত। কিন্তু সেই সঙ্গে যে পাঠসামগ্রী ও নির্দেশ দেওয়ার কথা, আট মাস ধরে তা বন্ধ রয়েছে। শিক্ষকরা ব্যস্ত পুরসভার অন্য কাজে।
অস্বস্তিকর তুলনা করা যায় দিল্লির সঙ্গে। সেখানকার বর্তমান রাজ্য সরকার স্কুলব্যবস্থায় বিপ্লব ঘটিয়েছে। বহু অভিভাবক বেসরকারি স্কুল থেকে সন্তানদের ছাড়িয়ে সেখানে ভর্তি করেছেন— লকডাউনে অভাবে পড়ে নয়, তার আগে থেকেই, স্রেফ সরকারি স্কুলগুলি ভাল বলে। বোর্ড পরীক্ষায় অভাবিত সাফল্য আসছে, আসছে উচ্চশিক্ষার প্রবেশিকায়। শিশুশ্রেণিতে পড়া-লেখা-গোনার ক্ষমতায় প্রভূত উন্নতি হয়েছে ‘মিশন বুনিয়াদ’-এর দরুন। অর্থাৎ, বাড়িঘর-পরিকাঠামোর পাশাপাশি লেখাপড়ার অগ্রগতিতে জোর দেওয়া হয়েছে। প্রত্যেকটা পদক্ষেপ শ্রমনিবিড়, অর্থাৎ যথেষ্ট শিক্ষকদের যথেষ্ট মাত্রায় উদ্বুদ্ধ করতে হয়েছে। বিশেষ প্রশিক্ষণ ও উৎসাহদানের কর্মসূচি আছে।
এই রূপান্তর বাংলায় না ঘটার কোনও প্রকৃতিগত কারণ নেই। যারা জানে তারাই জানে, প্রচুর শিক্ষক প্রচার ও রাজনীতি পরিহার করে সম্পূর্ণ নিজেদের উৎসাহে-উদ্যোগে নানা কাজ করে চলেছেন, এমনকি উদ্ভাবন ঘটাচ্ছেন, দিল্লিতে যা হচ্ছে সরকারি পদক্ষেপে। এমন শিক্ষক অনুপাতে কম হলেও সংখ্যায় নেহাত নগণ্য নন; উপযুক্ত পরিবেশে এই কর্মসংস্কৃতি ছড়িয়ে পড়তে বাধ্য। কিন্তু তার জন্য প্রথম দরকার শিক্ষকদের অপরিহার্যতা স্বীকার করা। স্কুলে-স্কুলে তাঁদের সুষ্ঠু স্বচ্ছ নিয়োগের ব্যবস্থা করা। ‘পাইয়ে দেওয়া’র উদ্দেশ্যে নয়, রাজনীতির ইন্ধন জোগাতে নয়, ছেলেমেয়েরা যাতে ঠিকমতো লেখাপড়া শিখে বাঁচতে পারে, একান্ত সেই তাগিদে।
তাগিদটা অচিরে আরও বাড়বে। বাংলার শিক্ষা পরিসংখ্যানে একটা উজ্জ্বল দিক, ২০২০ সালে প্রাথমিক ও উচ্চ প্রাথমিকে স্কুলছুট ছিল নগণ্য। লকডাউনের পর কিন্তু দেখা যেতে বাধ্য, বহু ছেলেমেয়ে স্কুলে ফেরেনি। ফাঁক পূরণ করতে নানা উদ্যোগ করতে হবে— প্রশাসনিক ও শিক্ষাগত। (অপ্রত্যাশিত হলেও মনে রাখতে হবে, যে রাজ্য এই বিষয়ে ইতিমধ্যেই ব্যবস্থা নিয়েছে তার নাম উত্তরপ্রদেশ।) দ্বিতীয়ত, দেখা যাবে, যারা ফিরছে তারা পাইকারি হারে পড়া ভুলে গিয়েছে, একেবারে খুদেরা আদৌ লিখতে-পড়তে-গুনতে শেখেনি।
খুদে পড়ুয়াদের বিশেষ তালিমের জন্য কেন্দ্রীয় সরকার একটা প্রকল্প বানিয়েছে, নাম ‘নিপুণ ভারত’। কিমাশ্চর্য, কোভিডকালে এর গুরুত্ব বাড়ানোর বদলে কোভিডের দোহাই দিয়েই কেন্দ্র নিপুণ ভাবে এটি দু’বছর পিছিয়ে দিয়েছে! বাচ্চাদের বয়স অবশ্য সে জন্য দু’বছর থমকে থাকবে না, ফাঁক গলে অনেকে আজীবন নিরক্ষর থেকে যাবে। তাতে কী, প্রভুদের অর্থ ও আপদ বাঁচল।
এমন দুর্যোগের মোকাবিলায় আবার ছাই ফেলতে ভাঙা কুলো সেই রাজ্য সরকার। শিক্ষার আকালের অশনিসঙ্কেত আকাশ জুড়ে। ত্রাণকার্যে শেষে হয়তো আরও প্রচুর পার্শ্বশিক্ষক, এমনকি স্বেচ্ছাশিক্ষককে নামাতে হবে, কিন্তু মূল বাহিনী হতেই হবে স্থায়ী প্রশিক্ষিত শিক্ষকের। নইলে ক্রমে মৌলিক শিক্ষার অভাবে অর্থনীতি তো বটেই, সামাজিক ব্যবস্থাগুলিও বিপর্যস্ত হবে। পড়ানো-শেখানোর কাজটা এখনও ফেলে রাখলে— সর্বনাশ।
ইমেরিটাস অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়