গত কয়েক মাসে অনেক বার শোনা গেল, বিজেপি ‘সোনার বাংলা’ গড়তে চায়। ‘সোনার বাংলা’ বলতে ঠিক কী বোঝায়, প্রশ্নটা মাথায় ঘুরছে। অর্থনৈতিক কিছু মানদণ্ডের নিরিখে দেখলে, পশ্চিমবঙ্গের অবস্থা অবশ্যই সুখকর নয়। ২০১৯-এর হিসেব অনুসারে পশ্চিমবঙ্গবাসীর গড় আয় বছরে ১,০১,১৩৮ টাকা, যা দেশের গড় জাতীয় আয়ের থেকে বেশ কিছুটা কম। গড় আয়ের নিরিখে রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলগুলির মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের স্থান ২৩ নম্বরে, যদিও মোট আয়ের নিরিখে পশ্চিমবঙ্গ ষষ্ঠ। ধান উৎপাদনে পশ্চিমবঙ্গ তৃতীয়, চা উৎপাদনে দ্বিতীয় ও আনাজ উৎপাদনে প্রথম। তা সত্ত্বেও গড় আয়ে পশ্চিমবঙ্গের এত নীচে থাকার কারণ বোধ হয় শিল্পায়নে পিছিয়ে থাকা, এবং তার সঙ্গে অতিরিক্ত জনসংখ্যার চাপ। আর একটি মানদণ্ডে পশ্চিমবঙ্গের স্থান খুব সুখকর নয়— ‘ইজ় অব ডুয়িং বিজ়নেস’-এ এই রাজ্য দেশে ১১ নম্বরে। শিল্পায়নে পিছিয়ে থাকা ও ‘ইজ় অব ডুয়িং বিজ়নেস’-এ পশ্চিমবঙ্গের স্থানের মধ্যে যোগসূত্রটা ভেবে বার করা কঠিন নয়। আর, স্বদেশি ও বিদেশি বিনিয়োগ টানার ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গের ব্যর্থতা ঐতিহাসিক।
এর সঙ্গেও পশ্চিমবঙ্গ সম্বন্ধে বিনিয়োগকারীদের ধারণা এবং ‘ইজ় অব ডুয়িং বিজ়নেস’ সূচকে পশ্চিমবঙ্গের স্থানের মধ্যে যোগসূত্র নিয়ে অনেক আলোচনা, লেখালিখি হয়েছে। আমি সেই চর্বিতচর্বণে আর যাব না।
শিক্ষাক্ষেত্রেও আমাদের রাজ্যের সেই কৌলীন্য আর নেই। প্রাথমিক শিক্ষা বেহাল, উচ্চশিক্ষায় দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলির মধ্যে প্রথম ত্রিশে রাজ্যের মাত্র দু’টি প্রতিষ্ঠান, আর কলেজগুলির মধ্যে প্রথম একশোয় মাত্র পাঁচটি। মেডিক্যাল কলেজগুলির মধ্যে প্রথম চল্লিশে রাজ্যের একটিও নেই। শিক্ষায় রাজনীতিকরণ বাম আমলে আমরা দেখেছি। দুর্ভাগ্য, এই আমলেও তার পরিবর্তন হয়নি। আন্তর্জাতিক র্যাঙ্কিং নিয়ে আর মাথা না ঘামানোই ভাল। রাজ্যের বাকি যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলি জাতীয় র্যাঙ্কিং-এ ভাল জয়গায় আছে, সেগুলির কোনওটাই রাজ্যের অনুদানে চলে না। সরকারি স্বাস্থ্য-পরিকাঠামোর যেটুকু উন্নতি হয়েছে, তা মোটামুটি কলকাতাকেন্দ্রিক। জেলার স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলির অবস্থা কাহিল। শুধু কার্ড বিলি করলেই স্বাস্থ্য ফিরবে কি? বড় জোর কিছু ভোট হয়তো আসতে পারে। পশ্চিমবঙ্গ যে বিগত কয়েক দশকে উন্নয়নের জোয়ারে ভেসেছে, এমন ভাবার কোনও কারণ নেই। তাই বাংলাকে এখন আর যা-ই হোক, ‘সোনার বাংলা’ বলা যায় না। রাজ্যবাসীকে ‘সোনার বাংলা’ গড়ার স্বপ্ন দেখিয়ে নির্বাচনে যাওয়ার সুযোগ কোনও কোনও রাজনৈতিক দলের তাই থেকেই যাচ্ছে।
একটি বিষয়ে বাংলা অন্যান্য রাজ্যকে ফেলে এগিয়ে যাচ্ছে— রাজনৈতিক হিংসা। বিগত পাঁচ বছরে অনেক রাজ্যে অনেক ধরনের নির্বাচন হয়েছে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের মতো রাজনৈতিক হিংসা আজকাল কোথাও হয় না। কয়েক মাস আগে বিহারেও বিধানসভা নির্বাচন হয়েছে। কিন্তু কোনও রাজনৈতিক হিংসা বা মৃত্যুর খবর কানে আসেনি। একটি রাজ্যের সাধারণ মানুষ যখন রাজনৈতিক দলগুলির উপর অত্যধিক নির্ভরশীল হয়ে পড়ে, তখন বুঝতে হয় যে, সেই রাজ্য অর্থনৈতিক ভাবে পিছিয়ে পড়ছে, সাধারণ মানুষের কাজের সংস্থান কমে আসছে। তাই জনসংখ্যার একটা বিপুল অংশকে রাজনীতি এবং রাজনৈতিক দলগুলির উপর নির্ভর করতে হচ্ছে। এবং তখনই রুজি-রোজগারের তাগিদে রাজনৈতিক হিংসায় মানুষ জড়িয়ে পড়ে। আবার রাজনৈতিক দলগুলিও চায় যে, একটি বিপুল জনগোষ্ঠী তাদের উপর নির্ভরশীল হয়ে থাকুক— যাতে বিভিন্ন সময় এই জনগোষ্ঠীকে তারা নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করতে পারে, মাঝে মাঝে ছোটখাটো কিছু সুবিধা দিলেই হল। অর্থাৎ, রাজনৈতিক দলগুলিও নিজেদের স্বার্থে অনুন্নত একটি ‘সিস্টেম’ চালু রাখতে পারে। অর্থনীতি ও সমাজবিজ্ঞানে এই তত্ত্ব এখন সুপ্রতিষ্ঠিত, এবং এই নিয়ে বেশ কিছু গবেষণাপত্রও আছে। তাই পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও হিংসার বাতাবরণ খুব ভাল কিছু ইঙ্গিত করে না।
উপরোক্ত বিষয়ের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গি ভাবে জড়িত বাংলার সাধারণ মানুষের ‘এক্সপোজ়ার’ এবং উচ্চাকাঙ্ক্ষার অভাব। এর জন্য দায়ী পশ্চিমবঙ্গের বিগত প্রায় পাঁচ দশকের রাজনৈতিক ইতিহাস। মানুষকে অল্পে সন্তুষ্ট থাকতে শেখানো হয়েছে। ১৯৯১-এর আর্থিক উদারীকরণের পর দেশের অন্যান্য প্রান্তের মানুষ যে অনেক বেশি এগিয়ে যাচ্ছে, এটাই পশ্চিমবঙ্গে অনেকে জানে না। আমাদের কী চাওয়া উচিত, বা কী চাইতে পারি, সে বিষয়ে সম্যক ধারণাই আমাদের অনেকের নেই। তাই বর্তমানে আমাদের এমন একটি সরকার দরকার, যারা মানুষকে অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান দেওয়ার পাশাপাশি নিজেদের পায়ে দাঁড়াতে সাহায্য করবে, রাজনীতি বা রাজনৈতিক দলগুলির উপর মানুষের নির্ভরশীলতা কমাবে ও একই সঙ্গে মানুষকে উচ্চাকাঙ্ক্ষী করে তুলবে। শিল্প আসবে, বিনিয়োগ আসবে, চাকরি আসবে। পশ্চিমবঙ্গের সাধারণ মানুষ উচ্চাকাঙ্ক্ষী হলে আশা করি কারও আপত্তি থাকার কথা নয়। অবশ্য এর জন্য চাই এমন একটি রাজনৈতিক দল, যার নেতা-নেত্রীদের ‘এক্সপোজ়ার’ আছে— দুনিয়ায় কোথায় কী হচ্ছে, সেটা যাঁরা জানেন। যাঁরা নিজেরা কূপমণ্ডূক, তাঁরা অন্যকে কী ভাবে উদ্বুদ্ধ করবেন?
‘সোনার বাংলা’ গড়তে গেলে যে-মানের রাজনৈতিক নেতা-কর্মী দরকার, তা কি আমরা পাচ্ছি? অর্থাৎ, রাজনৈতিক দলগুলি কি শিক্ষাগত যোগ্যতা দেখে তাদের প্রার্থী নির্বাচন করছে? না কি যেন তেন প্রকারেণ যাঁরা ভোট আনতে পারবেন, তাঁদের উপর বেশি নির্ভর করছে? নির্বাচনের সময় যে প্রশ্নটি সবার ভাবনায় আসা উচিত, তা হল— আমাদের মতো দেশে কেউ সক্রিয় রাজনীতিতে কেন আসেন? সাধারণ মানুষের সেবা করবেন বলে? আদর্শের তাগিদে? ক্ষমতা বা প্রচার ভালবাসেন বলে? নিজের আসল কাজের জায়গাটা দুর্বল হয়ে গিয়েছে বলে? না কি সেই ব্যক্তি এমন একটি পেশায় আছেন, যার জন্য রাজনৈতিক খুঁটির প্রয়োজন? না কি, এটিও আর পাঁচটা পেশার মতোই একটি পেশা? প্রশ্নটি তাৎপর্যপূর্ণ, কারণ আমাদের রাজ্য তথা ভারতের রাজনীতির পরিসরে সুনাগরিকের প্রবেশ ক্রমশ কমছে। আমার এই বক্তব্যে হয়তো অনেকে আপত্তি করবেন, কিন্তু কথাটি খুব অসত্য নয়। অতীতে আমরা মেঘনাদ সাহার মতো মানুষকেও গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে পেয়েছি। কিন্তু আজ সেই রকম উদাহরণ বিরল। বর্তমানে ক্ষমতার লোভ, নিজের আসল কাজের জায়গা দুর্বল হয়ে যাওয়া এবং রাজনৈতিক খুঁটির প্রয়োজনীয়তা, এই তিনটি কারণ প্রাধান্য পায় বলে মনে হয়। সেবা বা আদর্শের পরিসর অনেকটাই কমে এসেছে। এই মত আমার ব্যক্তিগত, কেউ ভিন্নমত পোষণ করতেই পারেন।
সেবা বা আদর্শ বাদ দিলেও, তর্কের খাতিরে, গণতান্ত্রিক রাজনীতিকে একটি পেশা হিসেবে দেখা যাক। আমি এক জন রাজনৈতিক চাকরিপ্রার্থী, জনগণের কাছে যাচ্ছি পাঁচ বছরের জন্য চাকরি বা পাঁচ বছরের ‘কনট্র্যাক্ট’ পেতে। আমার প্রতিদ্বন্দ্বীরাও চাকরিপ্রার্থী। যদি আমি নির্বাচিত হই, তা হলে পাঁচ বছরের জন্য চাকরি বা ‘কনট্র্যাক্ট’ পেলাম। এ বার আমার কাজ হবে, আমার চাকরিদাতা, অর্থাৎ জনগণের চাহিদামতো কাজ করা, যাতে পাঁচ বছর পর আবার ‘কনট্র্যাক্ট’ পাওয়া যায়। কিন্তু বর্তমানে যাঁরা রাজনীতিতে আসছেন, তাঁদের কত জন এই ভাবে ভাবছেন বা দেখছেন? রাজনীতিকে পেশা হিসেবে দেখুন, আপত্তি নেই— কিন্তু ঠিক ভাবে দেখুন। শুধু নিজের ক্ষুদ্র-স্বার্থের কথা না ভেবে জনগণের স্বার্থের কথা ভাবলে দেশের ভাল, আপনারও লাভ। জনগণের স্বার্থে কাজ করাটাই আপনার কাজ, তাদের বোকা বানানো নয়। এ ভাবে ভাবলেও হয়তো আমরা ‘সোনার বাংলা’ গড়ার দিকে এগোতে পারব।
অর্থনীতি বিভাগ, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়