প্রশ্ন হল, ইজ়রায়েলি ও প্যালেস্টাইনি জীবনের বিনিময়মূল্য কত
Israel Palestine Conflict

গণহত্যা অবিরাম চলেছে

ইজ়রায়েলের আত্মরক্ষার অধিকার আছে। প্যালেস্টাইনের মানুষের কি আত্মরক্ষার অধিকার নেই? এই প্রশ্নটা কেউ মুখ ফুটে উচ্চারণ করছে না।

Advertisement

পার্থ চট্টোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২৯ ডিসেম্বর ২০২৩ ০৮:০৭
Share:

দুঃসহ: আমেরিকার নাগরিক সমাজের এক বড় অংশ উত্তাল হয়ে উঠেছে সে দেশের যুদ্ধ-সমর্থনের প্রতিবাদে, নিউ ইয়র্ক, ১৬ ডিসেম্বর। রয়টার্স।

বহু চেষ্টার পর অবশেষে রাষ্ট্রপুঞ্জের নিরাপত্তা পরিষদে গাজ়ার যুদ্ধ নিয়ে একটি প্রস্তাব গৃহীত হল। কিন্তু তা এতই জোলো যে তার প্রায় কোনও কার্যকারিতা নেই। আমেরিকার নিরন্তর আপত্তির ফলে যুদ্ধবিরতির কথা তাতে রাখা গেল না। শুধু বলা হল, মানবিক প্রয়োজনে ত্রাণসামগ্রী আরও বেশি করে গাজ়ার মানুষকে পৌঁছে দিতে হবে। সাধু সঙ্কল্প। কিন্তু সে কাজটা যে এখনও করা যাচ্ছে না, তার কারণ তো ইজ়রায়েলের অবিরাম বোমাবর্ষণ আর গাজ়ার রাস্তায়-রাস্তায় পাড়ায়-পাড়ায় ট্যাঙ্ক আর বন্দুকধারী সৈন্যের তাণ্ডব। নিরাপত্তা পরিষদে প্রস্তাব পাশ হওয়ার পরমুহূর্তেই রাষ্ট্রপুঞ্জের সচিব আন্তোনিয়ো গুতেরেস বললেন, এতে কিছু হবে না। গোলাগুলি বন্ধ না হলে ত্রাণসামগ্রী সুষ্ঠু ভাবে বিতরণ করা সম্ভব নয়।

Advertisement

ইজ়রায়েলকে নিঃশর্ত সমর্থন জুগিয়ে যাওয়ার ফলে বিশ্ব কূটনীতিতে আমেরিকা আজ প্রায় সম্পূর্ণ একঘরে হয়ে পড়েছে। শুধু ইউরোপের দেশগুলোই নয়, কানাডা বা অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশও চাইছে, এখনই যুদ্ধ বন্ধ হোক। আমেরিকার এই অবিচল সমর্থনের কারণ কী? প্রথম কারণ, সে দেশে ইউরোপ থেকে আসা ইহুদিদের সংখ্যা আর গুরুত্ব। ১৯৩০-এর বছরগুলো থেকেই জার্মানি এবং অন্যান্য ইউরোপীয় দেশে প্রবল জাতিবিদ্বেষের হাত থেকে পালিয়ে আমেরিকায় উদ্বাস্তু হিসেবে আসতে থাকেন ইহুদিরা। কেবল সংখ্যাই নয়, আমেরিকার ব্যবসাবাণিজ্য, অর্থব্যবস্থা এবং বিভিন্ন পেশার শীর্ষস্থানে রয়েছেন ইহুদিরা। তাই ইজ়রায়েলের সঙ্গে রাজনৈতিক সম্পর্কও বরাবর খুব ঘনিষ্ঠ। সারা পৃথিবী অন্য কথা বললেও আমেরিকা ইজ়রায়েলের পক্ষ সমর্থন করে গেছে, অন্তত ৪৭ বার নিরাপত্তা পরিষদে ইজ়রায়েলকে বাঁচানোর জন্য ভিটো প্রয়োগ করেছে। তাই এ বারের ঘটনায় নতুন কিছু নেই।

এ ছাড়াও এখানে আরও গভীর এক সাংস্কৃতিক বন্ধন কাজ করে চলেছে। আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল শ্বেতাঙ্গ ইউরোপীয় অভিবাসীদের উপনিবেশ হিসেবে। আদি জনগোষ্ঠীদের উচ্ছেদ করে, বহুলাংশে হত্যা করে, তারা বসতি স্থাপন করেছিল। তাতেই সৃষ্টি হয়েছিল সেই কল্পকথা যে আমেরিকা হল খ্রিস্টান ইউরোপীয়দের উদ্দেশে ঈশ্বরের দান। ইজ়রায়েলের সৃষ্টির পিছনে যে জ়ায়নবাদ, তাতেও আছে বাইবেল-কথিত ‘মিথ’: ইজ়রায়েল ইহুদিদের ঈশ্বরদত্ত বাসভূমি, যেখান থেকে তাঁরা নির্বাসিত হয়েছিলেন প্রায় দু’হাজার বছর আগে। বিশ শতাব্দীর মধ্যভাগে, যখন সারা দুনিয়ায় উপনিবেশবাদের অবসান হতে চলেছে, তখন পশ্চিম এশিয়ার ভূখণ্ডে সেখানকার দীর্ঘকালের অধিবাসীদের উচ্ছেদ করে, তাঁদের বিরোধিতা অগ্রাহ্য করে, এক শ্বেতাঙ্গ ইউরোপীয় জনগোষ্ঠী কলোনি স্থাপন করছে, এমন আখ্যান শ্বেতাঙ্গ আমেরিকানদের হৃদয় স্পর্শ না করে যায় না। গত পঁচাত্তর বছর ধরে দুই দেশের নেতারা বলে আসছেন, আমরা তো এক, আমাদের ঐতিহাসিক অবস্থা এক, আমরা একে অপরকে বুঝি, তাই সমর্থন করি।

Advertisement

সাম্প্রতিক কূটনৈতিক শলাপরামর্শেও আমেরিকা-ইজ়রায়েল জোটবন্ধন জোরদার হয়েছে। ডোনাল্ড ট্রাম্প চিরাচরিত আমেরিকান অবস্থান ছেড়ে বিতর্কিত জেরুসালেম শহরকে ইজ়রায়েলের রাজধানীর স্বীকৃতি দেন। প্রবল ইরান-বিরোধিতার পাশাপাশি তিনি চেষ্টা চালিয়ে যান যাতে ইজ়রায়েলের সঙ্গে পার্শ্ববর্তী আরব দেশগুলির কূটনৈতিক ও আর্থিক সহযোগিতা প্রতিষ্ঠিত হয়। বাইডেন প্রশাসন ট্রাম্পের পথ থেকে এতটুকু সরেনি। বরং ওই অঞ্চলে রাশিয়া, চিন আর ইরানের প্রভাব কমানোর উদ্দেশ্যে ইজ়রায়েল-আরব সহযোগিতা আরও বাড়ানোর চেষ্টা করেছে। তা থেকে অনেকের মনেই এমন ধারণার সৃষ্টি হয়েছিল যে প্যালেস্টাইন সমস্যাটা যেন পার হয়ে আসা গেছে, তা অতীত ইতিহাস, আগামী দিনে তার আর কোনও তাৎপর্য থাকবে না। ৭ অক্টোবরের হামাস আক্রমণ সেই সুখস্বপ্ন ভেঙে চৌচির করে দিল।

ইজ়রায়েল ও আমেরিকার বক্তব্য, হামাস বাহিনীর নৃশংস আক্রমণের বিরুদ্ধে নিজেদের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করার অধিকার ইজ়রায়েলের আছে। সেই নিশ্চয়তা পাওয়া যাবে তখনই, যখন হামাস সম্পূর্ণ ভাবে নিষ্ক্রিয় হবে। কিন্তু হামাসের সেনারা গাজ়ার ঘনবসতি শহরগুলোয় সাধারণ মানুষের পিছনে আর মাটির নীচে সুড়ঙ্গে লুকিয়ে থাকে। কাজেই তাদের নির্মূল করতে হলে সাধারণ মানুষের জীবন বিপর্যস্ত হবেই। এমনকি বহু লোক মারাও যাবে। কত লোক? ইজ়রায়েলি আর প্যালেস্টাইনি জীবনের বিনিময়মূল্য কত? ইজ়রায়েলের হিসাব অনুযায়ী ৭ অক্টোবরের হানায় ১,১৩৯ জন ইজ়রায়েলির মৃত্যু হয়েছিল। ইজ়রায়েলের প্রতি-আক্রমণে গাজ়ায় আজ পর্যন্ত ২০,০০০ মানুষের প্রাণহানি হয়েছে। আমেরিকার নেতাদের কথায় মনে হয়, বদলার বিনিময়মূল্য স্থির করার অধিকার ইজ়রায়েলের। তারা যে দিন বলবে, যথেষ্ট হয়েছে, সে দিন যুদ্ধ থামবে। তার আগে আমেরিকা যুদ্ধ থামানোর চেষ্টা করবে না।

ইজ়রায়েলের আত্মরক্ষার অধিকার আছে। প্যালেস্টাইনের মানুষের কি আত্মরক্ষার অধিকার নেই? এই প্রশ্নটা কেউ মুখ ফুটে উচ্চারণ করছে না। গাজ়া এবং জর্ডান নদীর পশ্চিম তীর— প্যালেস্টাইনের দুই অংশেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় শেষ কথা বলে ইজ়রায়েলের পুলিশ আর সেনাবাহিনী। তাদের দেশে ইজ়রায়েলের অন্যায় দখলদারির বিরুদ্ধে প্যালেস্টাইনিদের কোনও মিটিং-মিছিল-সমাবেশ-ধর্মঘট, অর্থাৎ শান্তিপূর্ণ আন্দোলন গড়ে তোলার এতটুকু সু্যোগও নেই। সুতরাং অনিবার্য ভাবেই গড়ে উঠেছে সশস্ত্র জঙ্গি প্রতিরোধ। ওয়েস্ট ব্যাঙ্কে এক সময় ছিল ফতাহ গোষ্ঠী, গাজ়ায় এখন আছে হামাস। প্যালেস্টাইনিদের কোনও স্বীকৃত রাষ্ট্র নেই। অতএব কোনও স্বীকৃত সেনাবাহিনীও নেই। হামাসের জঙ্গিরা পেশাদার সৈনিক নয়। তাদের আলাদা কোনও ছাউনি, ব্যারাক বা ‘বেস’ নেই। সাধারণ মানুষের মধ্যে মিশে থেকেই তারা সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে, সাধারণ মানুষের পিছনে লুকিয়ে নেই।

সুতরাং গাজ়াকে হামাসমুক্ত করতে হলে তাকে জনশূন্য করে ফেলতে হয়। অথবা এমন অবস্থা তৈরি করতে হয় যে সেখানে বাস করা অসম্ভব হয়ে পড়ে। ইজ়রায়েলের যুদ্ধনীতি থেকে মনে হয় সেটাই তার প্রধান উদ্দেশ্য। উত্তর গাজ়া এখন প্রায় সবটাই ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে, তা একেবারেই বাসের অযোগ্য। মধ্য গাজ়াও দ্রুত সেই দিকে যাচ্ছে। সেখানকার মানুষ নিরুপায় হয়ে দক্ষিণে পালিয়ে এসেছেন। যেখানে আগে হয়তো এক-দেড় লক্ষ মানুষ থাকতেন, সেখানে এখন আশ্রয় খুঁজছেন প্রায় বিশ লক্ষ। সমস্ত গাজ়া জুড়ে ব্যবসা-বাণিজ্য সম্পূর্ণ বন্ধ, দোকান-বাজার বলতে কিছু নেই। খাদ্য নেই, জ্বালানি নেই। খোলা মাঠের মধ্যে তাঁবু খাটিয়ে হাজার হাজার মানুষ কোনও রকমে বেঁচে থাকার চেষ্টা করছেন। শীত এসে পড়েছে। রাষ্ট্রপুঞ্জের ত্রাণ সংস্থা বলছে, গত দু’মাসে তাদের একশোর বেশি কর্মী গাজ়ার বোমাবর্ষণে মারা গিয়েছে। যুদ্ধ বন্ধ না হলে তারা গাজ়ার মানুষকে প্রয়োজনীয় সাহায্য দিতে পারবে না। অথচ খাদ্য ও পানীয় জলের অভাব আর অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের জন্য সেখানে মহামারি আর দুর্ভিক্ষের আশু সম্ভাবনা।

সকলের মুখে তাই মানবিকতার কথাটাই সবচেয়ে বেশি শোনা যাচ্ছে। সন্দেহ নেই, টেলিভিশনের পর্দায় রোজ গাজ়ার যে অবর্ণনীয় দৃশ্য দেখা যাচ্ছে— বোমার আঘাতে, ভাঙা বাড়িঘরের নীচে চাপা পড়া মৃত পঙ্গু রক্তাক্ত শিশুদের ছবি, তাতে সারা বিশ্বের মানুষ বিচলিত হয়ে দাবি করছে, ‘এই সর্বনাশা হত্যালীলা বন্ধ করো’। এমনকি আমেরিকাও দু’ফোঁটা কুম্ভীরাশ্রু ফেলে স্বীকার করতে বাধ্য হচ্ছে, যুদ্ধ চললেও সাধারণ মানুষের কষ্ট লাঘবের জন্য কিছু করা উচিত। এর পর হয়তো দেখা যাবে, গাজ়ার বিপন্ন মানুষ আর সহ্য করতে না পেরে রাফা সীমান্তের গেট ভেঙে মিশরে যাওয়ার চেষ্টা করছেন। তখন এই আমেরিকান নেতারাই হয়তো বলবেন, মানবিকতার খাতিরে মিশর বা জর্ডান যেন গাজ়ার দুর্গতদের আশ্রয় দেয়। ইজ়রায়েলের নেতারা বলবেন, আপদ বিদেয় হল। গাজ়া এখন জনশূন্য। ওখানে শ্মশানের শান্তি বিরাজ করবে।

যুদ্ধবিরতি হল না। এর পর কী হবে? আমেরিকার নেতারা ঘোষণা করেছেন, যুদ্ধ শেষ হলে ইজ়রায়েলের পাশে প্যালেস্টাইনকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা হবে। এই হল ‘দুই রাষ্ট্র সমাধান’। প্যালেস্টাইন থেকে নতুন করে কোনও উদ্বাস্তু অন্যত্র পাঠানো হবে না। ইংরেজিতে একটা কথা আছে, কুকুর লেজ নাড়ে, না লেজ কুকুরকে নাড়ায়? বাইডেন প্রশাসনের হাবভাব দেখে মনে হয়, তারা প্রকাশ্যে বা গোপনে যতই ইজ়রায়েলকে সংযত হওয়ার উপদেশ দিক না কেন, নেতানিয়াহু সরকার জানে আমেরিকার রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ইজরায়েল-সমর্থকদের যা প্রভাব, তাতে তারা ইজ়রায়েলের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কিছুই করতে পারবে না। অতএব যত দিন প্রয়োজন, তত দিন ইজ়রায়েল যুদ্ধ চালিয়ে যেতে পারবে।

অন্য দিকে প্যালেস্টাইনের মানুষ বিশ্বাস করেন, তাঁদের উপর ইজ়রায়েলি আধিপত্যের বিরুদ্ধে যে কোনও প্রয়োজনীয় উপায়ে প্রতিরোধের ন্যায্য অধিকার তাঁদের আছে। গত পঁচাত্তর বছর ধরে তাঁরা প্রতিরোধ করে আসছেন। এটা নিশ্চিত, আজ গাজ়ায় যে গণহত্যা চলেছে, তার মধ্যে দিয়ে প্যালেস্টাইনি মুক্তিযোদ্ধাদের পরবর্তী প্রজন্মের জন্ম হল। আগামী দিনে তারাই সেই লড়াই চালিয়ে যাবে। প্যালেস্টাইনের মুক্তিযুদ্ধ থামবে না।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement