Religions

ধর্মবিশ্বাস কি বিজ্ঞানবিরোধী

বিজ্ঞানের সর্বজনগ্রাহ্য রূপ হল, কোনও ধারণা সত্য হলে তা পরীক্ষালব্ধ তথ্যের দ্বারা যাচাই করা। অন্যথায় সেটি গ্রহণযোগ্য নয়।

Advertisement

শুভঙ্কর ঘোষ

শেষ আপডেট: ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ০৬:৩৪
Share:

—প্রতীকী চিত্র।

সম্প্রতি ভারতের চন্দ্রাভিযানের প্রাক্কালে ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান ও চাঁদে অবতরণ স্থলের ‘শিবশক্তি’ নামকরণ নিয়ে বিতর্ক অব্যাহত। ইসরো প্রধান শ্রীধর পানিকর সোমনাথ কেন মন্দিরে পূজা দিলেন, তা নিয়ে আক্রমণ চলেছে একেবারে ব্যক্তিগত স্তরেও। সোমনাথ বলেছেন, তিনি পরিব্রাজক— কখনও বহির্জগতের, কখনও অন্তর্জগতের; তাঁর মন কখনও মহাবিশ্বের রহস্য অনসন্ধান করে, কখনও আবার ঈশ্বরের কাছে আত্মনিবেদনের মাধ্যমে শক্তি পায়। বিজ্ঞানের ইতিহাসে এটি নতুন নয়। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের প্রথম সারির বহু বিজ্ঞানী উচ্চমার্গের গবেষণার সঙ্গে সঙ্গে ব্যক্তিজীবনে ধার্মিক আচার পালনে নিষ্ঠাবান ছিলেন, ঈশ্বরবিশ্বাসী ছিলেন।

Advertisement

ভারতীয় গণিতজ্ঞ শ্রীনিবাস রামানুজন ছিলেন গভীর ভাবে ধার্মিক। তিনি নামাগিরি দেবীর ভক্ত ছিলেন ছোটবেলা থেকেই। রামানুজনের প্রতিভাকে বিশ্বের সামনে তুলে ধরার অন্যতম কারিগর ছিলেন কেমব্রিজের গণিতজ্ঞ গডফ্রে হ্যারল্ড হার্ডি, যিনি ছিলেন আবার ঘোর নাস্তিক। হার্ডির কৌতূহল ছিল রামানুজন গণিতের কঠিনতম সমীকরণ ও অন্যান্য ধারণা করেন কী ভাবে। শোনা যায়, রামানুজন বলেছিলেন, নামাগিরি দেবী তাঁর কানে বলে দিয়ে যান স্বপ্নের মধ্যে। তেমনটা আদৌ হতে পারে কি না, সে অনুসন্ধান নিষ্প্রয়োজন। শুধু এটুকুই বলার যে, রামানুজনের ধর্মবিশ্বাস কেমন ছিল, তিনি কতটা নিয়ম পালন করতেন, সে সব প্রশ্নের সঙ্গে তাঁর প্রতিভা বা গণিতশাস্ত্রে তাঁর অবদানের কোনও সম্পর্ক নেই— বিরোধও নেই, সঙ্গতিও নেই।

পাকিস্তানের প্রথম নোবেলজয়ী পদার্থবিজ্ঞানী আবদুস সালামের জীবনের একটি ঘটনা উল্লেখ করি। বিশ্বজগতে চারটি মৌলিক বল কাজ করে— মহাকর্ষ বল, তড়িৎচৌম্বকীয় বল, দুর্বল বল এবং শক্তিশালী বল। শেষের দু’টি পরমাণু জগতের মধ্যে ক্রিয়াশীল। চারটি বলকে পারস্পরিক সম্পর্কযুক্ত করাটা পদার্থবিজ্ঞানীদের কাছে একটি বড় চ্যালেঞ্জ। তড়িৎ ও চৌম্বক যে একই বল, সেটার তাত্ত্বিক ধারণা প্রথম করেছিলেন জেমস ক্লার্ক ম্যাক্সওয়েল। ঠিক তেমনই, তড়িৎচৌম্বকীয় ও দুর্বল বল দু’টি যে একই, তা প্রমাণ করেছিলেন সালাম, শেল্ডন লি গ্লাশো ও স্টিভেন ভিনবার্গ। সালাম উল্লেখ করেছেন যে, একীভূত বলের ধারণা করতে নিজের গভীর ধর্মবিশ্বাস থেকে প্রেরণা লাভ করেছেন তিনি।

Advertisement

পদার্থবিদ্যায় ভারতের প্রথম নোবেলজয়ী সি ভি রমন ছিলেন অজ্ঞেয়বাদী। উপবীত ধারণ করেছেন আজীবন, নিজেকে ধার্মিক বলতে দ্বিধা করেননি। মহাত্মা গান্ধী ও প্রাণিবিজ্ঞানী গিলবার্ট রামের সঙ্গে কথোপকথনে রমন বলেছিলেন, “ঈশ্বর থাকলে বিজ্ঞান তাঁকে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে সন্ধান করবে। না থাকলে তিনি সন্ধানের যোগ্য নন।” অন্য দিকে, আলবার্ট আইনস্টাইন কখনও ঈশ্বরের অস্তিত্ব মানেননি। কিন্তু ধর্মাচরণ বা ঈশ্বরবিশ্বাসী মানুষের সঙ্গে কথোপকথনে, নিজের নানা লেখায় তিনি কৌতূহলী ছিলেন মহাবিশ্বের প্রকৃতির সত্যানুসন্ধানে। আইনস্টাইন রবীন্দ্রনাথকে প্রশ্ন করেছিলেন: বিশ্বজগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন, এমন দৈবিক সত্তায় কবি বিশ্বাস করেন কি না। উত্তরে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, বিচ্ছিন্ন নয়, তিনি বিশ্বাস করেন মানবিক বিশ্বজগতে, যার মূল সত্য মানুষ। উদাহরণস্বরূপ, বস্তু হয়তো বাইরে থেকে নিরেট, কঠিন; কিন্তু ভিতরে থাকা ইলেকট্রন প্রোটনের মধ্যে কত না ফাঁকা স্থান সেখানে। তেমনই মানুষ হিসাবে প্রত্যেকে আলাদা, কিন্তু মানবিক সম্পর্কের দ্বারা তারা শৃঙ্খলিত হয়ে বিশ্বজগৎ তৈরি করেছে। তাই মনে হয়, দু’জনেই যেন মহাবিশ্বে আমি একা ‘ভ্রমি বিস্ময়ে’ মুগ্ধ।

ধর্ম, ঈশ্বর বিশ্বাস ছাড়াও বিজ্ঞানজগতে এসেছে রক্ষণশীল সংঘাতের আবহ। আমেরিকান বিজ্ঞানী ও জনপ্রিয় লেখক কার্ল সাগান বহির্বিশ্বে প্রাণের অস্তিত্ব আছে কি না, তা নিয়ে বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানের কাজে নানা সময় বিভিন্ন প্রতিকূলতার সম্মুখীন হয়েছিলেন। এক সময় তাঁকে বলতে হয়েছিল, “প্রমাণের অনুপস্থিতি কিন্তু কোনও কিছুর অনুপস্থিতির প্রমাণ নয়।”

বিজ্ঞানের সর্বজনগ্রাহ্য রূপ হল, কোনও ধারণা সত্য হলে তা পরীক্ষালব্ধ তথ্যের দ্বারা যাচাই করা। অন্যথায় সেটি গ্রহণযোগ্য নয়। কিন্তু, সমাজ বা রাজনীতির হাতে ততখানি সময় থাকে না, ফলে বিজ্ঞানের উপর চলে আসে রাষ্ট্রের কর্তৃত্ব— যথোপযুক্ত পরীক্ষানিরীক্ষার বদলে বলপূর্বক সনাতনধর্মী আচার পালনের বাধ্যবাধকতা। দ্বন্দ্ব শুরু হয় বিজ্ঞান বনাম সায়েন্টিজ়ম-এর। দ্বিতীয়টি ধর্মাচরণের খারাপ দিকের মতো বিজ্ঞানের খারাপ দিক। স্বাভাবিক ভাবেই এই পরিসরে জায়গা করে নেয় অপবিজ্ঞান। থালা বাজানো, গোমূত্রপান করে ভাইরাস ঠেকানোর নানা নিদান। সেই অপবিজ্ঞানের বিরোধিতা করা জরুরি, কিন্তু তার জন্য বিজ্ঞানীর নিজস্ব ধর্মবিশ্বাসকে আক্রমণ করার দরকার নেই। ধর্ম বা বিজ্ঞান, কোনও গোঁড়ামি থেকেই অযথা আক্রমণাত্মক হলে তা শুধু যে বিজ্ঞানের বিকাশের জন্য প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে তা নয়, মানবতার পক্ষে ভয়ঙ্কর হবে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement