অবস্থান: দিল্লির উপকণ্ঠে হাইওয়েতে পথ অবরোধ করলেন বিক্ষোভরত কৃষকরা। ৬ ফেব্রুয়ারি। রয়টার্স
সিংঘু, গাজ়িপুর, টিকরি, ঢাকা, রাজশাহী, ত্রিপুরা, সিরাজগঞ্জ, কখন যেন একাকার হয়ে গেল! এক দিকে পুলিশের ব্যারিকেড, লাঠি, জলকামান, পেরেক কণ্টকিত রাজপথ, প্রবল ঠান্ডা ও সরকারি রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে সেই রাজপথে হাজার হাজার কৃষকের সমাবেশ, আর অন্য দিকে খলিস্তানি, দেশদ্রোহী, মাওবাদী, আন্দোলনজীবী তকমা দিয়ে সেই বিক্ষোভ তছনছ করে দেওয়ার লাগাতার চেষ্টা— কত কিছুর সাক্ষী থাকতে হচ্ছে গত কয়েক সপ্তাহ ধরে।
কিন্তু শাহি দিল্লির উপকণ্ঠে গত বেশ কিছু দিন ধরে যা ঘটে চলেছে, তার সঙ্গে ঢাকা, রাজশাহীর প্রসঙ্গ টেনে আনা কেন?
তার কারণ, বিতর্কিত কৃষি আইন প্রত্যাহারের দাবিতে অনড় কৃষকদের এই বিক্ষোভ ভাঙতে দিল্লীশ্বরেরা যা যা করছেন ও করে চলেছেন, তা দেখতে দেখতে কয়েক শতক আগের আরও এক কৃষক বিদ্রোহের কথা মনে পড়ে যায়। ইংরেজের শোষণের বিরুদ্ধে ভারতের কৃষক সমাজ সে যুগেও গর্জে উঠেছিল। ভারতের ইতিহাসে যা ‘সন্ন্যাসী বিদ্রোহ’ নামে খ্যাত। এই বিদ্রোহ শুরু হয় ১৭৬৩-তে। দফায় দফায় তা চলে ১৮০০ সাল পর্যন্ত। বিদ্রোহের আগুন জ্বলেছিল গোটা বাংলা ও বিহার জুড়ে।
তৎকালীন গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংস প্রথম এই কৃষক বিদ্রোহকে ‘সন্ন্যাসী বিদ্রোহ’ বলে আখ্যা দেন। তাঁর ব্যাখ্যা ছিল, এটি হিন্দুস্থানের যাযাবরদের পেশাদারি উপদ্রব ও ডাকাতি। এ কালে বেঁচে থাকলে নিঃসন্দেহে হেস্টিংস কৃষকদের ‘বহিরাগত’ আখ্যা দিতেন! তাঁর এহেন ব্যাখ্যার পিছনে অবশ্যই অন্য কারণ ছিল। তিনি প্রমাণ করার চেষ্টা করেছিলেন, আসলে বাংলা ও বিহারের কৃষকেরা প্রথম থেকেই ইংরেজ বণিক তথা ইংরেজ শাসনকে মেনে নিয়েছেন, ধরে নিয়েছেন, ইংরেজ শাসকেরা তাঁদের ত্রাণকর্তা। যদিও ওয়ারেন হেস্টিংসের ওই প্রচারকে মিথ্যা ধারণা সৃষ্টির প্রয়াস বলে আখ্যা দিয়েছিলেন বেশ কয়েক জন ব্রিটিশ ইতিহাসবিদ।
গোটা ঘটনাক্রম চেনা চেনা ঠেকছে, তাই না?
আরও একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। পার্বত্য চট্টগ্রামে ১৭৭৬ সালে শুরু হয়েছিল কৃষক বিদ্রোহ। দফায় দফায় এই বিদ্রোহ চলে প্রায় ১৭৮৭ পর্যন্ত। ইংরেজ শাসক ও ইজারাদারদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে চাকমারা গেরিলা যুদ্ধের কৌশল নেন। পাহাড়ে গভীর জঙ্গলের মধ্যে কৌশলে ইংরেজ ও ভারতীয় সেনাকে টেনে নিয়ে গিয়ে আক্রমণ চালাতেন চাকমারা। শেষে পার্বত্য চট্টগ্রামে ইজারা প্রথা রদ করতে বাধ্য হয় ইংরেজ শাসকেরা।
শুধু এই দু’টিই নয়, ইংরেজ বণিক সম্প্রদায় ও ইংরেজ শাসক গোষ্ঠী বারে বারেই মুখোমুখি হয়েছে সশস্ত্র কৃষক বিদ্রোহের। কৃষকেরা সশস্ত্র বাহিনী গঠন করেছেন, রীতিমতো সামরিক প্রশিক্ষণ নিয়েছেন গহন অরণ্যে। নানা সময়ে আশ্রয় নিয়েছেন গেরিলা যুদ্ধের। অসংখ্য প্রাণহানি হয়েছে দু’পক্ষে। যেমন, যশোর-খুলনার প্রজাবিদ্রোহ। ১৭৮৪ সালে শুরু হয় এই বিদ্রোহ।
লবণ ও বস্ত্রের ব্যবসার নামে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি যে শোষণ শুরু করে, তাতে যশোর ও খুলনার হাজার হাজার কৃষক কয়েক বছরের মধ্যেই জমিহারা হয়ে যান। অসংখ্য কৃষক গৃহহারা হন। তাঁদেরই অনেকে স্থানীয় জমিদারদের সঙ্গে মিলে ইংরেজদের বিরুদ্ধে বোঝাপড়ার জন্য লাঠি ও অন্যান্য অস্ত্রশস্ত্র হাতে তুলে নেন। কৃষকনেতা ‘ডাকাত সর্দার’ হীরাকে গ্রেফতার করে খুলনার জেলে পাঠানো হলে তাঁকে মুক্ত করার জন্য কয়েকশো কৃষক জেলখানা আক্রমণ করেন।
এর পর ১৭৮৪-তে নড়াইলের জমিদার কালীশঙ্কর রায় রীতিমতো কৃষক বাহিনী তৈরি করে ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যান। ১৭৯৬ সালে ইংরেজরা কালীশঙ্করকে জেলবন্দি করে। কিন্তু এ কথা ছড়িয়ে পড়তেই যশোর ও খুলনার বিরাট অংশে তীব্র কৃষক বিদ্রোহ শুরু হয়। ইংরেজ শাসকেরা বাধ্য হয়ে কালীশঙ্করকে মুক্তি দেয়। এমনকি, তাঁর খাজনার পরিমাণ কম করে তাঁর সঙ্গে বিবাদ মেটাতেও বাধ্য হয় তারা।
শুধু তৎকালীন ব্রিটিশ রাজত্বের পূর্বাঞ্চল নয়, দক্ষিণ ভারতের দিকে তাকালে দেখব সেখানেও রয়েছে গণবিদ্রোহের ইতিহাস। কেরলের মালাবার অঞ্চলে ১৯২১-২২ সালে মোপলা গণবিদ্রোহের সময়েও ব্রিটিশ ও ভূস্বামীদের সঙ্গে কৃষকদের সংঘর্ষে বেসরকারি হিসেবে প্রায় ১০ হাজার মানুষের প্রাণহানি ঘটেছিল। সরকারি হিসেবে ৪৫ হাজারেরও বেশি মানুষকে জেলবন্দি করা হয়।
এখানে একটি বিষয় স্পষ্ট করা দরকার। যে সব কৃষক বিদ্রোহের উল্লেখ এখানে করা হয়েছে, সে সবই সশস্ত্র বিপ্লব। রীতিমতো বাহিনী তৈরি করে, যুদ্ধের কৌশল মেনে বছরের পর বছর ইংরেজ বণিক ও শাসকের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিদ্রোহ চালিয়ে গিয়েছেন কৃষকেরা। তা হলে দিল্লি সীমান্তে সম্পূর্ণ অহিংস আন্দোলনের প্রসঙ্গে এ দেশে কৃষক বিদ্রোহের ইতিহাসের পাতায় চোখ রাখা কেন?
এর কারণ, এ দেশে নিজেদের শাসন কায়েম করতে চাওয়া ইংরেজ বণিক গোষ্ঠীর একটা চেষ্টা ছিল, বিক্ষোভ বা বিদ্রোহের সুর শুনলেই যেন তেন প্রকারেণ তা একেবারে ধ্বংস করে দেওয়া। কোনও অবস্থায় সেই সুর যেন ক্ষমতা করায়ত্ত করার পথে বাধা হয়ে না দাঁড়ায়। কিন্তু আজকে প্রশ্নটা আলাদা— সম্পূর্ণ গণতান্ত্রিক পন্থায় চলা অহিংস আন্দোলন নির্মূল করতে একটি নির্বাচিত সরকার আদৌ এমন নির্বিচার দমনের পথ নেবে কেন? শুধু ২৬ জানুয়ারির কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা দিয়ে কি একে ব্যাখ্যা করা যায়?
কেনই বা জনপ্রতিবাদের সামনে রাষ্ট্র এত অসহিষ্ণু হয়ে পড়বে? কেন কৃষকদের এই আন্দোলনের উপর এমন কদাকার ভাবে যা খুশি তকমা লাগানো হবে? শুধু পুলিশ, জলকামান, ব্যারিকেড, পেরেকই নয়, আন্দোলনকারীদের মনোবল ভেঙে দিতে প্রাত্যহিক শৌচকাজের জন্য প্রয়োজনীয় জলের সরবরাহও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এটাই গণতান্ত্রিক কাঠামো বজায় রাখার মডেল? ‘সোনার দেশ’-এ নাগরিক অধিকারের সুব্যবস্থা? ‘এক দেশ এক আইন’-এর মডেল?
কোনও গণতান্ত্রিক আন্দোলন যদি অহিংস থেকে সহসা হিংস্র হয়ে ওঠে, যদি তার জন্য গণতান্ত্রিক পরিকাঠামো ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়, সেই ক্ষেত্রে যে কোনও সরকার নিয়ন্ত্রিত বলপ্রয়োগ করতে পারে। কিন্তু অহিংস কোনও কৃষক আন্দোলনকে ভাঙতে যে ভাবে দেশদ্রোহিতার মোড়ক দেওয়া হচ্ছে, সুকৌশলে মিশিয়ে দেওয়া হচ্ছে দেশপ্রেমকে, কাজে লাগানো হচ্ছে জাতীয় তদন্তকারী সংস্থাকে (আইএনএ), তাতে সন্দেহ জাগে, প্রবল জনসমর্থন নিয়ে ক্ষমতায় আসা কোনও সরকার কি স্রেফ কর্পোরেট স্বার্থের কাছে নিজেদের বিকিয়ে দিতে বসেছে?
কৃষক আন্দোলনের সমর্থনে গ্রেটা থুনবার্গের শেয়ার করা ‘টুলকিট’ ছড়িয়ে দেওয়ার অভিযোগে বেঙ্গালুরু থেকে ২১ বছরের পরিবেশকর্মী দিশা রবিকে গ্রেফতার করেই বা কোন বার্তা দিতে চাইছে মোদী সরকার? যদি খলিস্তানপন্থী কোনও সংগঠনের টাকা এই আন্দোলনে কাজে লাগানো হয়, যদি কোনও খলিস্তানি জঙ্গি এই আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত থাকে, তা তদন্ত করে দেখে অভিযুক্তকে গ্রেফতার করার মতো যথেষ্ট আইনি পরিকাঠামো এই রাষ্ট্রের হাতে রয়েছে। তার জন্য সমগ্র গণতান্ত্রিক পরিবেশ এ ভাবে নষ্ট করার প্রয়োজন হয় না।
ভীমা কোরেগাঁও, হাথরস থেকে শুরু করে এ পর্যন্ত, বিন্দুমাত্র বিরুদ্ধ স্বর শুনলেই যে সরকারের রাতের ঘুম চলে যায়, সেই সরকারের কি জনপ্রতিনিধিত্বের গর্ব করা সাজে?