—ফাইল চিত্র।
পয়লা আষাঢ় পার হলেও বর্ষার দেখা নেই। সিকিমে কিছু বৃষ্টি হয়েছে যা এই সময়ের পক্ষে স্বাভাবিক। তাতে সিকিম ও উত্তরবঙ্গের অন্যতম প্রধান নদী তিস্তা বন্যার জলে ত্রাসমূর্তি ধারণ করেছে। সংবাদে বলা হচ্ছে: তিস্তার গ্রাসে ঘরবাড়ি, প্রলয়ঙ্করী তিস্তা ইত্যাদি। এখন আমরা অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছি— বর্ষার শুরু থেকেই সবচেয়ে ছোট নদীগুলোতেও বিপুল জলস্ফীতি হবে। তারা কূল ছাপিয়ে দু’পাশের জনপদ, ঘরবাড়ি ভেঙে ভাসিয়ে চলে যাবে। খবর-সঙ্গী ছবিতে দেখা যাবে, নদীর খাত থেকে ফুলে ওঠা জল দুই পাড়ের গা ঘেঁষে থাকা যে ঘরবাড়ি ডুবিয়েছে, তার সব চালাঘর বা ঝুপড়ি নয়। এখন আর কারও মনে এ প্রশ্নও জাগে না যে, নদীর স্বাভাবিক জল ছড়াবার এলাকার মধ্যে এই সব নির্মাণ কী ভাবে হয়। কারণ এর উত্তর এখন একটা ছোট বাচ্চাও জানে। বর্ষার সময় নদীর জলস্ফীতির কথা সকলেই জানে, তবু নদীর কিনার ঘেঁষে দোকান, সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল, কলেজ আর বর্তমানের নতুন দেবস্থান, আবাসন, হবে। হয়।
আগে শোনা যেত বর্ষার বন্যায় নদীর পার্শ্ববর্তী জমিগুলোতে জলের সঙ্গে নেমে আসা পলি পড়ে, ফলে পরের অন্তত দু’বছর ফসল খুব ভাল হয়। এখন আর সে রকম ব্যবস্থা নেই। বারো মাসই দরকার হলে পাম্পে ভূ-জল টেনে সেচ দেওয়ার সুবিধা আছে, সুতরাং নদীর জল বা বৃষ্টিজলের সেচের কথা ভাবার প্রয়োজন নেই কৃষিকাজে। পর পর বাঁধের পিছনে বন্দি নদীর পলি-বালি নদীর মাঝখানে জমা হয়। দুই-তিন দিন বৃষ্টি হলে বালি-ভরাট নদী কূল ছাপাতে বাধ্য। নদীপথ বন্ধ বলে সে জল দ্রুত নেমে যায় না। জলকাদা জমে থাকে। ত্রাণের ব্যবস্থা পাকা। ত্রাণ আসে। বর্ষার সঙ্গে নদীজলের, নদীজলের সঙ্গে বন্যার, তার সঙ্গে কৃষি বা নৌ-যাতায়াতের দীর্ঘকালের গড়ে ওঠা সম্পর্ক এখন এক বিস্মৃত বিষয়। অথচ বৃষ্টি প্রতি বছরই আসে। নির্দিষ্ট সময়েই আসে। বৃষ্টিই পৃথিবীতে মিঠে জলের প্রধান নির্ভরযোগ্য আকর, এ কথা এখনও অনেক আগেকার মতোই সত্যি।
পৃথিবীর তিন ভাগ জলের বিস্তার সত্ত্বেও ব্যবহারযোগ্য মিঠে জল যে অতি সামান্য, যতটুকু আছে তা-ও জমাট বেঁধে থাকে মেরুপ্রদেশ ও পর্বতশিখরের হিমবাহে, এই সতর্কবাণীর সঙ্গে সঙ্গে প্রকৃতির নিজস্ব নিয়মিত বিপুল জল সরবরাহ ব্যবস্থার কথা ছোটবেলার ভূগোল ক্লাসে কেন শেখানো হয়নি, সে কথা এখন ভাবায়। যাঁদের দেশের প্রাথমিক শিক্ষা অনুযায়ী উপনিবেশের শিশুশিক্ষা প্রবর্তিত হয়েছিল, তাঁদের দেশে অমন নিয়মিত ‘রাজবদুন্নতধ্বনি’র রাজার ন্যায় উন্নত গম্ভীর ধ্বনিকারী বর্ষাকাল না থাকাই কি এর কারণ? সে কথা জানি না ঠিকই, কিন্তু একটা কথা বেশ স্পষ্ট, বিনামূল্যে বা সহজে প্রাপ্ত যে কোনও বস্তুর মতো বৃষ্টিও আমাদের নাগরিক মানসে তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়। কম-বেশি হলেও আমাদের কলের জল আছে।
আধুনিক শহরে বৃষ্টি বরং কিছুটা অবাঞ্ছিত অতিথি। আমরা কোনও মতেই তার জন্য প্রস্তুত থাকি না। এমনকি ইদানীং শহরের ধরনধারণ দেখলে ভিন দেশের বা ভিন গ্রহের কারও মনে হতেও পারে যে বর্ষাকাল বলে বিষয়টাকে আমরা বিশ্বাসই করি না। আকাশ থেকে ঝেঁপে জল পড়ে এবং সেই প্রচুর পরিমাণ জল সর্বদাই ঢালুর দিকে গড়িয়ে যায়— এ কথাতেও পূর্ত ও নগরোন্নয়ন বিভাগ আস্থা রাখে না।
অথচ জলের নিয়ম ক্রমাগত নিচু দিকে গড়িয়ে যাওয়া। সেই নিয়মের দরুনই স্থলভাগকে ঘিরে অতল মহাসাগর, সাগরের রক্ষাবন্ধন আর স্থলের উপরে লক্ষ লক্ষ প্রাণরক্ষক জলাশয় তৈরি হয়েছে। সভ্যতার শুরু থেকে মানুষও নানা ভাবে আকাশ থেকে ঝরে পড়া বৃষ্টিজলকে ধরে রাখতে মাটিতে ছোট-বড় গর্ত খুঁড়েছে। বৃষ্টির জল সেখানে সঞ্চয় করে নিত্যদিনের প্রয়োজনীয় সমস্ত কাজ নির্বাহ করেছে। শুধু তা-ই নয়, মানুষ জানুক বা না-জানুক, বিভিন্ন জলক্ষেত্রের জমা জল চুইয়ে মাটির নীচে ঢুকে পড়েছে। বেড়েছে ভূ-জলের ভান্ডার।
এ বিষয়ে নিয়মিত উদাসীনতার ফলে গত এক দশক ধরে দু’-তিন ঘণ্টা শহরে মোটামুটি স্বাভাবিক বৃষ্টি পড়লেও জল জমা শুরু হচ্ছে। প্রবল বৃষ্টিতে কলকাতা-সহ কিছু শহরের নিচু অংশে জল আগেও জমত, কিছু পরে তা নেমেও যেত। এখন প্রায় পুরো শহরেই জল জমে এবং তা বেরোতে পারে না। এর কারণ আমরা সকলেই জানি— জল বয়ে যাওয়ার জায়গা খালি না রেখে উঁচু রাস্তা এবং পাকা বাড়িঘর যে কোনও উদ্দেশ্যেই তৈরি করে ফেলা, সেই সঙ্গে খোলা জায়গা অর্থাৎ কাঁচা মাটি কংক্রিটে ঢেকে দেওয়া। স্বাভাবিক ভাবেই বৃষ্টিজল মাটির নীচে চলে যাওয়ার পথ বন্ধ। কলকাতা শহরে যত দূর ট্রাম চলত, তত কিলোমিটার গুণিত এক মিটার খোলা মাটির ঘাসে ঢাকা এলাকা দিয়ে প্রচুর জল মাটির নীচে যেত। মাটির নীচের জলসঞ্চয় কেবল যে মাটিকে সুস্থ সরস রাখে তা-ই নয়, নদীগুলোর প্রবাহেও সেই জল নিয়মিত ভাবে যুক্ত হয়। ঘন অরণ্য ভূমিজলকে পুষ্ট করে। কম থাকে ভূমিক্ষয়, অর্থাৎ নদী ভরাট হয়ে যাওয়াও। এই শৃঙ্খলা ক্রমাগত লঙ্ঘিত হওয়ার ফলে প্রতিটি বড় শহর, এমনকি সমৃদ্ধ গ্রামেও জল জমে থাকার বিপদ বাড়ছে। নিয়মিত জীবনযাত্রা বিঘ্নিত হচ্ছে।
সাম্প্রতিক কালে দেখা যাচ্ছে, এই অপ্রাকৃতিক দুরবস্থাকেও ক্রমশই অল্পবৃষ্টির বন্যার মতো প্রায় স্বাভাবিক বলেই মেনে নিয়ে তার একটি চমৎকার নামকরণও হয়েছে— ‘আরবান ফ্লাড’। অর্থাৎ বর্ষাকালে তিন-চার ঘণ্টা স্বাভাবিক বৃষ্টিপাতেও যে কোনও শহর অঞ্চলে নিচু জায়গায় জল দাঁড়িয়ে যাবে। এক রাত্রি বৃষ্টি হলে সেই জল উঁচু-নিচু নির্বিশেষে সমগ্র শহরকে জলপথে রূপান্তরিত করবে। মনে হয় ‘ক্যাচ দ্য রেন ড্রপ হোয়্যার ইট ফলস’ এই বহুঘোষিত স্লোগান ইদানীং বৃষ্টির দিক থেকেই পালিত হচ্ছে। বৃষ্টিজল যে জনপদে যেখানে ঝরে পড়ে, সেখানেই আটকে থাকে। সমস্যার নামকরণ হয়ে গেলে সেখানে কিছু ত্রাণের প্রোজেক্টও চলে আসে।
তাতে প্রোজেক্ট হয়, ‘বাজেট স্যাংশন’ হয়, নির্দিষ্ট উদ্ধারকার্য হয়, ঠিক, কিন্তু জল জমার কোনও সমাধান হয় কি? জলের নীচে গড়িয়ে যাওয়ার রাস্তা অনুদ্ধারণীয় ভাবে বন্ধ হয়ে গিয়েছে। কলকাতায় কুড়ি বছর আগেও শোনা যেত ডুবে যাওয়া এলাকা থেকে পাম্প করে জল বার করে নেওয়ার কথা। কিন্তু বর্তমানে সেই জল ফেলার এলাকা বাকি নেই কোথাও। পূর্ব কলকাতা জলাভূমিতে কোনও জায়গা নেই। অন্যান্য খাল-সহ শহরের সমস্ত নিকাশি চাপা পড়েছে আবাসনের তলায়। আদিগঙ্গা কোনও ভাবে জল বহনে অপারগ। তার প্রস্থ আরও হৃত হচ্ছে নদীর বুকের মাঝখান পর্যন্ত মন্দির সংলগ্ন বিশাল ঘাট নির্মাণে। প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের বসবাসের অভ্যস্ত নিয়মকে চূড়ান্ত অদূরদর্শিতায় যথেচ্ছ লঙ্ঘন করার উন্নয়নমূলক কাজে কেউই পিছিয়ে নেই। ফলে বৃষ্টিজলের প্রসাদপুষ্ট একের পর এক শহর আজ বৃষ্টিকে দেখে প্রকাণ্ড বিপদের মতো। চেন্নাই, বেঙ্গালুরু, মাইসুরু, পটনা, রাজধানী দিল্লি— কোথাও নেইকো পার।
যা আমরা সহজে প্রচুর পেয়েছি, সেই বৃষ্টিধারাকে অবহেলায় বয়ে যেতে দেওয়ার সঙ্কটের কারণে পাশাপাশি তৈরি হয়েছে মাটির সঞ্চিত জলভান্ডার থেকে আক্ষরিক অর্থে বে-হিসাব জল তোলা। তুমুল বর্ষাকালের দেশের মানুষ তীব্র জলসঙ্কটের সামনে। বৃষ্টিজল সঞ্চয়ের পথে মন দেওয়া ছাড়া এই ভয়ঙ্কর ভবিষ্যৎ থেকে পরিত্রাণের অন্য কোনও উপায় আমাদের সামনে নেই। জল সংরক্ষণের প্রথাগত সামাজিক ব্যবস্থাগুলোকে গুরুত্ব দেওয়ার কথা দেশের পরিচালকদের বুঝতে হবে।