প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।
আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে মোট জিডিপি-র হিসাবে বিশ্বের প্রথম তিনটি উন্নত দেশের মধ্যে থাকবে ভারত— স্বাধীনতা দিবসের ভাষণে লালকেল্লা থেকে জানালেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। ভোট আসছে, ফলে তাঁর গলায় আশাবাদের মাত্রা প্রত্যাশিত ভাবেই চড়া। জিডিপি-র নিরিখে বিশ্বের সেরা তিনে আসা ভারতের পক্ষে সম্ভব কি না, তা নিয়ে অর্থনীতির বিশেষজ্ঞদেরও যথেষ্ট সংশয় রয়েছে।
তবে, তার আগে আরও একটা চিন্তার কথা আছে। ‘ডোমেস্টিক প্রোডাক্ট’ বলতে তো কেবল কলকারখানায় উৎপাদিত দ্রব্য নয়, জিডিপি-র আওতায় আসে সব ধরনের উৎপাদন; তার সঙ্গে যোগ হয় পরিষেবা। কিন্তু, আমাদের দেশের ক্ষেত্রে এর বৃহদাংশই অসংগঠিত। দেশের জিডিপি-র অঙ্কে এই সব ক’টিই যোগ করার কথা; ভারতেও তা যোগ করা হয় বটে, কিন্তু প্রকৃত হিসাব নয়, অসংগঠিত ক্ষেত্রের আয়তন অনুমান করা হয় সংগঠিত ক্ষেত্রের আয়তনের একটি নির্দিষ্ট অনুপাতে।
আমেরিকা, কানাডা বা ব্রিটেনের মতো পশ্চিমি দুনিয়ার দেশগুলির জিডিপি-র চার ভাগের তিন ভাগই আসে পরিষেবা খাত থেকে; এই দেশগুলির মোট শ্রমিকদের আশি শতাংশই নানা পরিষেবার সঙ্গে জড়িত। এগুলি কিন্তু অনুমান-ভিত্তিতে বলা নয়, সবেরই পাকাপোক্ত হিসাব রয়েছে। প্রসঙ্গত, এই সব দেশে জিডিপি বৃদ্ধির হার মেরেকেটে এক-দুই শতাংশ, ভারতের মতো ছ’সাত শতাংশ নয়!
অনুমান-ভিত্তিক এই অসংগঠিত ক্ষেত্রের তথ্য আরও ঘেঁটে গেছে কোভিডের পরে, গত দুই-তিন বছরে। প্রাক্-কোভিড কালে ভাবা হত যে, জিডিপি গণনায় অসংগঠিত ক্ষেত্রের জন্য আনুমানিক অঙ্কটা বাস্তবের তুলনায় অনেকটাই কম; এখন গল্প গেছে উল্টে— প্রকৃত পরিসংখ্যান যদি কখনও পাওয়া যায়, তা হলে হয়তো দেখা যাবে যে, জিডিপি-তে অসংগঠিত ক্ষেত্রের যে হিসাব ধরা হচ্ছে, প্রকৃত ছবিটি তার চেয়ে খারাপ।
কিন্তু, অবস্থাটা ঠিক কী রকম, তা বোঝার উপায় কী? একমাত্র উপায় হল, সমস্ত কাজকে নথিভুক্ত করে অসংগঠিত ক্ষেত্রকে ক্রমে সংগঠিত করে তোলার চেষ্টা করা। ধরা যাক, সবাইকে আধার কার্ড বা প্যান কার্ডের মতো একটা ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্ট নম্বর দেওয়া হল, অর্থনৈতিক উৎপাদন সংক্রান্ত কাজকর্মের ক্ষেত্রে ব্যবহারের জন্য— আমরা যদি কোনও দ্রব্য বা পরিষেবা উৎপাদনে যোগদান করি, ব্যক্তি হিসাবে বা সমষ্টিগত ভাবে কোনও সংগঠনের সঙ্গে জড়িত হয়ে, তা হলেই আমাদের অর্থনীতি পরিচয়পত্রে তা জুড়ে দেওয়া হবে। এতে শুধু যে দেশের জিডিপি-র হিসাব সুষ্ঠু হবে তা নয়, এই ব্যবস্থা থেকে দেশের সামগ্রিক অর্থনীতির লাভ, অতএব, লাভ আপনার আমার সকলের। সরাসরি একটা লাভও হতে পারে। ধরা যাক, রাজ্য বা কেন্দ্রীয় সরকার কোন বিশেষ প্রকল্প বাছবে, যার মাধ্যমে অনুদান দেওয়া হবে— এই তথ্য তখন কাজে আসবে।
প্রশ্ন হল, সরকার তথ্য চাইলেই আমরা দিতে রাজি হব কেন? আমাদের প্রথম দুশ্চিন্তাই হবে, আমাদের পরিষেবা নথিবদ্ধ হলেই তার জন্য কর গুনতে হবে। উত্তরে সরকার যদি এই প্রতিশ্রুতিও দেয় যে, স্বল্প-আয়ে কোনও কর দিতে হবে না, তবু আমাদের ভয় কাটা কঠিন হবে; আমরা স্বভাবতই লেখাপড়া-করা চুক্তি সইতে ভয় পাই, হাতে-হাতে-নগদে বিশ্বাসী; তার থেকেও বেশি ভয় নুন আনতে পান্তা ফুরোনোর। এত নিয়ম-কানুন চাপালে যা খরচ বাড়ে, তাতে আমাদের ব্যবসা চালানোই দুষ্কর!
দু’নম্বর চিন্তা এটা হতে পারে যে, আমরা নিজেদের মোবাইল নম্বরের মতো নিজের কাজকেও ব্যক্তিগতই রাখতে চাই। তৃতীয় কারণ মোহভঙ্গ— দেশ জুড়ে অজস্র দুর্নীতি, চুরির ঘটনায় বীতশ্রদ্ধ হয়ে আমাদের আর দেশের বা সমাজের সামগ্রিক উন্নতির কথা মাথায় আসে না। আমরা এটাও বলতে পারি যে, “অন্য কেউ করছে না, শুধু আমি কেন?”
সরকারকে তথ্য দিতে ভয় পেলেও আমরা কিন্তু বিভিন্ন ক্ষেত্রে সহজেই গলে যাই। যেমন, আজকাল যে কোনও দোকানে কিছু কিনলেই রসিদ পাঠানোর অছিলায় তারা আমাদের মোবাইল নম্বর, ইমেল চেয়ে নেয়, আমরাও স্বচ্ছন্দে দিয়ে দিই। ব্যক্তিগত তথ্য কী ভাবে ব্যবহার হবে, তা জানতেও চাই না। সামগ্রিক ভাবে তথ্য কী ভাবে ব্যবহার হতে পারে সেটা বুঝতে হলে যে কোনও সমাজমাধ্যমের কথা ভাবুন। সমাজমাধ্যম ব্যবহার করছেন আপনি, কিন্তু তার মাধ্যমে লাভের কড়ি ঘরে তুলছেন অন্য কেউ।
তবুও বেশির ভাগ মানুষ নিজেদের উৎপাদনের অর্থনৈতিক তথ্য নথিবদ্ধ করতে রাজি হবেন না বলেই সন্দেহ হয়। অফিসে স্বল্প মাইনের চাকরিজীবী হলেও আমরা প্যান কার্ড নিতে বাধ্য, তবু ক্ষুদ্র পরিষেবাদাতাদের পরিসংখ্যান জিডিপি-র হিসাবে ঠিক ভাবে ধরা পড়বে না। কোনও ভাবেই কি অর্থনীতির এই দশা বদলানো যায় না?
গেম থিয়োরি বা দ্বন্দ্বতত্ত্বের ভাষায় বললে, পরিষেবা চাহিদা-জোগানের সম্পর্ক বা গেম-টা এক বার বা এক দিনের নয়; এটা ‘রিপিটেড গেম’। বিভিন্ন কারণে হয়তো প্রথমে কেউই তথ্য দিতে রাজি হব না। কিন্তু, যদি সাহস করে কেউ কেউ শুরু করেন, তা হলেই আগামী দিনে একে একে সবাই করবে। তত্ত্ব তো তা-ই বলে। শুরু করে দেখাই যাক না!