সীমান্ত: সিলা পাস, অরুণাচল প্রদেশ ফাইল চিত্র।
১৯৫৩ সালের ২৬ জুলাই সন্ধ্যা আটটায় বেজিং-এর ‘হোপিং’ বা ‘শান্তি’ প্রেক্ষাগৃহে একটি ভারতীয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান শুরু হল। ভারতের শিল্পীরা প্রথমেই সমবেত কণ্ঠে গাইলেন ‘বন্দে মাতরম্’। এর পর বাংলার দেবব্রত বিশ্বাস ও পঞ্জাবের সুরিন্দর কউরের দ্বৈতকণ্ঠে শোনানো হল হারীন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় রচিত ‘হিন্দি-চিনি ভাই ভাই’। দর্শকদের সঙ্গে চতুর্থ সারিতে বসেছিলেন স্বয়ং মাও জে দং। অনুষ্ঠানের শেষের দিকে যখন দেবব্রত বিশ্বাস সুকান্ত ভট্টাচার্য রচিত কবিতার ‘বিদ্রোহ আজ, বিদ্রোহ চারিদিকে’ পঙ্ক্তিটি গাইলেন, তখন প্রেক্ষাগৃহে লাল আলোর রোশনাই। চু এনলাই করমর্দন করে গায়ককে অভিনন্দন জানালেন।
পঞ্চাশ দশকেই এই ভ্রাতৃভাব বৈরিতায় পরিণত হয়। ১৯৫৯-এ তিব্বতে প্রতিরোধ বিফল হওয়ার পরেই দলাই লামা ভারতে পালিয়ে আসেন তাওয়াং হয়ে। ভারত ও চিনের মধ্যে বিস্তীর্ণ সীমান্তের চরিত্র পশ্চিমে ও পুবে বেশ আলাদা। পশ্চিমে শুকনো ও বন্ধুর আকসাই চিনের অধিত্যকা। পুবে, অর্থাৎ সে-কালের নেফা (নর্থ-ইস্ট ফ্রন্টিয়ার এজেন্সি) এ-কালের অরুণাচলে, গাঢ় সবুজ গাছপালায় ঢাকা পাহাড়-পর্বত। ইংরেজ আমলে পশ্চিমে কোনও সুনির্দিষ্ট সীমারেখা ছিল না, পুবে ছিল ১৯২৪ সালে হেনরি ম্যাকমাহন-এর আঁকা মানচিত্রের উপর একটি লাইন।
সাধারণত চিন ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক শক্তির স্থির করা সীমান্ত অস্বীকার করে। তবে, ১৯৬০-এর এপ্রিল মাসে দিল্লিতে এসে চু এনলাই একটি প্রস্তাব দিয়েছিলেন তত্ত্ব ও বাস্তবের মধ্যে ফারাক টেনে। তাত্ত্বিক স্তরে ম্যাকমাহন-এর লাইন না মানলেও, যে-হেতু স্বাধীন ভারতের প্রশাসন সেই লাইন পর্যন্ত কর্তৃত্ব স্থাপন করতে সক্ষম হয়, সেই বাস্তব চিন স্বীকার করতে প্রস্তুত। বিনিময়ে তারা চায় আকসাই চিনের উপর কর্তৃত্ব। তখন নেহরুর সরকার এই প্রস্তাব নিয়ে আলোচনায় নারাজ।
১৯৬২-র যুদ্ধে চিনের পিএলএ (পিপল লিবারেশন আর্মি) ম্যাকমাহন লাইন পার হয়ে, তাওয়াং দখল করে, সিলা পাস অতিক্রম করে, বমডিলা পর্যন্ত চলে আসে। তার পর হঠাৎই অসম উপত্যকার দিকে না এগিয়ে, তারা ম্যাকমাহন লাইনের কুড়ি কিলোমিটার পিছনে ফিরে যায়। ২০২২-এর এই ডিসেম্বরের সংঘাত তাওয়াং এলাকায় অনেক দিন পর চিনা আগ্রাসনের সঙ্কেত। চিনে ১৯৫৯ থাকে ১৯৬১ সালের ‘গ্রেট লিপ ফরওয়ার্ড’-এর চরম দুর্দশার পরে ভারতের সঙ্গে ১৯৬২-র যুদ্ধ মাও জে দং-কে তাঁর কর্তৃত্ব পুনরুদ্ধার করতে সাহায্য করেছিল। চিনে অভ্যন্তরীণ টালমাটালের সময় ভারত ও অন্যান্য পড়শির বিশেষ সতর্ক হওয়া দরকার।
মাও যুগের অবসানের পর সত্তর দশকের শেষ থেকে চিনের অর্থনৈতিক সংস্কার শুরু। ১৯৭৯-র চিন ও ভারতের অর্থনীতির পরিমাপ ছিল মোটামুটি সমান। তার চার দশক বাদে ২০১৯-এ কোভিড সংক্রমণের ঠিক আগের মুহূর্তে ভারতের তুলনায় চিনের অর্থনীতির পরিমাপ হয়ে উঠেছিল ছয়গুণ বেশি। জিয়োভান্নি আরিগি তাঁর ২০০৭-এ প্রকাশিত অ্যাডাম স্মিথ ইন বেজিং বইয়ে লেখেন যে বিশ শতকের শেষে পূর্ব এশিয়ায় অর্থনৈতিক নবজাগরণই বিশ্ব ইতিহাসের মূল কাহিনি। চিনের উত্থান সম্বন্ধে এই লেখকের দৃপ্ত ভবিষ্যদ্বাণী: “স্মিথের দ্য ওয়েলথ অব নেশনস প্রকাশের আড়াইশো বছর পর এই প্রথম বিভিন্ন বিশ্ব সভ্যতার মধ্যে সমতার ভিত্তিতে একটা ‘ওয়ার্ল্ড-মার্কেট সোসাইটি’ তৈরি বিষয়ে তাঁর যে ভাবনা, তার বাস্তবায়ন সম্ভব বলে মনে হচ্ছে।”
একুশ শতকের গোড়ায় চিনের নবজাগরণের একটি সম্ভাবনা দেখা গিয়েছিল। সিঙ্গাপুরবাসী প্রবীণ ইতিহাসবিদ ওয়াং গাংউ তাঁর রিনিউয়াল বইয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন, ঠিক কী ধরনের চিনের উত্থান আমরা লক্ষ করছি। এই নতুন চিন কি ইউরোপীয় জাতীয়তাবাদী সাম্রাজ্যের ধাঁচে গড়ে উঠবে, না কি নিজস্ব প্রাচীন তিয়াংশিয়া মূল্যবোধ অনুসরণ করে একটি যুক্তরাষ্ট্রীয় প্রজাতন্ত্র হিসাবে আত্মপ্রকাশ করবে। এই সূত্রে লেখক লক্ষ করেছিলেন কী ভাবে বিশ শতকের প্রথমার্ধের মনীষী কু হংমিং-এর লেখা একুশ শতকের গোড়ায় চিনে আবার জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। এই কু হংমিং-এর সঙ্গে ১৯১৬ সালে বিনয়কুমার সরকার সাক্ষাৎ করেছিলেন শাংহাই শহরে। বিনয়কুমারের বিশ্বাস জন্মেছিল যে, একমাত্র যুক্তরাষ্ট্রীয় চিন ও যুক্তরাষ্ট্রীয় ভারতের ভিত্তিতেই নবীন এশিয়ার স্বপ্ন পূরণ হতে পারে।
ওয়াং গাংউ প্রশ্ন তুলেছিলেন, “হোয়াট কাইন্ড অব চায়না ইজ় নাও রাইজ়িং?” এই চিন কি ভাবতে পারে যে, ক্ষমতাশালী হয়েও সে পশ্চিমের জাতিরাষ্ট্র-সাম্রাজ্যগুলিকে অনুকরণ না করে অন্য রকম হবে? শান্তিপূর্ণ কল্যাণকামী বহুজাতিক রাষ্ট্র হিসেবে সে কি নিজেকে কল্পনা করতে পারে? তাঁর বইটি প্রকাশিত হয়েছিল ২০১৩ সালে, যখন দ্বিতীয় সম্ভাবনাটি ছিল ভবিষ্যতের আশা। তার পর থেকে প্রায় এক দশক অতিক্রান্ত হয়েছে— কু হংমিং-এর দূরদৃষ্টিসম্পন্ন ভাবনা শি জিনপিং-এর ‘থট’-এর দাপটে চিনে জন-আলোচনার ক্ষেত্র থেকে হারিয়ে গেছে।
২০২২ সালে ভারত তা হলে এই চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা কতটা সুষ্ঠু ভাবে করতে পেরেছে? ২০২২-এর জানুয়ারি মাসে রিজিয়নাল কম্প্রিহেনসিভ ইকনমিক পার্টনারশিপ (আরসিইপি) তার যাত্রা শুরু করে। আসিয়ান-এর দশটি দেশ ছাড়াও এই বিশাল বাণিজ্য সমাবেশে শামিল হয়েছে চিন, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, অস্ট্রেলিয়া ও নিউ জ়িল্যান্ড। পনেরো বছর আলোচনায় থাকার পরও ভারতের এতে অংশীদার না হওয়ার সিদ্ধান্ত দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলির সঙ্গে অর্থনৈতিক সমন্বয়ের সুযোগ হাতছাড়া করল। মে মাসে জাপানে গিয়ে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট যে ইন্দো-প্যাসিফিক ইকনমিক ফ্রেমওয়ার্ক (আইপিইএফ) ঘোষণা করেছেন তাতে ভারত যোগ দিতে সম্মত হয়েছে। এটি হল চিনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ-এর (বিআরআই) পরিপ্রেক্ষিতে আমেরিকার খানিকটা বিলম্বিত ও দুর্বল পদক্ষেপ।
ইন্দো-প্যাসিফিক’এর আঙিনায় আমেরিকার সঙ্গে সমন্বয় রেখেও, ২০২২-এর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক ঘটনা ইউক্রেনে রাশিয়ার বিধ্বংসী যুদ্ধের ক্ষেত্রে ভারত তার নিজস্ব স্বার্থ রক্ষাকেই প্রাধান্য দিয়েছে। এই বিষয়ে ভারতের অবস্থান বা ভোটে চিন, এমনকি পাকিস্তানের সঙ্গে তেমন তফাত চোখে পড়ে না। পাশ্চাত্যের বা ইউরোপের সমস্যা বিশ্বের সবচেয়ে জরুরি সমস্যা নয়, এই হল এশীয় দেশগুলির যৌথ বার্তা।
অথচ, ইউরোপীয় সার্বভৌমত্ব ও সীমান্ত সম্বন্ধে ধারণা এশিয়া এখনও পরিত্যাগ করতে পারেনি। আন্তর্জাতিক সমস্যার সমাধানের পথে এই ঐতিহাসিক পরম্পরাই হল প্রধান অন্তরায়। সীমান্তে চিনের চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা সামরিক কোর কমান্ডারদের হাতে ছেড়ে দেওয়া ভারতীয় কূটনৈতিক ও রাজনৈতিক নেতৃত্বের দায়িত্বজ্ঞানহীনতার পরিচয়। অবশ্য উচ্চপর্যায়ের কথোপকথনে গতি আনতে ও সমাধানের লক্ষ্যে অগ্রগতি আনতে হলে চাই এশিয়ার উপনিবেশবাদ বিরোধী রাজনৈতিক ঐতিহ্য থেকে উদ্ধৃত নতুন কল্পনা।
রবীন্দ্রনাথ ১৯৩২-এ পারস্যে বইতে লেখেন, “এশিয়ায় যদি নতুন যুগ এসেই থাকে, তবে এশিয়া তাকে নতুন করে আপন ভাষা দিক। তা না করে য়ুরোপের পশুগর্জনের অনুকরণই যদি সে করে সেটা সিংহনাদ হলেও তার হার।” ২০২২ পশুগর্জনের বছর হিসেবেই চিহ্নিত থকবে। আশা করা যায় কি যে, ২০২৩-এ মনুষ্যসঙ্গীত আবার শোনা যাবে?
গার্ডিনার প্রফেসর, ইতিহাস বিভাগ, হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি