বিশ্বশান্তির পক্ষে অগণতান্ত্রিক চিন ও গণতান্ত্রিক ভারতের মধ্যে সুসম্পর্ক খুবই প্রয়োজন। প্রতীকী ছবি।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের অন্তরালে বেশ কিছু দিন ধরেই বিশ্বের রাজনীতিতে চিন, আমেরিকা এবং ভারতকে নিয়ে কিছু দৃষ্টি-আকর্ষণী বিষয় ভবিষ্যতের পক্ষে বিশেষ ভাবে প্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েছে। প্রথমেই বলে রাখা প্রয়োজন যে, এই বিশ্বে সহযোগিতা, সহমর্মিতা এবং অনাক্রমণাত্মক বৈদেশিক নীতি ছাড়া কোনও উপায় নেই। দুর্ভাগ্যক্রমে, বহু শিক্ষিত ক্ষমতাশালী মানুষ এটা বুঝতে পারেন না, বা বুঝতে চান না। বিশেষ করে ভারত ও চিনের মধ্যে যে কোনও ধরনের সংঘাত ভারতীয় অর্থনীতির পক্ষে এবং চিনের আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তির জন্য কাম্য নয়। চিন যাতে একঘরে না হয়ে পড়ে, তার জন্যও ভারতের সঙ্গে হাত মেলানো ভীষণ ভাবে প্রয়োজন। সামগ্রিক অর্থনীতির নিরিখে পৃথিবীর দু’টি বৃহত্তম এবং বলশালী দেশ নিজেদের মধ্যে সমঝোতা করে অনেকটাই এগোতে পারবে। আমেরিকা বিষয়ে এই দুই দেশের অবস্থান যা-ই হোক না কেন, ভারত-চিনের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে তার প্রভাব পড়তে দেওয়া অনুচিত।
দ্বিতীয় কারণটি আর এক বার মনে করিয়ে দিই। সম্প্রতি চিনের প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, জাপান ও ভারতের বাণিজ্য ও অন্যান্য ধরনের সহযোগিতামূলক গোষ্ঠী কোয়াড আসলে চিনকে এশিয়াতে ব্রাত্য করার চেষ্টা। এই মুহূর্তে চিন এবং আমেরিকার কূটনৈতিক সম্পর্কের অবস্থা ট্রাম্প জমানার চেয়েও খারাপ অবস্থায়। চিনের উপর অতিরিক্ত আমদানি শুল্ক চাপানোর নীতিকে শত মাইল পিছনে ফেলে দিয়ে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে চিনের রাশিয়ার পক্ষ নিয়ে প্রত্যক্ষ সাহায্য করার ব্যাপারটিকে এখন অনেক বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। বিশেষ করে আমেরিকার প্রযুক্তিনির্ভর বিশেষ প্রয়োজনীয় উপাদান যাতে চিন আমদানি না করতে পারে, তার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। সঙ্গে প্রযুক্তিহরণ এবং কোভিড সম্পর্কিত সমালোচনাও রয়েছে। একটু লক্ষ করলেই বোঝা যাবে যে, এই মুহূর্তে যদিও বিশ্ব অর্থনীতির খানিকটা টালমাটাল অবস্থা, তবুও ভূ-রাজনীতি ভারত-চিন অর্থনৈতিক সহযোগিতার চেহারাটা খানিকটা নির্ধারণ করছে।
কিছু দিন আগেই ভারত চিন সীমান্তে সংঘাত ও কূটনৈতিক সম্পর্কের অবনতির পরিপ্রেক্ষিতে এ দেশের সরকার বিভিন্ন অ্যাপ-এর ক্ষেত্রে চিনা বিনিয়োগের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল। অন্য দিকে শোনা যাচ্ছে, চিনের যে সংস্থাটি অ্যাপল-এর অ্যাসেম্বলার হিসেবে কাজ করে, অর্থাৎ স্থানীয় প্রযুক্তি, কাঁচামাল ও শ্রমের সঙ্গে অ্যাপল-এর মূল প্রযুক্তি ও ডিজ়াইন মিশিয়ে যারা মূল সংস্থার পণ্য উৎপাদন করে, তেমন একটি সংস্থা-সহ আরও বেশ কয়েকটি চিনা সংস্থা ভারতের বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে শিল্পপত্তনের অনুমতি পাচ্ছে। অর্থাৎ, ইন্দো-চিন অর্থনৈতিক যৌথ উদ্যোগকে দু’দেশই কাম্য বলে মেনে নিচ্ছে। যেমন ভাবে ইউরোপ, আমেরিকা, জাপান ইত্যাদি জায়গার সঙ্গে ভারতের সংস্থাগুলি অর্থনৈতিক গাঁটছড়া বেঁধে আসছে বহু দিন, চিন সেই তালিকায় যুক্ত হতে চলেছে। এর সঙ্গে মনে রাখতে হবে, চিন ভারতের আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের এক মহামূল্যবান অংশীদার, অনেক দিন ধরেই। কিন্তু পাকিস্তান প্রসঙ্গে ভারতের উত্তর ভাগ দিয়ে পশ্চিম এশিয়ায় প্রবেশ করার চিনা পরিকল্পনার পরিপ্রেক্ষিতে এবং ভারতের প্রত্যন্ত উত্তর-পূর্বের সীমান্তে সে দেশের সামরিক কার্যকলাপ নিয়ে ভারত এবং চিনের নীতিগত সংঘাতও বহু দিনের। এই অঞ্চলের ভূ-রাজনীতিকে ছাপিয়ে আন্তর্জাতিক স্তরে চিন-আমেরিকার কূটনৈতিক সম্পর্কের অধোগতি এবং বিশেষ ভাবে রাশিয়ার বন্ধু চিন এখন আমেরিকায় শত্রুর তকমা লাভ করেছে।
ভারত রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে এক ভাবে লাভবান হচ্ছে। রাশিয়া থেকে আমদানি করা তেলের সর্বোচ্চ মূল্য বেঁধে দেওয়ার ফলে ভারত রাশিয়া থেকে তেল কেনার ব্যাপারে আমেরিকার কথা না শুনলেও, আমেরিকা যে-হেতু ভারতকে সরাসরি ‘দোষী’ সাব্যস্ত করছে না, তাই ভারত কম দামে তেল কিনতে পারছে। যদিও বিশ্বে পেট্রোলিয়ামের সামগ্রিক মূল্যবৃদ্ধির ফলে পণ্যমূল্যের যে সামগ্রিক স্ফীতি ঘটেছে, তাতে ভারতের কিছুটা ক্ষতি হয়েছে। তবুও, রাশিয়া অন্যত্র পেট্রোলিয়াম রফতানি করতে না পেরে ভারতকেই বেশি তেল পাঠাচ্ছে বলে শুনছি। ভারত এখন দু’দিক দিয়ে চিন-রাশিয়া বিরোধী বিশ্বের কাছে মূল্যবান। এক দিকে চিনকে ত্যাজ্য প্রমাণ করার জোটে ভারত থাকবে এমনটাই উন্নত বিশ্বের কাম্য। তার কারণ গণতান্ত্রিক পরিবেশে কট্টরপন্থী আন্তর্জাতিক নীতি প্রণয়নে দেশের অভ্যন্তরে অনেক গোষ্ঠীর এবং রাজনৈতিক দলের মতামত গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে। তা ছাড়া ভারত প্রযুক্তি চুরি করে গোপনে আমেরিকাকে টেক্কা দেওয়ার স্পর্ধা তেমন দেখায় না বলে আমেরিকার বিশ্বাস।
অন্য দিকে, যদি ভারতকে প্রয়োজন হয়, তা হলে রাশিয়া থেকে তেল আমদানি করা বা রাশিয়ার সঙ্গে দীর্ঘকালীন সামরিক চুক্তিজাত বাধ্যবাধকতা নিয়ে এখন আর আমেরিকা তেমন কথাবার্তা বলে না। ফলে আমেরিকার স্নেহ ভালবাসা এবং বিপদে পড়া রাশিয়ার দিকে বন্ধুত্বের হাত বাড়ানো দুটোই করতে পারছে ভারত।
কিন্তু সব ছাপিয়ে শেষ কথা বলবে অর্থনৈতিক মুনাফা এবং সম্পর্ক। চিন সম্পর্কে খানিকটা আক্রমণাত্মক এ দেশের সরকার যে আসলে ব্যবসাটা ভাল বোঝে, সে কথাটা অনেকেই স্বীকার করেন। যেখানে মুনাফা, সেখানেই সরকার। তাই যদি আমেরিকায় জিনিসপত্র রফতানি করতে বা আমেরিকা প্রযুক্তিপ্রসূত বিভিন্ন চিনা শৈল্পিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে ভারত জুড়ে যেতে পারে, তা হলে ভারতীয় শিল্পের উপকারই হবে। এই ভেবেই যৌথ উদ্যোগের অনুমতি দিচ্ছে সরকার। এই নীতির ফলে দেশের কতটা সামগ্রিক উন্নতি হবে, তা এখনও স্পষ্ট নয়, তবে দেশের ভিতরের কিছু সংস্থা যে ফুলেফেঁপে উঠবে তাতে কোনও সন্দেহ নেই।
যদি আমেরিকা ও চিন বন্ধুত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হত, তা হলে ভারতের কপালে শিকে ছিঁড়ত না। এত দিন কোনও চিনা কোম্পানি আমেরিকার পণ্য উৎপাদন করার জন্য এ দেশের দ্বারস্থ হয়নি। এখন কোনও কারণে আমেরিকার সঙ্গে গন্ডগোল হলে আমেরিকা হয়তো চিনের ব্যবসার ক্ষতি না-ও করতে পারে। কারণ, তা হলে ভারতেরও সমস্যা হবে। আর যদি চিনকে সামলাতে ভারতকে নিয়ে দলে ভারী করতে হয়, তা হলে ভারতের যৌথ উদ্যোগগুলোকে বিপদে ফেলা আমেরিকার পক্ষে সঠিক নীতি হবে না। অর্থাৎ, চিনের পক্ষে ভারতীয় যৌথ উদ্যোগ এক ধরনের বিমার মতো। এর জন্য চিনকে প্রিমিয়াম দিতে হচ্ছে। কারণ ভূ-রাজনীতি বেগতিক অবস্থার সৃষ্টি না করলে, চিনা কোম্পানি এ-মুখো হত বলে মনে হয় না। মনে রাখতে হবে, চিনের জাতীয় আয়ে শিল্পের ভাগ ঐতিহাসিক ভাবে ভারতের চেয়ে অনেক বেশি। তা ছাড়া জাতীয় আয়ে চিনের বিনিয়োগের ভাগ অনেক দিন ধরেই গড়ে প্রতি বছরে ভারতের চেয়ে দশ থেকে পনেরো শতাংশ বেশি। শুধু শিল্পের অংশ নয়, চিনের বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তি সংক্রান্ত গবেষণার পরিকাঠামোর অভূতপূর্ব উন্নয়নের ফলে চিনের ভারত থেকে তেমন কিছু পাওয়ার নেই। হয়তো খানিকটা অর্থনৈতিক ক্ষতি স্বীকার করেই উদ্যোগ করতে হবে তাদের। ভূ-রাজনীতি এবং আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তির অধোগতি অনেকাংশে এর জন্য দায়ী।
বিশ্বশান্তির পক্ষে অগণতান্ত্রিক চিন ও গণতান্ত্রিক ভারতের মধ্যে সুসম্পর্ক খুবই প্রয়োজন। কিন্তু চিনের সঙ্গে বাণিজ্যিক এবং অর্থনৈতিক সম্পর্ক সুগম হলে তা কথায় কথায় ‘যুদ্ধং দেহি’ মনোভাবের পক্ষে অমঙ্গলের কারণ হতে পারে। অভ্যন্তরীণ রাজনীতির স্বার্থরক্ষা করতে গিয়ে সেই কথাটা ভুললে চলবে না।