—প্রতীকী ছবি।
এ দেশে এমন কোনও বসতবাড়ি, দফতর বা শপিং মল নেই, যার নির্মাণে মেয়েদের শ্রম ব্যবহার হয়নি। নির্মাণ ক্ষেত্রে শ্রমিকদের প্রায় ত্রিশ শতাংশ মহিলা, প্রধানত অদক্ষ মজুরের পরিশ্রমসাধ্য কাজগুলি তাঁদের দিয়ে করানো হয়। বিনিময়ে তাঁরা কী পান? জোগাড়ের কাজ করেন পুরুষরা ৬০০-৭৫০ টাকা দৈনিক মজুরি পান, মেয়েরা একই কাজে পান ৩০০-৪৫০ টাকা। বরং অনেক কাজ মিনিমাগনা করানো হয় মেয়েদের দিয়ে। যেমন, কাজের শেষে ঘর পরিষ্কার করা। মেয়েদের অর্ধেক মজুরি কেন, প্রশ্ন করলে কাজ চলে যাবে— এই ভয়ে চুপ করে থাকেন মেয়েরা। রাজমিস্ত্রি বা ঠিকাদারকে চটাবে যে, তার কাজই মিলবে না। গত আট-দশ বছরে বাজারে সব কিছুর দাম বেড়েছে, মেয়েদের মজুরি বাড়েনি।
উপরি পাওনা যৌন হেনস্থা। পশ্চিম বর্ধমানের একটি সভায় একটি মজুর মেয়ে খোলাখুলি বলেছিলেন, “আমাদের প্রতি দিন অত্যাচারিত হতে হয়। কিছু বললে পেট চলবে না। কাজ চলে যাবে।” প্রায়ই দেখি, মেয়েরা সবার সামনে কর্মক্ষেত্রে যৌন নিপীড়নের কথা এমন ভাবে বলেন, যেন তা অন্য মেয়েদের সঙ্গে ঘটেছে। কিন্তু তাঁদের চোখের জল, মুখের ভাব দিয়ে বোঝা যায়, তাঁর নিজেরই গল্প। কিছু জনজাতি গোষ্ঠীর মেয়ে তো এমনও বলেছেন যে, তাঁদের কাজ দেওয়ার সময়ে বুঝিয়েই দেওয়া হয় যে তাঁদের খাটতে হবে, অন্য ভাবেও ব্যবহৃত হতে হবে। যখন সহ্যের বাইরে চলে যায়, মেয়েরা কাজ ছেড়ে দেন। কিন্তু সংসার, সন্তানের মুখ চেয়ে যত দূর পারেন, সয়ে যান। আট বছর নির্মাণ শ্রমিকদের সঙ্গে কাজ করার অভিজ্ঞতায় একটিও এমন ঘটনা দেখিনি, যেখানে মেয়ে-মজুররা সম্মিলিত ভাবে ঠিকাদার বা রাজমিস্ত্রির কাছে যৌন হেনস্থার প্রতিবাদ করেছেন। থানায় যেতেও এঁরা ভয় পান। ভাবেন, পুলিশ নালিশ লিখবে না।
এই ভয় অমূলক নয়। দশ জনের বেশি মেয়ে-মজুর থাকলে আলাদা শৌচাগার, সমান মজুরি, সামাজিক সুরক্ষা দিতে হবে, রাতের শিফ্টে মহিলাদের দিয়ে কাজ করানো যাবে না, প্রভৃতি দাবি নিয়ে নির্মাণ শ্রমিক সংগঠনের তরফ থেকে সরকারি দফতরে নিয়মিত ডেপুটেশন দেওয়া হয়। ‘দেখছি, দেখব’ বলে কোনও কাজটাই করেন না আধিকারিকরা। মেয়ে-শ্রমিকদের আইনি সুরক্ষা, তাঁদের ন্যায্য পাওনা পাওয়া নিশ্চিত করার বিষয়টিকে কেউ কোনও গুরুত্বই দেন না। যে পরিবেশে মেয়েরা কাজ করেন, তাতে যৌন হেনস্থা অস্বাভাবিক নয়। নির্মীয়মাণ বাড়িতে একটাই ঘরে পুরুষ-মহিলা, সব কর্মীর থাকার ব্যবস্থা হয়। একটাই বাথরুম। মজুরদের রাতে মদ খাওয়ার প্রবণতা থাকেই। মেয়েগুলি কী করে সুরক্ষিত থাকতে পারেন?
তার উপরে অসংগঠিত ক্ষেত্রের মহিলা-শ্রমিকদের যে সব সমস্যা, সেগুলি তো নির্মাণ শ্রমিকদের আছেই। ছ’মাসের মাতৃত্বকালীন ছুটির প্রশ্নই নেই— প্রসবের মাত্র দু’দিন পরে কাজে যোগ দিতে হয়েছে, এমন মহিলাও দেখেছি। শিশুর দেখাশোনার জন্য কর্মস্থলে ক্রেশ থাকার কথা, তারও কোথাও চিহ্ন নেই। শিশুকে বেঁধে রেখে, অরক্ষিত অবস্থায় রেখে কাজ করেন অনেক মা। কাজের জায়গার থেকে স্কুল অনেক দূর হওয়াতে বহু শিশুর স্কুল যাওয়া হয় না।
এ সমস্যা কেবল পশ্চিমবঙ্গের, এমন নয়। সম্প্রতি কন্যাকুমারীতে সারা ভারতের মহিলা নির্মাণ শ্রমিকরা জড়ো হয়েছিলেন। দেখা গেল, মজুরিতে বৈষম্য, কর্মক্ষেত্রে অব্যবস্থা, সামাজিক সুরক্ষার অভাব, যৌন হেনস্থা প্রভৃতি সমস্যাগুলো সব রাজ্যেই রয়েছে। দীর্ঘ দিন কাজ করেও মেয়েরা ‘হেল্পার’ থেকে দক্ষ মিস্ত্রি হতে পারছেন না।
কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল সরকার নির্মাণ শ্রমিকদের প্রতি বিশেষ বঞ্চনা করেছে। বামফ্রন্ট সরকার নির্মাণ শ্রমিক কল্যাণ পর্ষদ তৈরি করেছিল ২০০৪-এ। নির্মাণের উপর সেস থেকে তহবিল তৈরি হয়েছিল। তা দিয়ে মজুরদের সুরক্ষার সরঞ্জাম, যন্ত্রপাতি, সাইকেল প্রভৃতি দেওয়া হত। চিকিৎসা, সন্তানদের পড়াশোনা প্রভৃতির জন্যও টাকা দেওয়া হত। নির্মাণ ক্ষেত্র থেকে সংগৃহীত সেস আইনত নির্মাণ শ্রমিকদের জন্যই ব্যবহৃত হতে পারে।
তৃণমূল সরকার ২০১৭ সালে বিড়ি, পরিবহণ এবং নির্মাণ— এই তিনটি ক্ষেত্রের শ্রমিক সুরক্ষা প্রকল্পকে এক করে এনেছে সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্প (এসএসওয়াই)-র অধীনে। শ্রমিক সংগঠনগুলির আপত্তি সত্ত্বেও এটা করা হয়। ফলে নির্মাণ শ্রমিকদের তহবিলে যে ১৬০০ কোটি টাকা ছিল, তা কী ভাবে খরচ হচ্ছে, তার কোনও স্বচ্ছ হিসাব মিলছে না। আন্দাজ করা যায় যে, শ্রমিক মেলা-সহ নানা ধরনের সরকারি কার্যসূচিতে এই টাকা ব্যয় হচ্ছে। চা-বাগানের মতো ভিন্ন ক্ষেত্রেও ব্যয় হচ্ছে। আইনত এটা করা যায় কি না, সে প্রশ্নও উঠেছে। উত্তর মেলেনি।
গত বছর ডিসেম্বরে কেন্দ্রীয় সড়ক পরিবহণ ও মহাসড়ক মন্ত্রী নিতিন গডকড়ী জানিয়েছিলেন, ভারতে নির্মাণ শিল্প বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম, আগামী পাঁচ বছরে তা শীর্ষে পৌঁছে যেতে পারে। এত বিপুল টাকা ব্যয় হয় যে শিল্পে, তার এক-তৃতীয়াংশ শ্রমিকের কেন ন্যূনতম মজুরি মেলে না? কেন মেয়েদের সারা কর্মজীবন অদক্ষ শ্রমিকের কাজ করতে হয়, প্রশিক্ষণ মেলে না? কেনই বা নির্মাণ শ্রমিকদের প্রাপ্য সহায়তা, সামাজিক সুরক্ষা পৌঁছয় না মজুর মেয়েদের কাছে? অংগঠিত ক্ষেত্রের মেয়ে-শ্রমিকরা সমাজের বোঝা নন, সম্পদ। তাঁদের শ্রমের যথাযোগ্য সম্মান দেওয়া চাই।