— ফাইল চিত্র।
নানান জটিলতার মধ্যেও প্রিয় ফুটবল দলের জয় জীবনে শান্তি আনে, বাঁচার রসদ দেয়। তাই পরিবারের বারণ সত্ত্বেও চল্লিশ-পঞ্চাশ বছরের অভ্যাসে সওয়ার হয়ে কোনও প্রবীণ অসুস্থ শরীর নিয়েও এখনও মাঠে আসেন। অফিসে মিথ্যে বলে, টুকটাক পারিবারিক দায়িত্ব এড়িয়েও প্রিয় দলের খেলা দেখতে যান কত মানুষ। এ সবকে কেন্দ্র করে ময়দানের সমৃদ্ধ ইতিহাসের সঙ্গে জুড়ে আছে কত গল্প, কত মিথ। পুত্রের দাহকার্য সেরে সটান মাঠে এসেছেন শোকগ্রস্ত পিতা। ছলছল চোখে প্রার্থনা করছেন— প্রিয় দল যেন জয়ী হয়, তবেই পুত্রের আত্মা শান্তি পাবে। কারণ পুত্রের সঙ্গেই খেলা দেখতে আসতেন। ‘সব খেলার সেরা’ ফুটবল অনেক বাঙালির কাছেই নিতান্ত একটা খেলা নয়, তা বেঁচে থাকার রসদ। প্রতি দিনের হেরে যাওয়ার গ্লানি মুছে যায় প্রিয় দলের জয়ে; দল হেরে গেলে অনেকের বাড়িতে রাতে উনুনে হাঁড়ি চড়ে না আজও।
উত্তর ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে যখন আজও নিচু জাতের ছোঁয়া বাঁচিয়ে চলে উঁচু জাতির লোকেরা, তখন স্বাধীনতার আগে থেকেই ফুটবলের মতো ‘বডি কনট্যাক্ট’ খেলায় বাঙালির কোনও ছুতমার্গ ছিল না। দলিত খেলোয়াড়কে কাঁধে তুলে নিতে উচ্চবর্ণের, অথবা মুসলমান গোলদাতাকে বুকে জড়িয়ে ধরতে হিন্দুর আপত্তি হয়নি কখনও। ভিন রাজ্যের অবাঙালি খেলোয়াড়রা অবলীলায় হয়ে উঠেছেন ‘ঘরের ছেলে’।
তবুও, সেই ফুটবলই বাঙালিকে দাঁড় করিয়ে দেয় অন্য এক বিপন্নতার সামনে। প্রতিটি ‘বড় ম্যাচ’-এর দিন। বাঙালির ফুটবল সংস্কৃতির সঙ্গে ঘটি-বাঙালের দ্বন্দ্বকে আলাদা করা অসম্ভব। কিন্তু, সব ইতিহাস ভুলে যখন উদ্বাস্তু বা তাঁদের পরবর্তী প্রজন্মের সমর্থকদের টিটকারি দেওয়া হয় ‘পিঠে কাঁটাতারের দাগ’ বলে, তখন মনে হয়, বড় আত্মবিস্মৃত আমরা। যে ঘটনা একটা জাতির সম্মিলিত বিষণ্ণতা হওয়ার কথা ছিল, তা-ও কি খুচরো শত্রুতার অস্ত্র হতে পারে?
একটা চাপা বিদ্বেষ কি আগেও ছিল না? ছিল তো। কিন্তু সেই বিদ্বেষ নিয়ন্ত্রিত পর্যায়ে ছিল। জানি না, হয়তো আজকের সর্ব ক্ষণের ভার্চুয়াল দুনিয়ার বাসিন্দারা ভুলেই গিয়েছেন, উল্টো দিকে যিনি আছেন, তিনিও তাঁরই মতো মানুষ। দুই ক্লাবের সমর্থকরা পরস্পরকে যৌনগন্ধী গালাগালি দিয়ে নিজেদের ক্লাবের প্রতি ভালবাসা এবং আনুগত্য প্রদর্শন করেন। ‘সুযোগ পেলেই মারব’— ভেবে তৈরি থাকার মন্ত্রণা প্রকাশ্যেই করে ফেলছেন কেউ কেউ। এর ফলে ম্যাচ-পরবর্তী নানা অপ্রীতিকর ঘটনা সামনে আসছে। মাঠের বাইরে ঝামেলার খবর শুনে মন কেমন করে মা-র— খেলা দেখে ছেলে ঘরে ফিরবে তো ঠিক?
সাম্প্রতিক অতীতে উত্তর-পূর্ব ভারত থেকে কলকাতায় আগত সমর্থকদের প্রতি জাতিবিদ্বেষী মন্তব্য এবং ধর্ষকামী অঙ্গভঙ্গি করার মাধ্যমে ময়দানের গৌরবে কালি লাগার বন্দোবস্ত করেছেন এক শতাব্দীপ্রাচীন ক্লাবের সমর্থকরা। মারামারির প্রবণতা এবং মাঠের বাইরে ‘দেখে নেওয়া’র মানসিকতায় বিগত ডার্বিগুলিতেও ঝামেলা হয়েছে। ডুরান্ড ডার্বির কোন্দলে ভুয়ো ছবি ছড়িয়ে ঝামেলার চেষ্টাও সুস্থ ফুটবলবোধ নয়। মহামেডান স্পোর্টিংয়ের খেলা থাকলে মুসলমান সমর্থকদের পোশাক-দাড়ি-টুপি নিয়েও আসে ধর্মকেন্দ্রিক আক্রমণ। এই ঘৃণা অবশ্য ফুটবল মাঠের গণ্ডিতে আর আবদ্ধ নয়। অথচ এই ময়দানই এক জন মুসলমান খেলোয়াড়কে মাঠের কোণে নমাজ পড়ার জায়গা করে দেয়।
অনেকে অশ্রাব্য গালাগালি ইত্যাদির পক্ষে বলেন, “ময়দানের নিজস্ব ভাষা আছে। সেগুলো তেমনই থাকতে দিতে হবে। সুশীলবোধ যেন সেখানে নাক না গলায়।” কে জানে, নিজের ক্লাবকে মা ভেবে বিপক্ষ সমর্থকের মা’কে গালাগালি দিতে পারার ব্যক্তিস্বাধীনতা হয়তো তাঁদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। পরিবারের কয়েক প্রজন্মের ঐতিহ্য বজায় রাখতে বাবার হাত ধরে খেলা দেখতে গিয়ে কোনও সমর্থকের শিশু বা কিশোর সন্তান শিখে নেয় সেই ভাষা আর ভঙ্গি। সে হয়তো জানবে, এটাই ফুটবল মাঠের ঐতিহ্য।
ফুটবলপ্রিয় মানুষ কেন মারদাঙ্গা চাইবেন? এমনও মানুষ আছেন, যাঁরা নিজের প্রিয় দলের জয়ের উৎসবে যোগ দেওয়ার পাশাপাশি চেষ্টা করেন পরাজিত বিপক্ষ দলের সমর্থকদের আগলে বাড়ি পৌঁছে দেওয়ার। ঝামেলা থামাতে গিয়ে তাঁদের শুনতেও হয়: “ওরা যখন মেরেছিল, তখন আপনি কোথায় ছিলেন?” এ ভাবে ‘ওরা মেরেছিল, তাই আমাদেরও মারতে হবে’-র ঘৃণা তৈরি করে আর একটি যুদ্ধের মঞ্চ। কিন্তু ফুটবল যুদ্ধ থামায়, আক্রান্তের পাশে থাকে, ভালর পক্ষ নেয়। দিদিয়ের দ্রোগবা নিজ দেশের গৃহযুদ্ধ থামাতে ফুটবলকেই বেছে নিয়েছিলেন।
তবে কি মাঠের বাইরে পারস্পরিক রসিকতা থাকবে না? বাঙালির বুদ্ধিদীপ্ত ঠাট্টা, মজার ছড়া, প্রাণবন্ত স্লোগানই তো তার অনন্য বৈশিষ্ট্য। তবে নোংরামি আর রসবোধের ফারাকটা বোঝা জরুরি। ১৯৮০-র ১৬ অগস্টের স্মৃতি আজও তাড়া করে বেড়ায় অনেককে। ছোট ছোট আগুন এক সময় বড় আকার নেয়। তা আগেভাগে বুঝবার উপায় থাকে না। মান্না দে-র গানে বর্ণিত সে দিন বাড়ি না ফেরা খোকার বাবা রক্ত দিয়ে লিখে আর্জি জানিয়েছিলেন, “তোমরা আমার একটাই কথা রেখো/ খেলার মাঠে কারও খোকা আর না হারায় দেখো।”
এই কথাটা মন্ত্রের মতো মনে রাখা জরুরি। খেলার মাঠকে যুদ্ধক্ষেত্র করে তুলতে উদ্যত সমর্থককে বলা জরুরি, “শান্ত হও ভাই। ফুটবল এ সবের চেয়ে অনেক সুন্দর।”