গণতন্ত্রের ক্ষতি হলে অর্থনীতিরও স্বাস্থ্যরক্ষা করা যাবে না
Indian Democracy

ভাবতে ভয় হয়

স্বাধীন ভারতের আইনসভায় দেশের সংবিধান গৃহীত হওয়ার ৭৫ বছর চলছে এখন। এই পঁচাত্তর বছরে দেশের যাত্রাপথটি অতি উল্লেখযোগ্য।

Advertisement

কৌশিক বসু

শেষ আপডেট: ৩০ মার্চ ২০২৪ ০৮:০৫
Share:

উদার: ভূতপর্ব প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহের সঙ্গে অমর্ত্য সেন। জানুয়ারি ২০১৫, নয়াদিল্লি —ফাইল চিত্র।

ভারত বিষয়ে কিছু ব্যক্তিগত কথা বলব এই লেখায়— ভারত সম্বন্ধে আমার আশা এবং আশঙ্কা, দুটোর কথাই বলব। স্বাধীন ভারতের আইনসভায় দেশের সংবিধান গৃহীত হওয়ার ৭৫ বছর চলছে এখন। এই পঁচাত্তর বছরে দেশের যাত্রাপথটি অতি উল্লেখযোগ্য। ভারত গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতাকে বেছে নিয়েছিল, সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করেছিল, তৈরি করেছিল উচ্চশিক্ষা ও বিজ্ঞানচর্চার একাধিক প্রতিষ্ঠান। ভুলত্রুটি বিলক্ষণ ছিল, কিন্তু সব মিলিয়ে রাজনৈতিক ও সামাজিক স্তরে ভারত যা অর্জন করতে পেরেছিল, তা বিশ্বের উন্নততম দেশগুলির সঙ্গে তুলনীয় ছিল। গত একশো বছরে বহু দরিদ্র দেশ ঔপনিবেশিক শাসন থেকে স্বাধীনতা অর্জন করেছে। শুরুতে তাদের অনেকগুলিই ভারতের মতো গণতন্ত্র গ্রহণ করেছিল, সংবাদমাধ্যমকে স্বাধীন রাখতে চেয়েছিল। সে শপথ টেকেনি— কখনও সামরিক অভ্যুত্থান ঘটেছে, কখনও একনায়কতন্ত্র এসেছে, কখনও উত্থান ঘটেছে ধর্মীয় মৌলবাদের। ভারত এক প্রবল ব্যতিক্রম হিসাবে টিকে রয়েছে।

Advertisement

স্বীকার করতেই হবে যে, ভারতের সেই উজ্জ্বল যাত্রাপথে ১৯৭৫ সালের জরুরি অবস্থার কলঙ্ক লেগেছিল। গণতন্ত্রের কণ্ঠ রোধ করার জন্য ইন্দিরা গান্ধীর কঠোর সমালোচনা করতেই হবে। কিন্তু একই সঙ্গে মনে রাখতে হবে যে, তিনি এমন একটি কাজ করেছিলেন, যা কোনও স্বৈরাচারী শাসক করেন না— তিনি নির্বাচনের আয়োজন করেছিলেন, সেই নির্বাচনকে স্বাধীন ভাবে আয়োজিত হতে দিয়েছিলেন। ১৯৭৭ সালের সেই নির্বাচনে ইন্দিরা পরাজিত হন, ভারতও গণতন্ত্রের পথে ফিরে আসে।

ইন্দিরা নির্বাচন ডেকেছিলেন কেন, তা নিয়ে গবেষকরা বিস্তর চর্চা করেছেন। অনেকে বলেছেন, এ হল স্বৈরতন্ত্রী শাসকের অহমিকা— ইন্দিরা নিশ্চিত ছিলেন যে, তিনিই জিতবেন। এ কথাটা কতখানি সত্য, তা নিশ্চিত ভাবে জানার উপায় নেই; কিন্তু, এ প্রসঙ্গে প্রণব মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে আমার শেষ যে বার কথা হল, তার কথা মনে পড়ছে। প্রণবদা তখন ভারতের রাষ্ট্রপতি, তাঁর সঙ্গে দেখা করতে রাষ্ট্রপতি ভবনে গিয়েছিলাম। অনেকেই হয়তো জানেন না যে, প্রণবদা অতি পণ্ডিত মানুষ ছিলেন, তাঁর স্মৃতিশক্তি ছিল বিস্ময়কর। ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতার কথা মাথায় রেখে জিজ্ঞাসা করলাম, ইন্দিরা নির্বাচন ডেকেছিলেন কেন? প্রণববাবু দ্ব্যর্থহীন ভাষায় উত্তর দিলেন, ১৯৭৬-এর শেষ থেকেই ইন্দিরা আফসোস করতে আরম্ভ করেন যে, তিনি ভারতের বৃহত্তম শক্তিটির ক্ষতি করেছেন— ভারতীয় গণতন্ত্রের, যা তাঁর বাবার উত্তরাধিকার। প্রণববাবু বলেছিলেন যে, ইন্দিরার রাজনৈতিক হাওয়া বোঝার ক্ষমতা অতি তীক্ষ্ণ ছিল। তিনি প্রণববাবুকে বলেছিলেন যে, তিনি জনসমর্থন হারিয়েছেন বলে টের পাচ্ছেন; ইন্দিরা জানতেন, তিনি নির্বাচনে হারবেন।

Advertisement

ভারতীয় গণতন্ত্র কতখানি মজবুত, তার কিছু প্রত্যক্ষ প্রমাণ আমি পেয়েছি। ২০১০ সালের ৩ অগস্ট, দিল্লির বিজ্ঞান ভবনে অমর্ত্য সেনের বক্তৃতা। মঞ্চে বসে আছেন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ। প্রেক্ষাগৃহে তিলধারণের জায়গা নেই— টেলিভিশন ক্যামেরাও শুধু মঞ্চের দিকে তাক করতে পারছে না, কারণ দর্শকাসনে বসে আছেন শর্মিলা ঠাকুরের মতো ব্যক্তিত্বও। বক্তৃতার মাঝপথে অমর্ত্য সেন মায়ানমার বিষয়ে মনমোহন সিংহের সরকারের বিদেশনীতির কড়া সমালোচনা করলেন। আমার পাশে বসা বেশ কয়েক জন উচ্চপদস্থ আমলা প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে তাঁর প্রকাশ্য সমালোচনায় স্তম্ভিত।

অমর্ত্যদার বলা শেষ হলে সমাপ্তি ভাষণে প্রধানমন্ত্রী বললেন, কেন তিনি মনে করেন যে, অমর্ত্য সেনের কথাগুলি ভুল। তার পর অনুষ্ঠান শেষ হল— অমর্ত্যদা ও ডক্টর সিংহ হাসিমুখে গল্প করতে করতে মঞ্চ থেকে নেমে এলেন। ভারতীয় গণতন্ত্র কতখানি পরিপক্ব, বাক্‌স্বাধীনতা ও সভ্য বিতর্কের জন্য তা কতখানি জায়গা দিতে পারে, তার প্রত্যক্ষ প্রমাণ পেয়ে গর্বে বুক ভরে উঠেছিল।

উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। আমি যখন দিল্লি স্কুল অব ইকনমিক্স-এ পড়াতাম, মাঝেমধ্যে আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যোগ দিতে বিদেশে যেতে হত। সেই সব সম্মেলনে প্রবল আধিপত্য ছিল আমেরিকা আর ইউরোপের— মুষ্টিমেয় ব্যতিক্রম ছিল, তার মধ্যে ছিল ভারত, সম্মানে যার আসন ছিল আমেরিকা-ইউরোপের পাশেই। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরেই একাধিক আইআইটি এবং বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তোলার পিছনে যে বিনিয়োগ করেছিল ভারত, উচ্চশিক্ষার পরিসরে মুক্ত চিন্তা, আলোচনা, তর্কের, এবং নতুন কথা বলার যে সংস্কৃতি গড়ে তুলেছিল, তার জোরেই আমরা আন্তর্জাতিক মঞ্চে স্বচ্ছন্দ হতে পেরেছিলাম।

আমি কখনও কোনও রাজনৈতিক দলের সদস্যপদ নিইনি। চিন্তা এবং আদর্শের ক্ষেত্রে কেউ উপর থেকে মতামত চাপিয়ে দেবেন, এবং আমাকে সেটা মেনে চলতে হবে, এটা আমার কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। ২০০৯ সালে যখন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ আমায় তাঁর সরকারের মুখ্য অর্থনৈতিক উপদেষ্টা হতে আহ্বান করলেন, আমি তাঁকে বলেছিলাম যে, আমি সেই দায়িত্ব নিতে পারলে অত্যন্ত খুশি হব, কিন্তু কোনও রাজনৈতিক দলে যোগ দিতে পারব না, এমনকি আলগা ভাবেও নয়। আলোচনার টেবিলে নতুন চিন্তাভাবনা নিয়ে আসার স্বাধীনতা আমার চাই। ডক্টর সিংহ বললেন, তিনিও ঠিক এটাই চান। আমি যোগ দিলাম কাজে।

আজও আমি কোনও রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত নই। কিন্তু, ২০২৪ সালের প্রথমার্ধে দাঁড়িয়ে স্বীকার করতেই হবে যে, ভারত যে দিকে চলেছে, তাতে আমি উদ্বিগ্ন। গত দশ বছরে প্রশংসনীয় কিছু নীতি গৃহীত হয়েছে ঠিকই, কিন্তু সব মিলিয়ে ভারতের ভিতে ভাঙন ধরেছে। গত অর্থবর্ষে দেশের জিডিপি বৃদ্ধির হার ছিল ৭.৬%। মন্দ নয়। কিন্তু, পরিসংখ্যানের দিকে তাকালে দুটো কথা স্পষ্ট হবে। এক, বৈশ্বিক আর্থিক মন্দার বছর ২০০৮ বাদ দিলে ২০০৩ থেকে ২০১১ পর্যন্ত ভারতীয় অর্থব্যবস্থায় জিডিপির বৃদ্ধির যে হার ছিল, বর্তমান বৃদ্ধির হার তার তুলনায় শ্লথতর। দ্বিতীয়ত, ২০১৬ সাল থেকে টানা পাঁচ বছরের প্রতি বছর আর্থিক বৃদ্ধির হার তার আগের বছরের তুলনায় কম ছিল। ভারতে এ জিনিসটা আগে কখনও হয়নি। বিশ্ব ব্যাঙ্কের পরিসংখ্যান বলছে, মাথাপিছু আয়ের নিরিখে বাংলাদেশ ২০১৮ সালে ভারতকে টপকে গিয়েছে, এবং তার পরের পাঁচ বছর সেই অবস্থান বজায় আছে। বাংলাদেশের উপর ক্ষুব্ধ হওয়ার কোনও কারণ নেই— যে কোনও উন্নয়নশীল দেশের এই অগ্রগতি খুশির খবর। কিন্তু, দশ বছর আগেও ভারতের এই অবস্থা কল্পনা করা যেত না।

দ্বিতীয়ত, ভারতে যে আর্থিক বৃদ্ধি ঘটছে, দুর্ভাগ্যজনক ভাবে তার প্রায় পুরোটাই অতিধনীদের কুক্ষিগত। ভারতীয় তরুণদের মধ্যে বেকারত্বের হার, এবং দেশে সার্বিক আর্থিক অসাম্য সর্ব কালের সর্বোচ্চ স্তরে পৌঁছেছে।

কেন এমনটা ঘটছে, তা নিশ্চিত করে বলা মুশকিল। কিন্তু এ কথা বলাই যায় যে, ঘৃণা এবং মেরুকরণের রাজনীতি ভারতের অর্থনৈতিক ভিত্তির ক্ষতি করছে। অর্থনীতির অগ্রগতি শুধুমাত্র রাজস্ব বা মুদ্রানীতির উপরে নির্ভর করে না, তা দেশে সার্বিক আস্থা ও বিশ্বাসের উপরেও নির্ভরশীল। তার ক্ষতি হলে অর্থনীতিও ধাক্কা খায়। দ্বিতীয় কারণটি হল, এখন ভারতে রাজনীতি করতে আর স্লোগান দিতে যত সময় ব্যয় করা হয়, বিশ্লেষণ, পরিসংখ্যান বা বিজ্ঞানের পিছনে তার অংশমাত্রও দেওয়া হয় না। স্বাধীনতার আদি পর্বে উচ্চশিক্ষায় যে বিপুল বিনিয়োগ করা হয়েছিল, তার সুফল হিসাবে ভারতে প্রতিভাবান মানুষ রয়েছেন প্রচুর। গোটা দুনিয়া তাঁদের সাদরে ব্যবহার করে। কিন্তু এখন বিশ্ববিদ্যালয়গুলি যত রাজনীতির কবলে পড়ছে, বাক্‌স্বাধীনতা যত খর্বিত হচ্ছে, ততই বিজ্ঞানকে পিছনে ঠেলে দিয়ে রাজনৈতিক সুবিধাবাদ তার জায়গা দখল করছে।

এর বিপদ কোথায়? গত শতকের পঞ্চাশের দশকের আমেরিকার একটা গল্প বলি, তার থেকেই ভারতের বিপদটা বোঝা যাবে। স্কুলশিক্ষকের চাকরির ইন্টারভিউ দিতে আসা এক যুবককে প্রশ্ন করা হয়েছিল, “পৃথিবী গোল, না সমতল?” সে সময় আমেরিকায় পৃথিবীর আকার নিয়ে বিভিন্ন প্রবল ধর্মীয় এবং রাজনৈতিক গোষ্ঠীর মধ্যে বিরোধ চরমে। যুবক সে কথা জানতেন। তিনি উদ্বিগ্ন মুখে উত্তর দিলেন, “আমি দু’রকমই পড়াতে পারব!”

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement