Firecrackers

শুধুই কি রুটিরুজির প্রশ্ন

বাজি মানুষের নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস নয়। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশই বলছে, একমাত্র ‘সবুজ বাজি’ দেশে উৎপাদন এবং ব্যবহার করা যাবে।

Advertisement

কুন্তক চট্টোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ১০ জুলাই ২০২৩ ০৫:৩৭
Share:

—প্রতীকী ছবি।

সাম্প্রতিক পঞ্চায়েত ভোটে গ্রামীণ এলাকায় কর্মসংস্থান, শিল্প ইত্যাদি নানা বিষয়ে কথা বলেছেন রাজনৈতিক দলের নেতারা। গ্রামাঞ্চলের আর্থসামাজিক সমস্যা পেরিয়ে পরিবেশ রক্ষা নিয়েও কথা বলেছেন কেউ কেউ। তবে এত কিছুর মাঝে তেমন জোরে শোনা যায়নি একটি বিষয়। বাজি কারখানার বিপদের কথা। অথচ, বাজির শব্দ কিন্তু মানুষের কানে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছে। সে ধর্মীয়-সামাজিক উৎসবে শব্দবাজি হোক কিংবা ভোটের মুখে বোমাবাজি। তা ছাড়া, গত কয়েক বছরে মাঝেমধ্যেই বাজি কারখানায় বিস্ফোরণের ঘটনা তো রয়েইছে।

Advertisement

তবে বাজির মতো শিল্পের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক নেতাদের গলার স্বর একেবারেই ওঠে না বললে সত্যের অপলাপ হতে পারে। বাজি কারখানার বিস্ফোরণের পরে বিরোধী নেতারা জাতীয় তদন্তকারী সংস্থার (এনআইএ) তদন্ত চেয়ে প্রায়শই গলা ফাটান। শাসক দলের নেতারাও গলা ফাটান, তবে উল্টো সুরে। রাজ্যের বাজি কারখানায় বোমা বাঁধা হয় না, এই তত্ত্ব প্রতিষ্ঠার চেষ্টায় তাঁদের খামতি থাকে না। শাসক দলের এক সাংসদ (তিনি একদা ফিজ়িক্সের মাস্টারমশাই ছিলেন) তো অতিরিক্ত গরমের জন্য বারুদ ফেটেছে, এই তত্ত্বও শুনিয়েছেন। কিন্তু দলমত-নির্বিশেষে যে কথা প্রায় শোনাই যায় না, তা হল রাজ্যে গ্রামেগঞ্জে এ ভাবে ব্যাঙের ছাতার মতো বাজি কারখানা থাকবে কেন? কেন বেআইনি বাজি কারখানা একেবারে তুলে দেওয়া হবে না?

বাজি মানুষের নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস নয়। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশই বলছে, একমাত্র ‘সবুজ বাজি’ দেশে উৎপাদন এবং ব্যবহার করা যাবে। বাজি পোড়ালে ধোঁয়া বেরোবেই এবং সেই ধোঁয়া থেকে দূষণ একেবারেই হবে না, এ কথা কেউ বলতে পারে না। তবুও মহামান্য আদালতের নির্দেশ মেনে নিয়ে সবুজ বাজি ব্যবহার করা যেতে পারে। সেই বাজি তৈরির অনুমতি দিতে পারে জাতীয় পরিবেশ প্রযুক্তি গবেষণা সংস্থা (ন্যাশনাল এনভায়রনমেন্টাল এঞ্জিনিয়ারিং রিসার্চ ইনস্টিটিউট বা নিরি)। এ রাজ্যের হাতেগোনা সংস্থা সেখানে অনুমতির জন্য আবেদন করেছে। সেই সংস্থাগুলি বড় মাপের এবং যে-হেতু জাতীয় স্তরে আবেদন করেছে, তাই ধরে নেওয়া যায় তাদের লাইসেন্স, অনুমতি সব কিছুই আছে। কিন্তু গত কয়েক বছরে রাজ্যে যে বাজি কারখানায় বিস্ফোরণ হয়েছে, সেগুলির একটিরও লাইসেন্স ছিল না। পরিবেশকর্মীরা বার বারই বলেছেন যে, এ রাজ্যের বেআইনি বাজি কারখানাগুলিই মোট উৎপাদনের সিংহভাগ তৈরি করে। কালীপুজো, দীপাবলিতে পথেঘাটে সেই বাজি বিক্রি হয়। প্রশাসন চুপ করে থাকে। যদিও প্রশাসন প্রতি বছরই বাজেয়াপ্ত বাজির হিসাব দেয়। তবে সেই বাজির পরিমাণ মোট উৎপাদনের কত শতাংশ সে হিসাবে না যাওয়াই ভাল।

Advertisement

প্রশ্ন উঠতে পারে, এত কিছু চোখের সামনে দেখেও তা ভোটের বিষয় হয় না কেন? অন্তত গত দু’বছরে যেখানে গ্রামীণ এলাকায় প্রচুর লোক বিস্ফোরণে মারা গিয়েছেন। গত মে মাসেই এগরায় একটি বাজি কারখানায় বিধ্বংসী ঘটনার পর স্থানীয় জনগণের একাংশ প্রতিবাদ করেছিল। ভোটের বিষয় না-হওয়ার বিষয়টি খুবই সোজা। যে শিল্পের সঙ্গে প্রচুর মানুষ (পড়ুন ভোটার) জড়িত, সেখানে অযথা বিরোধিতা করে ভোট খোয়ানোর ফিকির কোন দল করবে? তা ছাড়া, নিন্দকেরা এ-ও বলে যে ওই কারখানার ভিতরে গণতন্ত্রের উৎসবে ফাটানোর জন্য যে বাজি তৈরি হয়, তা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে কমবেশি সব দলের কাছেই পৌঁছয়। বিস্ফোরণ হলে প্রশাসন, পর্ষদ নড়েচড়ে বসে। দু’-এক জনকে বকুনি বা শাস্তি দেয়। পরে আবার সব কিছু আগের মতোই ‘স্বাভাবিক’ হয়ে ওঠে। এগরার ঘটনার পর অবশ্য সংশ্লিষ্ট থানার আইসিকে শাস্তি দেওয়া হয়েছিল। তবে পুলিশের অনেকেই পরে বলেছেন, দু’মাস আগে যোগ দিয়েও আইসি বেআইনি বাজি কারখানার কথা জানতেন না, সে তো দোষ ঠিকই, তবে কয়েক বছর ধরে থেকেও জেলা পুলিশের কর্তারা কেন ওই বাজি কারখানার মালিকের বিরুদ্ধে মুখে কুলুপ এঁটে রইলেন, তার তদন্ত কে করবে? বাকি রইল রাজ্যের দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ। নিন্দকেরা বলেন, বেআইনি বাজি কারখানার বিরুদ্ধে পর্ষদের ভূমিকা কী, তা অনুসন্ধানে ব্যোমকেশ কিংবা ফেলুদাকে প্রয়োজন। সাধারণের তা বোধগম্য হয় না।

তবে বেআইনি বাজি কারখানাকে একেবারে অযৌক্তিক ভাবে শাসক, বিরোধী দল কিংবা প্রশাসন সমর্থন করে— এ কথা বললে অন্যায় হবে। তাঁরা তো কবে থেকেই বলে আসছেন, আচমকা আইনি পথে সব বেআইনি বাজি কারখানা বন্ধ করে দিলে ওই কারখানাগুলিতে যুক্ত গরিব মানুষের রুটিরুজির কী হবে? এ কথা অস্বীকারের উপায় নেই। এ বার ধরে নেওয়া যাক, কাল রাজ্যের চোরদের কোনও সংগঠন দাবি জানাল যে, চুরি করতে না দিলে তাদের পরিবার খেতে পাবে না। প্রশাসন মানবে তো? কিংবা কোনও ভাড়াটে খুনি বলল যে, খুন না করতে পারলে সংসার চালানো দায় হয়ে উঠবে। তখন পুলিশ-প্রশাসন কী করবে? যদি তাদের শাস্তি মকুব না হয়, তা হলে বেআইনি বাজি কারখানা চলছে কী ভাবে?

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement