সব ভাষার কবিতা জড়ো হলে সেটাই আসল ‘গ্লোবাল পাওয়ার’
Poetry

কবিকে কেন এত ভয়

কবিতা পড়তে আমি যেখানেই যাই— তা সে গ্রিসের পারোস দ্বীপ হোক অথবা দিনহাটা, প্রাগের মিলান কুন্দেরার ফেলে যাওয়া পাড়া হোক অথবা ছত্তীসগঢ়ের বস্তার— আমি খোঁজ করি তরুণ কবির।

Advertisement

সুবোধ সরকার

শেষ আপডেট: ২৪ মার্চ ২০২৪ ০৮:২১
Share:

—প্রতীকী ছবি।

আজ থেকে পঁচিশ বছর আগে যখন প্যারিসের হেডকোয়ার্টার্স-এ বসে ইউনেস্কো একুশে মার্চকে বিশ্ব কবিতা দিবস হিসাবে ঠিক করে, তখন কি তারা জানত না, কবিতা লিখে যুদ্ধ থামানো যায় না? কবিতা লিখে মানুষের মুখে রুটি তুলে দেওয়া যায় না? মানুষের মুখ অনেক বড় কথা, কোনও কবি কি পারেন কবিতা লিখে নিজের জন্য দু’টো রুটি জোগাড় করতে? কবিতা লিখে কি কবি পারেন তাঁর বান্ধবীকে ফিরিয়ে আনতে? কবিতা যখন কিছুই পারে না, তখন এত মানুষ কবিতা লেখেন কেন? এত মানুষ কবিতা বলেন কেন? এত মানুষ কবিতা শোনেন কেন?

Advertisement

সব প্রশ্নের উত্তর আছে, এই প্রশ্নের উত্তর নেই: ২১ মার্চ বিশ্ব কবিতা দিবস আবারও ধাক্কা দিয়ে বলে গেল। এমন কোন ভাষা আছে যে ভাষায় কবিতা লেখা হয় না? এথনোলোগ গাইড অনুসারে পৃথিবীতে ৭১৩৯টি ভাষা আছে, সংখ্যাটি বাড়ে এবং কমে। কমে— যখন ভাষা মারা যায়, বাড়ে— যখন নতুন ভাষা খুঁজে পায় মানুষ, নতুন আবিষ্কৃত ভূখণ্ডে। সে দিন মায়া সভ্যতার কি’শে ভাষায় কবিতা শুনে যেমন অবাক হলাম, তেমনই অবাক হলাম উত্তরবঙ্গে গিয়ে কুড়ুখ ভাষায় কবিতা শুনে। কি’শে বা কুড়ুখ ভাষায় কবিতা লেখা হচ্ছে, সামান্য কয়েক জন পড়বে, বা শুনবে, কী হয়েছে তাতে? শেক্সপিয়র যখন লিখতেন, সামান্য কয়েক জন ‘বর্বর’ ইংরেজ তো শুনতেন বা দেখতেন বা পড়তেন।

কবিতা লিখে যখন কবিরা খেতে পান না, মাথার উপর ছাদ পান না, এখনও গাছতলায় ভিক্ষা করেন দার্শনিক বাউল কবিরা— যাঁদের এক একটা দর্শন জীবন পাল্টে দিতে পারে— তবু কবি মানে ছাই ফেলতে ভাঙা কুলো, যে কুলো দিয়ে ছাই ছাড়া আর কিছুই ফেলা যায় না। একটা ঘর আর দু’বেলা দু’মুঠো কি পেতে পারেন না কবিরা? কবিদের উপর রাষ্ট্রের এত রাগ কেন? ভার্জিলকে নির্বাসিত করা হয়েছিল। ওভিদকে তাড়ানো হয়েছিল। মহারাষ্ট্রে চারশো বছর আগে সমাজের মাথা ব্রাহ্মণেরা খুন করেছিল শূদ্র কবি তুকারামকে। কোনও পুলিশকে তিনি মারেননি, তবু কবি বেঞ্জামিন মোলওয়াজ়কে ফাঁসি দিয়েছিল। জার্মানিতে এবং সোভিয়েট রাশিয়ায় হিটলার এবং স্তালিন কবিদের কবরখানায় পিকনিক করেছিলেন। এর পরেও কেন এক জন কবি কবিতা লেখেন? এ এক বিস্ময়! কোনও কবি ‘নোবেল পাব’ ভেবে কবিতা লেখেন না। কোনও কবি বিএমডব্লিউ কিনবেন বলে কবিতা লেখেন না। লিখলে তাঁর গাড়িও হবে না, কবিতাও হবে না।

Advertisement

তরুণ কবি রেফাত আলারির গাজ়ায় একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে শেক্সপিয়র পড়াতেন। তিনি তীব্র ভাষায় ইজ়রায়েলকে হত্যাকারী দেশ বলেছিলেন। তীব্র প্রতিবাদে ঝলসে উঠেছিল তাঁর কবিতা। তার মূল্য দিতে হল জীবন দিয়ে। ইজ়রায়েলের বোমারু বিমান তরুণ কবিকে খুন করল। তাঁর পরিবারের আরও চার জনের জীবন শেষ হয়ে গেল। তাঁর স্ত্রী বেঁচে আছেন। তাঁর স্বপ্ন বেঁচে আছে। গাজ়ায় ‘উই আর নট নাম্বারস’ প্রতিষ্ঠিত করেছেন তিনি, রেখে গেলেন স্বপ্ন, সেটাই কবিতা, “ইফ আই মাস্ট ডাই, লেট ইট ব্রিং হোপ, লেট ইট বি আ টেল।”

গাজ়া এমন এক ভূখণ্ড যার কবিরা চিরনির্যাতিত। যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে মোবাইল নম্বর ধরে ধরে তেরো জন কবিকে হত্যা করা হয়েছে। বিশ্ব কবিতা দিবস চলে গেল, ওই দিনটি স্মরণে এটাই আমাদের বার্তা হওয়া উচিত, আমরা প্যালেস্টাইনের কবিদের পাশে আছি। যেখানে যেখানে কবিদের উপর নির্যাতন নেমে এসেছে, আমরা যদি প্রতিবাদ না করি, কে করবে? ওগো রাষ্ট্রনায়কদের দল, তোমরা যে কবিদের মারছ, কে তোমাদের ভাষা দেবে? কান্নার সময় কে তোমাদের মাথায় হাত দেবে? পরাজয়ে কে পাশে থাকবে? আনন্দে কে আনন্দ করবে? গাজ়ায় আজ যে ভাবে কবিরা প্রতিরোধ তৈরি করেছেন তা দেখে মনে পড়ে, প্যারিসের রাস্তায় রাস্তায় হিটলারের ইহুদি-নিধনের বিরুদ্ধে বড় বড় কবিরা অবরোধ তৈরি করেছিলেন সেই সময়। আজ সেই ইজ়রায়েলের বোমা প্রাণ নিচ্ছে প্যালেস্টাইনের তরুণ কবিদের! তোমাদের জন্য আমরা প্রাণ দিয়েছিলাম, সেই তোমরাই আমাদের প্রাণ নিচ্ছ? নিয়তির কোন অট্টহাসির ভিতর কবিতা আটকে পড়ল আজ? রাষ্ট্র কবিতাকে বাঁচাতে পারে না, রাষ্ট্র কবিতাকে মারতে পারে না। তবু কবিকে মৃত আরশোলার মতো তুলে ফেলে দিতে হয়। এত ভয় কেন কবিকে? একটা-দুটো লাইনকে এত ভয়? আধখানা স্তবককে এত ভয় আপনাদের?

সিরিয়ার সবচেয়ে বিখ্যাত কবি অ্যাডোনিস, যাঁর নাম প্রায় প্রতি বছর স্টকহোমের নোবেল কমিটিতে বেড়াতে যায়, সেই কবি যিনি সুরিয়ালিজ়ম এবং সুফিজ়মকে একটা বাদামখোলার ভিতর দুটো দানার মতো ধারণ করে আছেন, সেই কবিকে সারা জীবন নির্বাসনের কবিতা লিখে যেতে হল। রাষ্ট্র তাঁকে চায়নি। তিনিও রাষ্ট্রকে চাননি! কিন্তু চাইলেই কবিকে মেরে ফেলা যায় না। যখন ‘হাউল’ লিখেছিলেন অ্যালেন গিনসবার্গ, তখন সেটা ছিল হোয়াইট হাউসের উপর একটি বোমা রেখে আসা। হোয়াইট হাউস সেই বোমা গিলে ফেলেছিল। কখনও কখনও গিলে ফেলতে হয়। পাকস্থলী এমন একটা জায়গা যেখানে অনেক বোমাই নিষ্ক্রিয় হয়ে থাকে।

কিছু দিন আগে দেখা হয়েছিল চিলির কবি রাউল সুরিতার সঙ্গে। নিকানোর পাররা-র পর চিলির সবচেয়ে বিখ্যাত কবি রাউল সুরিতা। পিনোশে-র পুলিশ তাঁকে জেলখানায় এত অত্যাচার করেছিল যে তিনি এই বৃদ্ধ বয়সে বসে থাকতে পারেন না, উঠে দাঁড়ালেও দাঁড়িয়ে থাকতে পারেন না। সারা ক্ষণ তাঁর সর্বাঙ্গ কাঁপছে। যৌবনে তাঁকে এমন ভাবে মেরেছে পুলিশ যে পঁচাত্তর বছর বয়সেও তিনি কেঁপে চলেছেন। কবিতা লেখার জন্য এত কষ্ট পেতে হল পৃথিবীতে এসে? সান্টিয়াগোর ছেলেমেয়েরা, তরুণ কবিদের দল তাঁর বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে তাঁরই কবিতা মুখস্থ বলে যায়। তিনি হয়তো বুঝতেও পারেন না, কার কবিতা। শুধু তাঁর আঙুলগুলো তিরতির করে কেঁপে যায়।

কবিতা পড়তে আমি যেখানেই যাই— তা সে গ্রিসের পারোস দ্বীপ হোক অথবা দিনহাটা, প্রাগের মিলান কুন্দেরার ফেলে যাওয়া পাড়া হোক অথবা ছত্তীসগঢ়ের বস্তার— আমি খোঁজ করি তরুণ কবির। তার পাশে একটু বসি। তার কবিতা শুনি। তার মুখেই লুকিয়ে আছে কবিতার ভবিষ্যৎ; যা আমি পারিনি, যা আমরা পারিনি তা যেন তার স্পর্ধা আর বিপন্নতার মাঝখানে ভ্রুমধ্য হয়ে জেগে আছে। তরুণ কবির কবিতা পড়ে যখন উঠে বসি, হাতে তুলে নিই বালুরঘাট থেকে চল্লিশ মাইল দূরে থাকা সোহেল ইসলামের কবিতা কিংবা প্রেসিডেন্সি থেকে স্নাতকোত্তর করা দীপশেখর চক্রবর্তীর কবিতা তখন মনে হয়, এসো কবিতা, ছুটে এসো, আমাকে ধরো, আমাকে বাঁচাও, আমাদের যেন রাউল সুরিতার মতো সারা জীবন কাঁপতে না হয়।

গত সপ্তাহে সাহিত্য অকাদেমির আয়োজনে একশো পঞ্চাশটি ভাষায় কবিতা ও গদ্য পাঠ করা হল প্রায় দশ ঘণ্টা ধরে, যা কিনা বলা যায় একটি বিশ্বরেকর্ড। ভারতে চব্বিশটি ভাষা অষ্টম তফসিলের অন্তর্ভুক্ত, কিন্তু তার বাইরে রয়েছে এক হাজারেরও বেশি ভাষা। প্রতিটা ভাষায় কবিতা লেখা হয়। সেই সব ভাষার কবিতা আস্তে আস্তে আবিষ্কৃত হচ্ছে। এই সমস্ত ভাষার কবিতা এক জায়গায় জড়ো হলে সারা ভারত হয়ে উঠবে একটি ‘গ্লোবাল পাওয়ার’। সেটা পাঁচটা নোবেলের চেয়েও শক্তিশালী।

তিনশো কবিকে হয়তো একটা উৎসবে ডাকা যায়, কিন্তু আরও তিনশো বাইরে থেকে যান— তাঁদের ভিতরে হয়তো হিরে লুকিয়ে আছে। এক জন বুদ্ধদেব বসু পেরেছিলেন সমস্ত বৃত্তের বাইরে থাকা একটা হিরের আংটিকে তুলে আনতে, তেমনই এক জন প্রকৃত কবির কাজ এক জন করে কবিকে আবিষ্কার। আমাকে কেউ মনে রাখবে না, কিন্তু আমি যদি এক জন ভাল কবিকে রেখে যেতে পারি, সে-ই হয়ে উঠবে আমাদের চন্দ্রালোকিত শস্যভূমি।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement