—ফাইল চিত্র।
গাজ়ায় এই মুহূর্তে আর কোনও হাসপাতাল নেই। হাসপাতাল সমেত শিশুদের গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে যুদ্ধের আস্ফালনে। আজকের পৃথিবীতে চারিদিকে মানুষের কাজ ও ব্যবহার এত অ-মানবিক যে, মনে হয়, যে গুণে মানুষ নিজেকে মানুষ বলতে পারে, তারা আজ বিপন্ন। মানুষের মানবিক সত্তা ক্রমক্ষীয়মাণ, বিশেষত ক্ষমতাবান লোকেদের মধ্যে— যা চুইয়ে আসছে সাধারণ্যেও। আজ মানবতার সারস্বত চর্চা যতটুকু, চর্যা তার এতটুকুও নয়।
যে কোনও বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার বা প্রযুক্তির উদ্ভাবনের সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয়ে যায় তাকে অস্ত্র হিসাবে ব্যবহারের পন্থা উদ্ভাবন। মানুষের মনে হিংসা ও হিংস্রতার ন্যক্কারজনক প্রদর্শন প্রকট হয়ে ওঠে: কখনও ধর্ম, কখনও জাতীয়তাবাদ বা রাজনীতির নামে। মনে হয়, মানুষ নামের প্রজাতিটি সম্ভবত গুরুমস্তিষ্কের এমন এক বিবর্তনের পথে চলেছে, যেখানে রিপুর প্রাবল্য মহতী আবেগকে নিষ্ক্রিয় করে হিংস্রতার পথে ধাবমান।
প্রাগিতিহাস বলে, আজ থেকে ত্রিশ-চল্লিশ হাজার বছর আগে পৃথিবী থেকে মানুষ-পূর্ব মানব-প্রজাতি নিয়েনডারথালের অন্তর্ধানের জন্য অন্যতম দায়ী মানুষই। অপেক্ষাকৃত উন্নত মস্তিষ্ক ও বুদ্ধির বলে মানুষ নিয়েনডারথালের সঙ্গে সহ-বাস করেও শুধু নিজের প্রতিদ্বন্দ্বী রাখবে না বলে তাদের শেষ করে দিল। সেই হিংস্রতার বীজ বাহিত হয়েছে হাজার হাজার বছর ধরে, যখনই যেখানে সুযোগ পেয়েছে বিপরীত মনের স্ব-প্রজাতিকে হত্যা করতে তার এতটুকু সঙ্কোচ হয়নি। শুধু যে অস্ত্রবলে সে শক্তিমান হয়ে উঠেছে তা নয়, খাদ্য ও জলের মতো দৈনন্দিন আবশ্যক প্রয়োজনে ইচ্ছাকৃত অভাব তৈরি করে, মানুষকে না খাইয়ে অপুষ্টির শিকার বানিয়েছে, মেরেছে পরোক্ষ ভাবে।
আধুনিক সভ্যতার শুরু সংগঠিত কৃষি দিয়ে। পৃথিবীর এই মাটিতে উৎপাদিত সব শস্যতেই সবার সমান অধিকার, এই মানবিক দৃষ্টিভঙ্গিকে তাচ্ছিল্য করে বিপুল সংখ্যক মানুষকে ভুখা মেরেছে অন্য এক দল শক্তিশালী মানুষ। এক-একটা দেশ-মহাদেশের আদি অধিবাসীদের আধুনিক অস্ত্র ও দুর্বুদ্ধিতে পরাস্ত করে, জঙ্গলে নির্বাসিত করে নিজেদের আধিপত্য বিস্তার করেছে। এতেই ক্ষান্ত না হয়ে জঙ্গলের জমির নীচে খনিজ পদার্থ ও জ্বালানি তেল সংগ্রহের জন্য তাদের সেখান থেকেও উচ্ছেদ করেছে, করে চলেছে এখনও। নিজভূমে পরবাসী হয়ে বাঁচছে জনজাতিরা। মার্টিন স্করসেসে-র কিলার্স অব দ্য ফ্লাওয়ার মুন ছবিতে আমেরিকার ওকলাহোমায় ওসেজ জনজাতি অধ্যুষিত এলাকায় খনিজ তেল আবিষ্কারের পর শক্তিশালী শ্বেতাঙ্গ আমেরিকানদের হাতে নিরীহ ওসেজদের হত্যাকাহিনি এমনই এক খণ্ডচিত্র। এ গল্প আজকের নয়, যখন থেকে ভূখণ্ডের অধিকার মানুষ বুঝে নিতে শিখেছে, অন্যের ভূখণ্ড ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা শুরু হয়েছে, তখন থেকেই।
মহাকাব্য-পুরাণ সময়ের প্রতিচ্ছবি হলে বলতে হয়, সভ্যতার নামে বিশ্বে হত্যালীলা চলেছে সেই সময় থেকেই। অপশাসন ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে জনমতকে দমিয়ে দিতে নির্বিচার অত্যাচার ও নিধন চলেছে। আঠারো শতকে ফ্রান্সে জনজাগরণ ও বিপ্লব বিশ্বকে নাড়িয়ে দিয়েছিল, তার পর এসেছিল যন্ত্রশিল্পের প্রসার। যন্ত্র সভ্যতাকে দুরন্ত গতিতে এগিয়ে নিয়ে গেলেও, ক্রমে খসে গেছে মানবতার প্রলেপ। অনৈতিক প্রতিযোগিতা মানুষকে প্রলুব্ধ করেছে, নির্মমও। একদা মধ্য এশিয়ায় প্রথম ঘোড়া বশ করে মানুষ পেয়েছিল গতি, ম্যাসিডোনিয়ার শাসকেরা যুদ্ধে তার ব্যবহার করেছিল। উনিশ-বিশ শতকের সন্ধিক্ষণে বিমান আবিষ্কারে আরও গতিবৃদ্ধি হয়েছে। দু’টি বিশ্বযুদ্ধে তার ব্যবহার লক্ষ মানুষের প্রাণ কেড়েছে। মানুষকে লক্ষ্য করে বোমা, ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। পারমাণবিক অস্ত্র-সহ মানুষ মারার সরঞ্জাম দেশে দেশে মজুত কিংবা উৎপন্ন হয়েই চলেছে। অস্ত্রভান্ডারের হিসাব এখন বড় দেশগুলোর শ্লাঘার বিষয়।
দেশ দখলের যুদ্ধ এখনও হয়, আর অন্য দেশের খনিজ সম্পদ ও তেল দখলে এনে বাণিজ্য বৃদ্ধির যুদ্ধও ছড়িয়ে গেছে মানচিত্রময়। আফগানিস্তানের খনিজ সম্পদ দখলের জন্য গত শতকে আমেরিকা ও রাশিয়ার দড়ি টানাটানি চলেছে, বিস্তর আফগান জনজীবনের মূল্যে। দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়ার তেলের দখল নিতে যুদ্ধ হয়ে চলেছে হামেশাই, অন্য কারণ দেখিয়ে। সাম্প্রতিক কালে রাশিয়া-ইউক্রেন ও ইজ়রায়েল-প্যালেস্টাইন যুদ্ধে ক্ষেপণাস্ত্রের লক্ষ্যই সাধারণ মানুষ, নারী, শিশু। রাষ্ট্রপুঞ্জও অনেক সময়ই নীরব সাক্ষী, কার কাছে মানুষ বিচার চাইবে!
রবীন্দ্রনাথ মানুষের মধ্যে সেই মহামানবকে দেখেছিলেন, যার চৈতন্য আলোকের মতো মহাবিকিরণের দিকে চলেছে— জ্ঞানে কর্মে ভাবে। সেই প্রসারণেই তার মহত্ত্ব। কিন্তু আজকের মানুষ চলেছে কোথায়! তথ্যসর্বস্ব জ্ঞান যত বাড়ছে, মন বিকশিত না হয়ে আত্মমগ্ন হচ্ছে, স্বার্থসর্বস্ব ব্যক্তিত্ব তৈরি হচ্ছে। মানুষের চাহিদার শেষ নেই, অবশ্যই তা এগিয়ে যাওয়ার পথ দেখায়। কিন্তু ক্ষুদ্র আরামের মধ্যে জড়ত্বপ্রাপ্ত হয় বিবেক, মনুষ্যত্ব হারিয়ে যায়। মানুষ আজ ক্ষমতাবান স্বেচ্ছাচারী সহ-মানুষের শিকার, নির্দ্বিধায় হত্যায়ও যারা বিচলিত হয় না। মানবিক বোধের এই ক্রমবিলুপ্তই কি ভবিতব্য?