অতিবিলম্বিত: ছাত্রের মৃত্যুর পর যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন অ্যান্টি-র্যাগিং হোর্ডিং, ১০ অগস্ট। —নিজস্ব চিত্র।
যাদবপুরের ছাত্রটির মৃত্যুর পর রাজ্যে যে আলোড়ন হচ্ছে তা বেনজির। তবে বহু ক্ষতি বহু পাপাচার নিয়ে কত আলোড়ন উঠেছে, উঠবে। ‘ভুলছি না ভুলব না’ বলেও আমরা দিব্যি ভুলে বসি। এ বার যদি সত্যিই ব্যতিক্রম ঘটাতে হয়, সেটা শোকপ্রকাশ বা ধিক্কারে ঘটবে না। দরকার সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের সততা ও আত্মসমীক্ষা।
কারা সংশ্লিষ্ট? সবার আগে অবশ্যই যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় সম্প্রদায়। ‘সম্প্রদায়’ বলছি, ‘কর্তৃপক্ষ’ নয়। প্রশাসন নিশ্চয় দায়বদ্ধ, বিশেষত যে আধিকারিকেরা ছাত্রদের দেখভালের দায়িত্বে। পাশাপাশি দায়ী সমগ্র শিক্ষকগোষ্ঠী, কারণ ছাত্রাবাসের এই সমস্যার কথা জানা সত্ত্বেও তার সমাধানে আমরা কখনও তেমন উদ্যোগী হইনি। কর্মকালে হইনি আমিও, তাই আমিও তেরো বছর অবসরের দোহাইয়ে দায়মুক্ত নই। দায়মুক্ত নন সেই দরদি শিক্ষকেরা, দুর্ঘটনার পর যাঁরা আপ্লুত হয়ে ছুটে গেছেন, কারণ (দু’-এক জন ব্যতিক্রম থাকতে পারেন) তাঁরাও আগে এই সমস্যায় দৃষ্টি দেননি, অন্যান্য কর্তব্যের ভিড়ে দিতে পারেননি। মুষ্টিমেয় যাঁরা দিয়েছেন, তাঁরা লাঞ্ছিত ও হতোদ্যম হয়ে ফিরে এসেছেন। আজ যেন আমরা পরস্পরকে দোষারোপ না করি, এই মমর্ন্তুদ ঘটনার জেরে কর্তৃপক্ষ বা সহকর্মীদের প্রতি অশ্রদ্ধা-অভিযোগ উগরে না দিই।
বিশ্ববিদ্যালয় সম্প্রদায়ের বৃহত্তম অংশ ছাত্রকুল। যাদবপুরে ছাত্ররা যতটা গুরুত্ব ও স্বাধীনতা পায়, খুব কম তুলনীয় অগ্রণী প্রতিষ্ঠানে তা দেখা যায়। স্বাধীনতার সদ্ব্যবহার ও অপব্যবহার দুটোই সম্ভব, সেটাই স্বাধীনতার চরিত্র। অপব্যবহারের ধারাবাহিক উদাহরণ, অতীতে যখনই কর্তৃপক্ষ র্যাগিং-এর বিরুদ্ধে কঠোর হতে চেয়েছেন, দোষীদের শাস্তিবিধান করেছেন, ছাত্রদের সবচেয়ে সক্রিয় অংশ প্রতিবাদ করেছে, তুলকালাম বাধিয়েছে, প্রশাসক ও শিক্ষকদের হেনস্থা করেছে। সেই সঙ্গে ক্যাম্পাস সুরক্ষার প্রাথমিক পদক্ষেপ বানচাল করেছে, যেমন সিসিটিভি বসানো বা রাতে বহিরাগতদের চত্বরে নিষেধ করা। এই ব্যবস্থাগুলি কেন বাক্স্বাধীনতা বা মুক্তচিন্তার পরিপন্থী হবে তা স্পষ্ট নয়। কোনও কার্যকর বিকল্প প্রস্তাবও ছাত্রেরা কোনও দিন পেশ করেনি। এ বারও অন্তত একটি সংগঠন সভা ডেকে সিসিটিভি বসানোর প্রতিবাদ করেছে।
আজ যারা ছাত্র, দশ-বিশ-পঁচিশ বছর আগে অবশ্যই ছিল না। আগের নজির ভুলে আজ তাদের বলা যাক, তোমরা কি সত্যি র্যাগিং-এর উপশম চাও, ক্যাম্পাসে নিরাপত্তা চাও? তা হলে কিন্তু উপরের প্রত্যেকটি ‘চলবে না’কে— তোমাদের আন্দোলনের ভাষাতেই— ‘করতে হবে’তে পরিণত করা চাই।
আরও বড় কথা, কোথায় কখন র্যাগিং হচ্ছে, তোমরাই সবচেয়ে বিশদ ভাবে জানো। তোমাদেরও কি দায়িত্ব নেই আগে থেকে সরব হওয়া, দুষ্কর্মের প্রতিরোধ করা, নবাগতদের পাশে সক্রিয় ভাবে দাঁড়ানো, হয়তো নিজেরাই হেল্পলাইন বা হেল্পডেস্ক খুলে? সব জেনেশুনেও যদি তোমরা চুপ থাকো, অর্থাৎ কার্যত অপরাধের প্রশ্রয় দাও (খোলাখুলি সমর্থনের কথা না-ই তুললাম), এই অনাচারকে করে তোলো ছাত্রজীবনের অতিকথার অঙ্গ— বলতেই হয়— অনিবার্য দুর্ঘটনা ঘটলে প্রশাসনের অলিন্দে বা থানার সামনে জনজীবন বিপর্যস্ত করার নৈতিক অধিকার তোমাদের নেই।
এ বার সবচেয়ে মোক্ষম কথা। সততার দরকার বৃহত্তর সমাজের প্রত্যেকের। র্যাগিং কেবল যাদবপুরে ঘটে না, এবং তা দেশভর হিংসার অশেষ প্রকাশের মাত্র একটি। মণিপুর-হরিয়ানার মতো সার্বিক রাষ্ট্রীয় বিপর্যয় ছেড়ে দিলাম, পঞ্চায়েত নির্বাচন উপলক্ষে এত বৈচিত্রময় অনাচার আগে দেখেছি কি? বল ভেবে বোমা তুলে নিয়ে ক’টি শিশুর প্রাণ গেছে, হাত-পা উড়ে গেছে? বাচ্চারা বোঝেনি ওগুলো তাদের নয় বড়দের খেলনা, সিনিয়রদের আমোদে তারা কোল্যাটারাল ড্যামেজ। এই হতাহত শিশুদের নিয়ে ক’টা সভা ক’টা স্টোরি হয়েছে? একান্ত নিকটজন ছাড়া ক’টা রাজ্যবাসীর ঘুম ছুটেছে?
ন’বছর আগে এনআরএস ছাত্রাবাসে একটি মানুষকে পিটিয়ে খুন করা হয়েছিল: ছাত্র নয়, পথবাসী, হয়তো মানসিক রোগাক্রান্ত। তদন্ত কিন্তু এগিয়েছিল ধীরে সন্তর্পণে, প্রবীণ চিকিৎসকদের খাতিরে হবু-চিকিৎসকদের পরীক্ষা ও কেরিয়ারকে সমীহ করে। বৃহত্তর সমাজ তেমন শিউরে ওঠেনি।
কথাগুলো ‘হোয়াটঅ্যাবাউটরি’র ঢঙে বলছি না। এই ঘটনার ভার এতে বিন্দুমাত্র কমে না, কমে না দোষীদের অপরাধ ও শাস্তিযোগ্যতা। বলছি মনে করিয়ে দিতে, এই হিংসার বীজ রক্তবীজের ঝাড়, সবার ধমনীতে বইছে। সংক্রমণ নির্মূল করার যথাযোগ্য চেষ্টা করলে আমাদের রাতের ঘুম সত্যিই ছুটবে, নানা গোষ্ঠীস্বার্থে টান পড়বে।
বিশেষ করে বলতে হয় রাজনীতিকদের কথা। এই ছাত্রটির মৃত্যুতে সকলের প্রতিক্রিয়াতেই অন্তত আনুষ্ঠানিক শোক ও শোভনতা প্রকাশ পেয়েছে। ব্যতিক্রম দলনির্বিশেষে আমাদের নেতারা। ঘটনাটা যে তাঁদের কাছে দলীয় রাজনীতির ইন্ধন বই কিছু নয়, সংবাদে সমাজমাধ্যমে সেই অশ্লীল নির্ঘোষ তাঁরা করে চলেছেন।
দেশ জুড়ে রাজনৈতিক দলগুলির বলশালী ছাত্রসংগঠন আছে। যে দলের যেখানে ঘাঁটি, তার বাহিনী সেখানকার ক্যাম্পাসজীবন বিপর্যস্ত করে, অনাচার অত্যাচার চালায়, তাণ্ডবও। সেই বাস্তুতন্ত্রে ‘অরাজনৈতিক’ দুরাত্মারাও গোকুলে বাড়ে।
এক পরাক্রমশালী নেতা সে-দিন কিছু লাঞ্ছিত শিক্ষকদের বলেছেন, “আপনাদের ছাত্রদের আপনারা সামলাতে পারেন না?” এর একমাত্র জবাব: ছাত্রদের সুস্থ পথে চালিত করা অবশ্যই শিক্ষকের কর্তব্য, কিন্তু আপনাদের মতো তাবড় নেতারা আসরে নামলে সামলায় কার সাধ্য? শিক্ষায়তনের কর্তৃপক্ষকে কর্তব্যচ্যুতির দায় অবশ্যই বইতে হবে, কঠোর হওয়ার সঙ্গত দাবি শুনতে হবে, কিন্তু এই চিরস্থায়ী রাহুগ্রাস থেকে শিক্ষাপ্রাঙ্গণের মুক্তি না ঘটলে কাজের কাজ হওয়া দুষ্কর।
র্যাগিং-এর ক্ষেত্রে এই মেঠো অনাচারের পাশাপাশি একটা অভিজাত প্রভাব কাজ করছে, সেটা দিয়ে শেষ করি। দিল্লিস্থ এক স্কুল বোর্ড এক বার কিছু ইংরেজি পাঠ্যপুস্তক অনুমোদনের জন্য পাঠিয়েছিল। তার একটি পাঠ্যাংশ এক কাল্পনিক চিঠি, মা লিখছেন তাঁর আইআইটি-গামী পুত্রকে। নানা উপদেশ ও আশীর্বাণীর সঙ্গে বলছেন, ওখানে তুমি কিন্তু র্যাগিং-এর মুখে পড়বে। তাতে ঘাবড়ে যেয়ো না, কান্নাকাটি কোরো না। এই অভিজ্ঞতা তোমাকে সত্যিকারের পুরুষমানুষ বানাবে (উইল মেক আ ম্যান অব ইউ)। আজ যারা উৎপীড়ন করছে, তারাই হবে তোমার ঘনিষ্ঠতম সুহৃদ।
হতবাক হয়েছিলাম, বেআইনি ও অ-সভ্য এই লেখা সম্পাদক বাছলেন কোন আক্কেলে, এক সর্বভারতীয় বোর্ডের প্রাথমিক নির্বাচন উতরে চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য পাঠানো হল কী করে। এটা সম্ভব হয়েছিল যে-হেতু প্রতিষ্ঠা থেকেই আইআইটি নামক অত্যুচ্চ বিদ্যাকেন্দ্রগুলির অতিকথায় নানা অনুপ্রেরণার সঙ্গে এই অনাচারটিও কায়েম হয়ে গেছে, আর উদ্বুদ্ধ করেছে দেশের তাবৎ প্রতিষ্ঠানকে, বিশেষত প্রযুক্তি, ডাক্তারি ইত্যাদি তথাকথিত ‘পেশাগত’ শিক্ষাক্ষেত্রে।
যাদবপুরের আবাসিকেরা যে মানসিক অত্যাচারের বর্ণনা দিচ্ছেন, আমি স্থির জানি এক বা একাধিক আইআইটিতে তার প্রত্যেকটি কিছু দিন আগেও অনুষ্ঠিত হত। আরও ঢের কদর্য ও শারীরিক ভাবে হানিকর নজিরের কথা শুনেছি স্কুলের আইআইটি-পাশ সহপাঠীদের মুখে। সে বহু যুগ আগের কথা। আজ আইআইটিগুলিতে শুধু দৈহিক নয়, মানসিক র্যাগিং ঘোষিত ভাবে নিষিদ্ধ। ধরা যাক সেই ঘোষণা একশো ভাগ কার্যকর। তবে ইতিহাসগত হলেও ঐতিহ্যের রেশ সহজে মেলাবার নয়। আজও দুনিয়া জুড়ে আইআইটির কৃতী প্রাক্তনীদের একটা বড় অংশ র্যাগিং-এর গুণগান করেন হুবহু সেই পত্রাচারী মায়ের ঢঙে। কর্তৃপক্ষের কাছে প্রসঙ্গটা তুললে পাবেন রক্ষণাত্মক মৌন। লোকের মনে আজ আদালতের ভয় ঢুকেছে; আগে হলে আক্রমণাত্মক সওয়াল শুনতেন।
আবার বলছি, এতে যাদবপুরের আজকের ঘটনা বা অতীত অন্যায়ের ক্ষালন হয় না। ‘তুমি অধম, তাই বলিয়া আমি উত্তম হইব না কেন?’ যাদবপুরে আমরা বলে থাকি, সুযোগ পেলে আইআইটিকে টেক্কা দিতে পারি; আর কী আশ্চর্য, করেও দেখাই কদাচিৎ। আজ দুর্গতির দিনে যাদবপুরই এগিয়ে আসুক বিদ্যামন্দির থেকে এই অপদেবতাকে দূর করতে।