যুযুধান: গাজ়ার ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ইজ়রায়েলের সমর্থনে মিছিল, ওয়াশিংটন ডি সি, ১৪ নভেম্বর, ২০২৩। ছবি: সংগৃহীত।
গত ৫ ডিসেম্বর আমেরিকার পার্লামেন্টে একটি গুরুতর সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে— সে দেশকে মানতে হবে যে ইহুদি-রাষ্ট্রোদ্যোগের সমালোচনা ইহুদি-বিদ্বেষেরই নামান্তর। স্বয়ং আমেরিকার প্রেসিডেন্টও এক বক্তৃতায় ইহুদি-রাষ্ট্রোদ্যোগের শরিক হিসাবে নিজেকে দাবি করেছেন। স্বভাবতই গোটা মুসলিম দুনিয়া ও প্যালেস্টাইন-সমর্থক মানুষ এই খবরে ক্ষুব্ধ। তাঁরা এর মধ্যে ‘ইসলামোফোবিয়া’ বা মুসলিম-বিদ্বেষের ভূত দেখছেন। এই বিদ্বেষ আছেই, তবে তার সঙ্গে আছে আরও কিছু।
ঘটনা হল, পশ্চিমি দুনিয়া চিরকালই আরব-ইজ়রায়েল সংঘর্ষে ইজ়রায়েলের পক্ষে। পশ্চিমের প্রতিবাদী বামপন্থীরাও এর ব্যতিক্রম নন। প্যালেস্টাইনি দার্শনিক এডওয়ার্ড সাইদ আরব-প্যালেস্টাইনের দুর্দশার প্রতি সিমোন দ্য বোভোয়ার বা জঁ-পল সার্ত্রের মতো ফরাসি বামপন্থীদের উদাসীনতায় একই রকম ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। যাঁরা ভিয়েতনাম মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সরব, তাঁরা প্যালেস্টাইন মুক্তিযুদ্ধের বিষয়ে কেন নিশ্চুপ?
ইজ়রায়েলের প্রতি পশ্চিম দুনিয়ার এই অবাঞ্ছিত পক্ষপাতিত্বকে আমরা কী ভাবে ব্যাখ্যা করব? ইজ়রায়েল-ভূখণ্ড এক দিকে যেমন প্যালেস্টাইনিদের দেশে ইহুদিদের অন্যায় জবরদস্তি উপনিবেশ, আর এক দিকে তেমন হাজার-হাজার বছর ধরে নিগৃহীত ইহুদির আত্ম-প্রতিষ্ঠা-স্পৃহার মূর্ত এক প্রতীক। অ্যাসিরীয়, ব্যাবিলনীয় ও গ্রিক সাম্রাজ্যের হাতে নিগৃহীত হয়ে, এবং শেষে জিশুকে ক্রুশকাঠে ঝোলানোর দায়ে আব্রাহামের সন্তানেরা রোমানদের হাতে তাড়া খেতে খেতে পশ্চিম এশিয়া থেকে ছড়িয়ে গেলেন পৃথিবীর এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে। সেই তখন থেকেই ইহুদি মানেই ঘরছাড়া, অচ্ছুত। ইহুদি মানেই ‘গেটো’র নির্বাসন।
ফরাসি বিপ্লব-পূর্ব ইউরোপীয় সমাজে রাস্তা দিয়ে ইহুদি পথচারী হেঁটে গেলে খ্রিস্টানরা তাঁর ছায়া তো মাড়াতেনই না, বরং প্রকাশ্য দিবালোকে অপমান করতেন। ইউরোপীয় উপনিবেশে কালো মানুষদের মতো ঘৃণার পাত্র ইহুদিরা প্রথম পূর্ণ নাগরিক অধিকার লাভ করলেন ফ্রান্সে— ফরাসি বিপ্লবের দৌলতে। উনিশ শতকের গোড়ায় জার্মানির প্রাশিয়া রাষ্ট্রও ইহুদিদের মুক্তির কথা ঘোষণা করল। ইহুদিরা যেন হাতে চাঁদ পেলেন। কিন্তু মুক্তির এই আকাঙ্ক্ষা অচিরেই মাঠে মারা গেল। ফরাসি বিপ্লবের দৌলতে পাওয়া ডানাটি নেপোলিয়ন ফের ছেঁটে বাদ দিয়ে দিলেন। প্রাশিয়ার প্রতিশ্রুতিও অলীক প্রমাণিত হল। সরকার বা সেনাবাহিনীর দায়িত্বপূর্ণ পদে ইহুদির অধিকার রইল না।
সমাজ-সাংস্কৃতিক স্তরে ঘা-খাওয়া এ-হেন পঙ্গু ইহুদির জাতীয়তাবাদী আকাঙ্ক্ষার সূত্রপাত ঘটে উনিশ শতকের শেষ পর্বে, যার চূড়ান্ত পরিণতি ইহুদি রাষ্ট্রের পরিকল্পনা, যাকে বলা হয় ‘জ়ায়নিজ়ম’ বা ইহুদি-রাষ্ট্রোদ্যোগ আন্দোলন। এই আন্দোলনের হোতা থিয়োডর হেরজ়েল। নিজের লেখাপত্রে হেরজ়েল দাবি করেন, হাজার বছরের সনাতন সাহিত্যে বিবৃত ইহুদির ব্যথা-আশা-আকাঙ্ক্ষার নির্যাসটুকু তিনি তুলে ধরেছেন। বাইবেলের ভাষ্য মোতাবেক ভবিষ্যৎ ইহুদি রাষ্ট্র আসলে ইজ়রায়েল ভূখণ্ড ও ইহুদিদের মধ্যে এক দৈব চুক্তির ফল, অনেকটা স্বপ্নাদিষ্টের মন্দির-নির্মাণ প্রকল্পের মতো।
‘ইহুদি রাষ্ট্র’ প্রকাশিত হওয়ার আগে হেরজ়েল ভাবেননি, এই পুস্তিকা তাঁকে রাতারাতি জনপ্রিয় করে তুলবে, বনে যাবেন মস্ত তাত্ত্বিক। ইজ়রায়েল-প্রতিষ্ঠাকে আর ‘অলীক চিন্তা’ নয়, প্রথম বার এক ‘সম্ভাব্য বাস্তব’ হিসাবে উপস্থাপিত করা হল। “সর্বত্র আমরা জাতীয় সম্প্রদায়গুলির মধ্যে আত্তীকৃত হওয়ার চেষ্টা করেছি, আমাদের পিতৃপুরুষের থেকে অর্জিত বিশ্বাসটুকু সম্বল করে। অথচ আমাদের তা করতে দেওয়া হয়নি।” হেরজ়েলের কলমে ইহুদির এই আর্তি শুনে অনেকে বলেন ফরাসি বিপ্লব ইহুদিদের গেটো থেকে মুক্তি দিয়েছিল সত্য, কিন্তু ইহুদি-মন কখনও গেটো-মুক্ত হতে পারেনি।
ইহুদি-সমস্যা যে কত তীব্র আকার নিয়েছিল তা আমরা মার্ক্সের লেখা পড়ে জানতে পারি। ইহুদির এই মুক্তি-আকাঙ্ক্ষাকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছিলেন কার্ল মার্ক্স ও তাঁর মাস্টারমশাই ব্রুনো বয়েরও। তাঁদের বক্তব্য ছিল, খ্রিস্টান রাষ্ট্রের হাত থেকে এখনও রাজনৈতিক মুক্তি মেলেনি খ্রিস্টান প্রজারই, ইহুদিরা নিজেদের মুক্তির কথা বলে কোন মুখে? তা ছাড়া কেন মানুষের সার্বিক মুক্তির কথা বলা হচ্ছে না? বয়ের ইহুদিদের স্বার্থপর হিসাবে চিহ্নিত করেছেন। তাঁদের মতে, ইহুদি মুক্ত হবে, যে দিন সে নিপীড়িত বিশ্ব-মানবের সঙ্গে একাত্ম বোধ করবে। বয়েরকে সমালোচনা করে মার্ক্স বলেন, ইহুদি মুক্তির প্রশ্নটিকে ধর্মের থেকে বিযুক্ত করে দেখতে হবে। ভবিষ্যৎ-দ্রষ্টা মার্ক্স কি তখনই বুঝেছিলেন ইজ়রায়েল-রাষ্ট্র ধর্মকে পরিহার করতে পারবে না?
‘ইহুদি রাষ্ট্র’ লেখার দিন কয়েক পর হেরজ়েল কর্মসূত্রে প্যারিসে এসে ডেরা বাঁধেন। প্যারিস তখন সারা ইউরোপের সাংস্কৃতিক রাজধানী। রাজনৈতিক ঘাত-প্রতিঘাত ও দ্রেফ্যুস-কাণ্ডে মুখর। ইহুদি-বিদ্বেষ সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। এই আবহ আরও ইন্ধন জোগালো হেরজ়েলের নেতৃত্বকে। ইউরোপের এই মৃত্যু-উপত্যকা ইহুদিদের দেশ হতে পারে না। বর্তমান সমাজ-রাজনৈতিক নিয়তি ইহুদিদের যেন আরও দৃঢ় বন্ধনে জড়িয়ে দিচ্ছে তাঁদের প্রতিশ্রুত ভূখণ্ডের সঙ্গে। তাঁর আন্দোলন হয়ে উঠল আরও প্রাসঙ্গিক, তিনি হয়ে উঠলেন ইহুদির নবি। জীবনের শেষ প্রান্তে এসে, অবশ্য, একের পর এক ব্যর্থতার ঘটনা তাঁর নেতৃত্বকে প্রশ্নচিহ্নের মুখে দাঁড় করায়। সে যা-ই হোক, ইহুদিদের প্যালেস্টাইনে সরাসরি উপনিবেশ পত্তন করার ঝোঁক ক্রমশ প্রবল হয়ে উঠল। সেই ঝোঁকটা যেমন রাজনৈতিক একাধিপত্য বিস্তারের, তেমনই একর একর জমিতে কৃষিক্ষেত্র তৈরি করে বাণিজ্য-বিস্তারের। আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে অনুকূল অবস্থার জন্য তাঁরা অপেক্ষা করতে লাগলেন। বিভিন্ন দেশের সমর্থন খুঁজতে লাগলেন। পাশাপাশি চলল প্যালেস্টাইনে লোক-লস্কর পাঠানোর কাজ।
এ অবধি বেশ ভালই চলছিল। যে কোনও উদ্যোগেই প্রস্তুতিপর্বের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য হয়ে থাকে বাধা। তবে তখনও অবধি বিরোধিতা উঠে আসেনি কোনও শিবির থেকে। পরীক্ষায় অজানা প্রশ্নের মতো বিরোধিতা উঠে এল অপ্রত্যাশিত শিবির, প্যালেস্টাইনিদের পক্ষ থেকে। এ হল ঔপনিবেশকের মনের জটিল ধাঁধা। সে কিছুতেই কবুল করে না যে, সে লুণ্ঠন করতে নয়, স্থানীয়দের উদ্ধার করতে, তাদের বিকশিত করতে এসেছে। আর ইহুদিরা তো মরুভূমির বুকে ‘মরূদ্যান’ রচনা করতেই এসেছেন। ‘অসভ্য’ বেদুইনের জীবনে পৌঁছে দিতে এসেছেন কৃষিসভ্যতার ‘আলো’। ইহুদিদের চড়া দামে জমি বেচে আরবরা নাকি হঠাৎ নবাব বনে গেছে। তাদের বাগানে কমলালেবুর গাছ নুয়ে পড়ছে ফলভারে। এমনই উদ্ভট গাল-গল্পে মশগুল তৎকালীন ইহুদিরা। মূল কথা হল, ইহুদিরা ধরে নিয়েছিলেন প্যালেস্টাইন আসলে এক ফাঁকা মাঠ, জনশূন্য দেশ যেখানে মানুষ থাকে না, থাকে ‘আরব’ নামের বিরল এক দল প্রাণী। এ প্রসঙ্গে বিশ্ব-বরেণ্য ইহুদি অ্যালবার্ট আইনস্টাইনের কণ্ঠেও ঔপনিবেশকেরই সুর। তিনি বলছেন, আরব-ইহুদি ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে দেশটাকে ‘পুনর্গঠন’ করতে হবে, অর্থাৎ ইহুদির প্রয়োজনমাফিক তাকে গড়ে তুলতে হবে।
প্রথম মহাযুদ্ধ সদ্য সমাপ্ত। ‘আরব’রাও যে মানুষ, সে কথা ইহুদিদের হঠাৎ মনে পড়ল ১৯২১ সালে, জেরুসালেমে প্রথম বার যখন দাঙ্গা বাধল। দাঙ্গাকে তখন আইন-শৃঙ্খলার সমস্যা হিসাবে দেখা হচ্ছিল। আরও পরে, আরবরা চিহ্নিত হতে লাগলেন ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠী’ হিসাবে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের প্রাক্কালে ইউরোপে ইহুদি-বিদ্বেষ আবার নতুন করে মাথাচাড়া দিয়ে উঠল। ইউরোপের ভাগ্যনিয়ন্তারা ভাবলেন, ইহুদিদের দেশ তো এখন প্রস্তুত, এখনও কেন ওরা এখানে পড়ে! জার্মানিতে হিটলার-বাহিনীর তদারকিতে শুরু হল সেই ভয়াবহ ইহুদি-খেদাও অভিযান। অস্ট্রিয়া ও চেকোস্লোভাকিয়ায় ভয়ঙ্কর নির্যাতন। মহাযুদ্ধ শেষে ইহুদিদের নিজস্ব রাষ্ট্র ইজ়রায়েল স্থাপিত হল অনেক ধ্বংসের বিনিময়ে। ইউরোপে ইহুদি সমাজটাই তখন প্রায় নিশ্চিহ্ন।
কিন্তু চিরকালের মতো পশ্চিমি চেতনায় ইহুদি পুরনো এক ক্ষতস্থান হয়ে গূঢ়ৈষার মতো দেগে রইল। ইহুদি-বিদ্বেষ মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে দেখলে সে ভিতরে কুঁকড়ে যায়। ইহুদিকে সে নিজস্ব গণ্ডির বাইরে নিরাপদ দূরত্বে দেখতে চায়, আবার তাকে বিপন্নও দেখতে চায় না। ভূরাজনৈতিক কৌশলের প্রশ্ন তো আছেই, তা ছাড়াও এই স্বকৃত অন্যায় ও রক্তাক্ত অতীতজনিত পাপবোধ ইজ়রায়েলের প্রতি পশ্চিমের মনকে কি কিছুটা দুর্বল করে দিচ্ছে?