পশ্চিমবঙ্গে তাপপ্রবাহজনিত কারণে স্কুলগুলিতে ছুটি দিতে ‘বাধ্য’ হয়েছিল সরকার। ছবি: সংগৃহীত।
দিনকয়েকের জন্য দহন কমেছে বটে, কিন্তু বিপদ কমেনি। এই তাপপ্রবাহ শুধু শরীরের আরামকে আঘাত করছে না। তার থেকেও বড় আঘাত হানছে পরিবেশের সঙ্গে জুড়ে থাকা বৃহত্তর জনজীবনের আয়, চিকিৎসাব্যবস্থার মতো বিষয়কে। পশ্চিমবঙ্গে তাপপ্রবাহজনিত কারণে স্কুলগুলিতে ছুটি দিতে ‘বাধ্য’ হয়েছিল সরকার। স্কুল বন্ধ হওয়ায় মিড-ডে মিলও বন্ধ ছিল। অর্থাৎ, নির্দিষ্ট ছুটির বাইরেও খাদ্য থেকে বঞ্চিত হয়েছে পড়ুয়ারা, যাদের অধিকাংশই আর্থ-সামাজিক ভাবে প্রান্তিক স্তরের। সামগ্রিক ভাবে উন্নয়নের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে তাপপ্রবাহ।
বিশ্ব উষ্ণায়ন নতুন নয়। গ্রীষ্ম যে ক্রমশ প্রখর থেকে প্রখরতর হচ্ছে তাও গত কয়েক বছরে স্পষ্ট হয়েছে। ২০২২ সালের এপ্রিল মাসে গত ১২২ বছরের মধ্যে সর্বাধিক তাপমাত্রা ছিল। ওই বছর গ্রীষ্মেও ভারতে প্রবল তাপপ্রবাহ দেখা গিয়েছিল। সেই পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতেই কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটির গবেষক রমিত দেবনাথ, রনিতা বর্ধনের নেতৃত্বে এক দল গবেষক এ ব্যাপারে একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেছেন। তাতে তাঁরা দেখিয়েছেন যে, ভারতের ৯০ শতাংশ এলাকা তাপসূচকে ‘বিপজ্জনক’ জায়গায় আছে। ২০ শতাংশ এলাকা প্রবল বিপন্ন অবস্থায় আছে। ১৯৯২ থেকে তাপপ্রবাহজনিত কারণে ২৪ হাজার মৃত্যুর ঘটনাও ঘটেছে। এই পরিস্থিতিতে ওই গবেষকেরা দেখিয়েছেন, যখনই প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে মৃত্যুর হার বেড়েছে তখনই সুস্থায়ী উন্নয়নের গতি হ্রাস পেয়েছে।
এই পরিস্থিতিতে প্রশ্ন ওঠে, বিশ্ব উষ্ণায়ন এবং জলবায়ু বদলের পরিপ্রেক্ষিতে সুস্থায়ী উন্নয়নের নানা নীতি-প্রকল্পের কথা বলা হলেও তাপপ্রবাহ এবং অন্য জলবায়ু সংক্রান্ত বিষয়গুলি কি নীতি-নির্ধারণের ক্ষেত্রে গুরুত্ব পেয়েছে? সামগ্রিক ভাবে তার প্রতিফলন কিন্তু সরকারি তথ্যে গবেষকেরা পাননি। অথচ আবহাওয়া সংক্রান্ত তথ্য থেকে স্পষ্ট যে, প্রতি বছরই গ্রীষ্মে দহনের পরিমাণ বাড়ছে। কেন্দ্রীয় পরিসংখ্যান এবং পরিকল্পনা মন্ত্রকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালে গোটা দেশে তাপপ্রবাহের দিন এক দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ ছিল। মৌসম ভবনের হিসাবে, ১৮৭৭ সাল থেকে এ-যাবৎ কালের হিসাবে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি উষ্ণতম। সেই সব কিছুকে ছাপিয়ে গিয়েছে এপ্রিল মাস। তাপপ্রবাহের দাপট উত্তর, পশ্চিম, মধ্য ভারতে থেমে থাকেনি। ছোটনাগপুর মালভূমি পেরিয়ে এ বছর শুষ্ক গরম হাওয়া একেবারে পূর্ব ভারতে বঙ্গোপসাগরের তীরে এসে দাপিয়ে বেড়িয়েছে। খাস কলকাতায় গরমকালে আপেক্ষিক আর্দ্রতা ২৫ শতাংশে নেমেছে। শীতকালের মতোই ঠোঁট ফেটেছে। শুধু তা-ই নয়, এ বার গোটা গাঙ্গেয়-বঙ্গ জুড়ে টানা গরম হাওয়া বা লু বয়েছে। যে ঘটনাও অতীতে দেখা যায়নি। কেন্দ্রীয় আবহাওয়া বিভাগের প্রাক্তন ডেপুটি ডিরেক্টর জেনারেল (পূর্বাঞ্চল) গোকুলচন্দ্র দেবনাথ বলছেন, “এমন পরিস্থিতি অন্তত ২৫ বছরে আমি দেখিনি। এই ঘটনা জলবায়ু বদলের নজির।”
পরিবেশবিজ্ঞানীরা বার বারই বলেছেন যে, জলবায়ু বদল পুরোপুরি ঠেকানো সম্ভব নয়। পরিবর্তে বদলের গতি কমানো সম্ভব এবং পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে হবে। সেই লক্ষ্যেই বার বার পৃথিবীর দেশগুলি জলবায়ু সম্মেলনে বসেছে, আলোচনা এবং নীতিগত দড়ি-টানাটানি করে নিজেদের লক্ষ্য স্থির করেছে। তবে সেই লক্ষ্যে পৌঁছনোর ক্ষেত্রে কী কী বিষয় ভাবা প্রয়োজন, সেখানে ঘাটতি কিন্তু থেকেই যাচ্ছে। অন্তত, এ দেশে তাপপ্রবাহের নিরিখে সুস্থায়ী উন্নয়নের গতিতে ধাক্কা খাওয়ার আশঙ্কাই তার প্রমাণ। একই ভাবে দেশের জিডিপি-তেও তা প্রভাব ফেলতে পারে। যদিও কেন্দ্রের এক অর্থনৈতিক উপদেষ্টা সম্প্রতি দাবি করেছেন যে, ভারতের অর্থনীতি যে কোনও ধরনের আবহাওয়াজনিত ধাক্কা সইতে প্রস্তুত।
লক্ষণীয়, তাপপ্রবাহের এই দাপট পাকিস্তান এবং বাংলাদেশেও হয়েছে। সম্প্রতি বাংলাদেশের রাজধানী শহর ঢাকার তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছাপিয়েছে। গত ৫৮ বছরে এত তাপমাত্রা বাংলাদেশের রাজধানী পায়নি। দক্ষিণ পাকিস্তানের বিভিন্ন এলাকাও তাপে পুড়ে কার্যত ছারখার হওয়ার জোগাড়। এই প্রাকৃতিক উপদ্রব কিন্তু ভারতের সামনে আরও একটি পথ খুলে দিয়েছে। তা হল, নিজের ভৌগোলিক সীমার বাইরে প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে সমন্বয় করে জলবায়ু-কূটনীতিতে নেতৃত্ব দেওয়া। বস্তুত, এই ধরনের আন্তর্জাতিক সমন্বয়ের কথা আইপিসিসি বার বারই বলেছে। তবে সেই পরামর্শ দক্ষিণ এশিয়ার ক্ষেত্রে সে ভাবে দেখা যায়নি।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর আমলে দেশের অর্থনীতি আবহজনিত ধাক্কা সইতে পারবে কি না, সে প্রশ্নের উত্তর হয়তো ভবিষ্যৎ দেবে। কিন্তু জলবায়ু বদলের বিপদ ঠেকাতে নীতি-নির্ধারণে তাপসূচকের মতো প্রাকৃতিক ঘটনাকে কি এ বার গুরুত্ব দেবে ভারত? কিংবা প্রতিবেশীর সঙ্গে সীমান্ত দ্বন্দ্ব ভুলে বৃহত্তর পরিপ্রেক্ষিতের কূটনৈতিক সম্পর্ক তৈরি করবে?