—প্রতীকী ছবি।
নোবেলজয়ী লাতিন আমেরিকান ঔপন্যাসিক গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস ওয়ান হানড্রেড ইয়ার্স অব সলিটিউড-এ ‘ইনসমনিয়া প্লেগ’ অর্থাৎ অনিদ্রার মহামারির কথা বলেছিলেন। তাতে মাকোন্দো নামক জনপদে এসে রেবেকা নামের এক চরিত্র প্রথমে এই রোগে আক্রান্ত হয়। কিন্তু তাকে অগ্রাহ্য করে বুয়েন্দিয়া পরিবার। ক্রমে অবশ্য পরিবারটির সকলে বুঝতে পারে, তারাও ওই একই রোগের শিকার। ধীরে ধীরে সকলেই এই ‘ঘুম না হওয়া’র ব্যাধির সঙ্গে মানিয়েও নেয়। এর ফলে দেখা দেয় আরও নানা ধরনের মারাত্মক রোগ— যার মধ্যে অন্যতম, স্মৃতিভ্রম। কোভিড-কালে অতিমারি শব্দটির সঙ্গে আমাদের বিলক্ষণ পরিচয় ঘটেছে। কিন্তু অনিদ্রাও কি এক অন্য মহামারি হিসাবে দেখা দিয়েছে?
বিষয়টি কতখানি ছাপ ফেলছে জনস্বাস্থ্যে, তা কিছু পরিসংখ্যানের দিকে তাকালেই পরিষ্কার হয়ে যায়। চিকিৎসাবিজ্ঞান বলে, দিনে অন্তত সাত-আট ঘণ্টা ঘুম জরুরি। কিন্তু ‘আমেরিকান অ্যাকাডেমি অব স্লিপ মেডিসিন’-এর মতে, সে দেশের প্রতি তিন জনের এক জন অনিদ্রার শিকার। সম্প্রতি ২০০০ আমেরিকান নাগরিকের উপরে সমীক্ষা চালিয়ে অন্য একটি সংস্থা দেখেছে, মাত্র ছয় শতাংশ মানুষ আট ঘণ্টার বেশি সময় ঘুমোতে পারেন। কিন্তু তাও, নির্বিঘ্নে-নিশ্চিন্তে নয়। কিছুটা একই রকম উদ্বেগজনক পরিসংখ্যান ভারতের ক্ষেত্রেও। এক সমীক্ষক দল ৪১,০০০ মানুষকে নিয়ে একটি সমীক্ষা করে। তাতে দাবি করা হয়েছে যে, বর্তমানে ৬১ শতাংশ ভারতীয় ছ’ঘণ্টারও কম ঘুমোচ্ছেন রাতে। ২০১৯-এ অপর একটি গবেষণায় আবার প্রকাশিত, ঘুম-বঞ্চিত দেশগুলির মধ্যে ভারত রয়েছে দ্বিতীয় স্থানে (শীর্ষে জাপান)। বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবন করে তৈরি হয়েছে ‘বিশ্ব ঘুম দিবস’-ও। প্রতি বছর মহাবিষুবের (২১ মার্চ) আগের শুক্রবার এই দিনটি পালন করা হয়।
এমন উদ্বেগজনক তথ্যের আবহে, ঘুম সংক্রান্ত ব্যাধির তালিকাও কিন্তু ক্রমশ দীর্ঘ হচ্ছে। অনিদ্রা ছাড়া, ঘুম সংক্রান্ত ব্যাধির তালিকায় রয়েছে আরও নানা রোগ। যেমন স্লিপ অ্যাপনিয়া (ঘুমের মধ্যে দমবন্ধ লাগা), নারকোলেপসি (স্নায়ুঘটিত সমস্যা), হাইপারসমনোলেন্স (দিনের বেলায় অতিরিক্ত ঘুম পাওয়া) প্রভৃতি। তবে ইনসমনিয়া বা অনিদ্রাকেই ঘুমের ব্যাধিগুলির মধ্যে প্রধান হিসাবে ধরা হয়। এই ব্যাধির সঙ্গে জড়িয়ে থাকে আরও নানা ধরনের রোগে শিকার হওয়ার সম্ভাবনা। এই সমস্যার ফলে উচ্চ রক্তচাপ, হৃদ্রোগ, টাইপ-২ ডায়াবিটিস, অবসাদ, অ্যালঝাইমার’স, ডিমেনশিয়া, অতিরিক্ত উদ্বেগ, স্থূলতা, এমনকি কর্কট রোগের মতো নানা ঘাতক ব্যাধি বাড়ছে কয়েকগুণ।
প্রশ্ন ওঠে, ঘুম-বঞ্চনার নেপথ্যে কোন কারণগুলি রয়েছে? কেনই বা ঠিক সময়ে না ঘুমোনোর এই অভ্যাসকে আমরা প্রশ্রয় দিই? জিনগত ও বয়সবৃদ্ধির বিষয়গুলি এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ। তবে, এই প্রসঙ্গে প্রথমেই উল্লেখ্য আমাদের কাজের ধরন। এক সময় পুরোপুরি কৃষিনির্ভর ছিল আমাদের দেশ তথা বিশ্ব। তবে সময়ের সঙ্গে বেড়েছে কলকারখানা, যন্ত্রনির্ভর শিল্প। যন্ত্রের উপরে আমরা যত নির্ভরশীল হচ্ছি, ততই যেন দিন-রাতের পার্থক্য মুছে যাচ্ছে। এই প্রজন্মের কাছে ঘুমের তুলনায় বেশি প্রাধান্য পায় কখনও অতিরিক্ত কাজ, কখনও বিনোদন। অনেক সময় ঘুমের ধরনে বদল আসার কারণে রাতে বেশি ক্ষণ জেগে থাকা আর দিনের বেলায় ‘ঘুম-ঘুম ভাব’ বাড়তে থাকে। এ ছাড়াও, ঘুমে ব্যাঘাত ঘটানোয় পাল্লা দিতে হাজির কর্মক্ষেত্রে ও জীবনে ‘হেরে যাওয়া’ নিয়ে উদ্বেগ, আশঙ্কা। স্কুল, কলেজ, কর্মক্ষেত্রে আরও ভাল করতে হবে, আরও বেশি ‘আপ টু ডেট’ থাকতে হবে— এই তাড়না যেন আরও বেশি জাগিয়ে রাখে বর্তমান প্রজন্মকে। কিছু ক্ষেত্রে আবার খাদ্যাভাস, ওষুধের উপরে অত্যধিক নির্ভরতা কিংবা কোনও মানসিক বা শারীরিক সমস্যা থাকলেও অনিদ্রার সমস্যা দেখা দেয়। করোনা অতিমারিকেও কিন্তু কিছুটা দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা। বেশ কিছু গবেষণাপত্রে দাবি করা হয়েছে, করোনা অতিমারির ফলে আমাদের মস্তিষ্ক ও দেহের উপরে এক দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পড়েছে। যার একটি পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হল অনিদ্রা।
এই পরিস্থিতিতে অনিদ্রাকে আমরা অতিমারি বলব কি? বিজ্ঞান বলে, একটি রোগকে অতিমারি তখনই বলা হয়, যখন সেটি দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বের অধিকাংশ জায়গায়। সাধারণত এই রোগের কিছু বিশেষ লক্ষণ থাকে এবং সেগুলির চিকিৎসার কিছু নির্দিষ্ট পন্থাও থাকে। অনিদ্রাকে ‘জনস্বাস্থ্যের বিপর্যয়’ বলেছে আমেরিকার সংস্থা ‘সেন্টারস ফর ডিজ়িজ় কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন’-ও। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তরফেও অনিদ্রার সমস্যাকে ‘অতিমারি’র আখ্যা দেওয়া হয়েছে। সংক্রামক কোনও উপসর্গ না থাকলেও অনিদ্রা যে ক্রমশ অতিমারির মতো বিশ্বকে গ্রাস করছে, তা আমরা দেখেও যেন অগ্রাহ্য করে যাচ্ছি। এর প্রভাব আগামী দিনে কতখানি মারাত্মক হতে চলেছে, তা জানা এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা।