বিশ্ব উষ্ণায়নের প্রভাব পড়েছে পশ্চিমবঙ্গের জলবায়ুতে
Climate

বিপদ ঘরের দোরগোড়ায়

ভারতের সব রাজ্যেই ক্লাইমেট চেঞ্জ অ্যাকশন প্ল্যান তৈরি করছে— মূল লক্ষ্য জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করে বাতাসে কার্বন ডাইঅক্সাইডের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ করা।

Advertisement

কল্যাণ রুদ্র

শেষ আপডেট: ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ০৫:১৩
Share:

—ফাইল চিত্র ।

সারা পৃথিবীই বিশ্ব উষ্ণায়নের প্রভাবে কম-বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। ইন্টারগভর্নমেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জ-এর ২০২৩ সালে প্রকাশিত রিপোর্টে বলা হয়েছে, ১৮৫০-১৯০০ সালে পৃথিবীর স্থলভাগের গড় উত্তাপের তুলনায় ২০১১-২০২০ সালে পৃথিবীর গড় উত্তাপ ১.১ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড বেড়েছে। ২০০৬ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে পৃথিবীর সাগর-মহাসাগরের জলস্তর প্রতি বছর ৩.৭ মিলিমিটার হারে ফুলে উঠেছে। বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থার ২০২৪ সালে প্রকাশিত রিপোর্টে বলা হয়েছে যে, ২০২৩ সাল ছিল গত ১৭৪ বছরের ইতিহাসে পৃথিবীর উষ্ণতম বছর। ২০১৫ সালে প্যারিসে জলবায়ু সম্মেলনে বিশেষজ্ঞরা একমত হয়েছিলেন যে, ১৮৫০-১৯০০ সালের গড়ের তুলনায় পৃথিবীর উষ্ণতা যদি দেড় থেকে দুই ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড বাড়ে, তবে বাস্তুতন্ত্রে বড় ধরনের আঘাত লাগবে; সুতরাং আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত এই শতাব্দীতে গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধিকে দেড় ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের মধ্যে ধরে রাখা। বহু আলোচনার পরও পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধির হার অপ্রতিরোধ্য। সাগর-মহাসাগরের জলস্তর ১৯৯৩-২০০২ সালের মধ্যে ফুলে উঠেছিল বছরে ২.১৩ মিলিমিটার হারে, কিন্তু শেষ দশ বছরে তা বেড়েছে বার্ষিক ৪.৭৭ মিলিমিটার হারে। বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থা বলেছে, এ সবের মূল কারণ নানান উৎস থেকে বাতাসে মিশে যাওয়া কার্বন ডাইঅক্সাইড, মিথেন ও নাইট্রাস অক্সাইড ইত্যাদি গ্রিনহাউস গ্যাসের পরিমাণ বৃদ্ধি পাওয়া। ১৭৫০ সাল থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত বাতাসে ওই তিন ধরনের গ্যাসের পরিমাণ যথাক্রমে ১৫০, ২৬৪, ১২৪ শতাংশ বেড়েছে।

Advertisement

বাংলার উপকূলের পরিস্থিতি আরও উদ্বেগজনক। এক সমীক্ষা বলছে যে, বঙ্গোপসাগরের জল প্রতি বছর গড়ে তিন থেকে পাঁচ মিলিমিটার হারে ফুলে উঠছে, এবং সুন্দরবনের নবসঞ্চিত পলিস্তর জমাট বেঁধে বসে যাচ্ছে বছরে প্রায় ৩ মিলিমিটার হারে। দুইয়ে মিলে বঙ্গোপসাগরের জলস্তর প্রতি বছর কার্যত সাত মিলিমিটারের বেশি হারে ফুলে উঠছে। জলস্তর ক্রমশ উষ্ণ হয়ে ওঠার ফলে ঘনীভূত হচ্ছে ঘূর্ণিঝড়। অষ্টাদশ শতকে অবিভক্ত বাংলার উপকূলের ২০,০০০ বর্গকিলোমিটার এলাকা জুড়ে বিস্তৃত ছিল বাদাবন; এখন দুই বাংলা মিলিয়ে সুন্দরবনের বিস্তৃতি ১০৪৩৫ বর্গকিলোমিটার। ঔপনিবেশিক শাসকরা ৫৪টি দ্বীপের সব গাছ কেটে ফেলার পর পরিস্থিতি বদলে যায়। আগে বাদাবনের প্রাচীর ঝড় ও সাগরের ঢেউয়ের আঘাত থেকে উপকূলের ভূমিকে রক্ষা করত; এখন আগ্রাসী সাগর গিলে খাচ্ছে ভূমি, দ্বীপগুলি ক্রমশ ক্ষয়ে যাচ্ছে। গত পাঁচ দশকে ১০টি দ্বীপের ১২৪ বর্গকিলোমিটার ক্ষয়ে যাওয়ার ফলে বাস্তুচ্যুত হয়েছেন অনেক মানুষ। উপকূলে বাঁধ দিয়ে আগুয়ান সাগরকে ঠেকিয়ে রাখার চেষ্টা বারে বারে ব্যর্থ হওয়ার পর এখন উপকূলে আবার ম্যানগ্রোভের প্রাচীর ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চলছে। ক্ষয়িষ্ণু সাগরদ্বীপের অগভীর জলের মধ্যে টেট্রাপড ফেলে পলি সঞ্চয় প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করার প্রকল্প কিছুটা সফল হয়েছে।

ভারতের সব রাজ্যেই ক্লাইমেট চেঞ্জ অ্যাকশন প্ল্যান তৈরি করছে— মূল লক্ষ্য জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করে বাতাসে কার্বন ডাইঅক্সাইডের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ করা। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের পরিবেশ বিভাগ রাজ্যের জন্য অ্যাকশন প্ল্যান তৈরি করছে। ১৯০১ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত রাজ্যের ৩৩৯টি স্থানে প্রাত্যহিক বৃষ্টিপাত, এবং ১৯৬৯ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত ৩২টি স্থানে মাপা প্রতি দিনের সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন তাপমাত্রা নিয়ে গড়া ভারতীয় আবহাওয়া দফতরের বিপুল তথ্যভান্ডার বিশ্লেষণ করেছে কলকাতার ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ও গবেষকদের একটি দল। সারা পৃথিবীর সঙ্গে সঙ্গে এই রাজ্যেও শীত এবং গ্রীষ্মে সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন তাপমাত্রা বেড়েছে কি না, এবং বৃষ্টিপাতের ধরন বদলে যাচ্ছে কি না, এই সব প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছেন গবেষকরা। আলোচনা ও গবেষণার সুবিধার জন্য ১২০ বছরের তথ্যভান্ডারকে ত্রিশ বছর করে চার ভাগে ভাগ করা হয়েছে এবং গত তিন দশকের (১৯৯১-২০২০) জলবায়ুর পরিবর্তন বিশেষ ভাবে বোঝার চেষ্টা করা হয়েছে। ভারতীয় আবহাওয়া দফতর সম্প্রতি প্রকাশিত এক রিপোর্টে জানিয়েছে যে, ২০২৩ সালে পশ্চিমবঙ্গের বার্ষিক গড় উষ্ণতা ১৯৮১-২০১০ সালের গড়ের তুলনায় ০.৮৩ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড বেশি ছিল; এবং ওই বছরটি ছিল গত ১২৩ বছরের ইতিহাসে উষ্ণতম। গত এক শতাব্দীতে রাজ্যের বার্ষিক গড় এবং সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন উষ্ণতা যথাক্রমে ০.৬৪, ০.৭১ এবং ০.৫৭ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড বেড়েছে। বঙ্গোপসাগরের জলের উষ্ণতাও ক্রমবর্ধমান।

Advertisement

গত তিন দশকে বৃষ্টিপাতেরও উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন হয়েছে; তবে হিমালয় থেকে সুন্দরবন পর্যন্ত এলাকার সাতটি অ্যাগ্রো-ক্লাইমেটিক জ়োন বা কৃষি-আবহাওয়া অঞ্চল একই ভাবে প্রভাবিত হয়নি। আলোচ্য ১২০ বছরের সময় কালকে দু’ভাগে ভাগ করে গবেষণা করে দেখা গিয়েছে যে, ১৯০১ থেকে ১৯৬০-এর তুলনায় ১৯৬১ থেকে ২০২০ পর্বে বর্ষার চার মাসে বৃষ্টির পরিমাণ হিমালয়, রাঢ় অঞ্চল ও উপকূলে ৩ থেকে ৮ শতাংশ বেড়েছে; গাঙ্গেয় সমভূমি ও তরাই-ডুয়ার্স অঞ্চলে কোনও হ্রাস-বৃদ্ধি না হলেও মালদহ ও দুই দিনাজপুরে বৃষ্টির পরিমাণ প্রায় ৬% কমেছে। কিন্তু শেষ তিন দশকের (১৯৯১-২০২০) সঙ্গে পূর্ববর্তী তিন দশকের (১৯৬১-১৯৯০) তুলনা করলে দেখা যাচ্ছে, পরিস্থিতি অনেক বদলে গেছে। বাংলার উপকূল, পশ্চিমের মালভূমি এবং বরেন্দ্রভূমিতে বর্ষার বৃষ্টি ৬ থেকে ১৪ শতাংশ বেড়েছে; গাঙ্গেয় সমভূমি এবং হিমালয়সংলগ্ন সমভূমিতে ৩ থেকে ৪ শতাংশ বৃষ্টি কমেছে। ভাগীরথী-হুগলি নদীর পশ্চিমের সমভূমিতে বৃষ্টির পরিমাণের কোনও হেরফের হয়নি।

মৌসুমি বা বর্ষার বৃষ্টিপাত আমাদের খাদ্য সুরক্ষার ভিত্তি। কিন্তু ওই বৃষ্টিপাতের ছন্দে যে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন ঘটেছে তা হল দুই দিনাজপুর, মালদহ-সহ দক্ষিণবঙ্গে জুনের প্রথমার্ধ এবং অগস্টের দ্বিতীয়ার্ধ থেকে সেপ্টেম্বর মাসের প্রথমার্ধ পর্যন্ত বৃষ্টি কমেছে। ভারতীয় আবহাওয়া দফতরের ঘোষণা অনুসারে বর্ষাকাল জুন মাসে শুরু হয়ে সেপ্টেম্বরে শেষ হয়। কিন্তু গত তিন দশকের তথ্য এবং আমাদের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা মিলিয়ে দেখা যাচ্ছে, যে মৌসুমি বায়ু জুন মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে বাংলায় প্রবেশ করার কথা, তা কোনও কোনও বছর দেরিতে আসছে এবং বৃষ্টিপাত অক্টোবর মাস পর্যন্ত দীর্ঘায়িত হচ্ছে। আলোচ্য সময়ে গোটা দক্ষিণবঙ্গে অক্টোবর মাসের বৃষ্টি ৪ থেকে ৪২ শতাংশ বেড়েছে, আবার হিমালয়ের দক্ষিণ ঢালে ও বরেন্দ্রভূমিতে ৯ থেকে ১০ শতাংশ কমেছে; তরাই-ডুয়ার্সে কোনও উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ঘটেনি।

বৃষ্টিপাতের ছন্দে এই পরিবর্তন আমাদের কৃষিব্যবস্থাকে প্রভাবিত করেছে। জুন মাসে বৃষ্টি বিলম্বিত হলে বীজতলা থেকে মাঠে ধান-চারা স্থানান্তরের কাজ পিছিয়ে যায়; আবার অক্টোবরে বৃষ্টি হলে পাকা ধান মাঠেই নষ্ট হয়ে যায়। বর্ষার প্রথমে অনাবৃষ্টি আর শেষে অতিবৃষ্টি মিলে এ যেন এক শাঁখের করাত। খরিফ চাষ পিছিয়ে গেলে রবি চাষও পিছিয়ে যায়।

২০২২ সালে ভারত সরকার ঘোষণা করেছে, ২০৭০ সালের মধ্যে এ দেশে নেট কার্বন নিঃসরণ সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রিত হবে। পরিবেশের স্বার্থে মানুষের জীবন শৈলীতে পরিবর্তনের ডাক দেওয়া হয়েছে। এই ‘মিশন লাইফ’ প্রকল্পের রূপায়ণ সহজ নয়। শিল্প, পরিবহণ ও গৃহস্থালিতে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমানো এক কঠিন চ্যালেঞ্জ; কিন্তু অসম্ভব নয়। কিছু কিছু পদক্ষেপ করা হলেও এখনও অনেক পথ চলা বাকি। ২০২৪-এ পারদ কোথায় পৌঁছবে, সেটাই এখন উদ্বেগের বিষয়।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement