লক্ষ কণ্ঠের পাঠ-উৎসব নয়, ব্যক্তিগত বুঝদারির বিষয়
Bhagavad Gita

গীতা-ই যখন বহুস্বরা

গীতা একই সঙ্গে দু’টি বইয়ের দ্যোতনা। একটি যুদ্ধের গীতা, অন্যটি দার্শনিক গীতা। এই বহুস্বর মাথায় রেখেই গীতা পড়তে হবে।

Advertisement

গৌতম চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ১৭ ডিসেম্বর ২০২৩ ০৮:৩১
Share:

দর্শন: মথুরা-বৃন্দাবন অঞ্চলের গীতা স্তম্ভ। —ফাইল চিত্র।

এত দিন কলকাতায় ক্রিসমাস ইভের অপেক্ষাটা ছিল অন্য রকম। সন্ধ্যায় আলো ঝলমল ক্যাথিড্রাল চার্চ, পার্ক স্ট্রিট ও পানভোজন। এ বার শুনছি সব অন্য রকম। সকাল পেরোলে তবে তো সন্ধ্যা। আর সে দিন সকালেই ব্রিগেডে লক্ষ কণ্ঠে গীতাপাঠ! ব্রিগেডে রাজনৈতিক দলের সভা সমাবেশ হয় জানতাম, তা বলে গীতা? ওই বইয়ের চতুর্থ অধ্যায়ের ৩৯ নম্বর শ্লোকে ‘শ্রদ্ধাবান লভতে জ্ঞানং তৎপরঃ সংযতেন্দ্রিয়ঃ’ বলা হয়েছে না? ব্রিগেডের স্থানমাহাত্ম্য, ২৪ ডিসেম্বর সকালের কালমাহাত্ম্য সবই দেখছি শ্রদ্ধা, জ্ঞান, সংযমের পরাকাষ্ঠা।

Advertisement

বেছে বেছে এই তারিখটা কেন? ঠিক আগের দিন, ২৩ ডিসেম্বর হরিয়ানার কুরুক্ষেত্রে শেষ হচ্ছে সপ্তাহব্যাপী গীতা মহোৎসব। সেখানে গীতা নিয়ে কুইজ়, হস্তশিল্প, খাবারদাবার ও হরেক মেলার আয়োজন। শনিবার সকাল ১১টায় রাজ্যের সবাইকে এক মিনিট গীতাপাঠ করতে হবে। তার পর চব্বিশ ঘণ্টাও কাটবে না। রবিবারেই কলকাতা আর কুরুক্ষেত্র মিলাবে এবং মিলিবে, এটাই পরিকল্পনা।

লক্ষ কণ্ঠে গীতাপাঠ নতুন চমক ঠিকই, কিন্তু ধর্মক্ষেত্র কুরুক্ষেত্রেও এই উৎসবটি নতুন। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর নির্দেশ মেনেই ২০১৬ সাল থেকে এই উৎসব। হরিয়ানা সরকারের ওয়েবসাইট সগৌরবে জানিয়েছে, এখন লন্ডন, মরিশাস, কানাডাতেও আন্তর্জাতিক গীতা উৎসব হয়। বৃন্দাবনে মহামণ্ডলেশ্বর গীতা মনীষী স্বামী জ্ঞানানন্দ নামে এক বিখ্যাত সন্ন্যাসী প্রবচনকার আছেন। তাঁকে উদ্ধৃত করে হরিয়ানা সরকারের বক্তব্য, ৫১৬০ বছর আগে শ্রীকৃষ্ণ যেখানে অর্জুনকে গীতার বাণী শুনিয়েছিলেন, কুরুক্ষেত্রের সেই ব্রহ্মসরোবরে এ বার উৎসব। প্রবচনকাররাই এখন ইতিহাসবিদ!

Advertisement

প্রধানমন্ত্রী মোদী আগামী রবিবার ব্রিগেডে থাকবেন কি না জানি না, কিন্তু উপরাষ্ট্রপতি জগদীপ ধনখড় হরিয়ানার উৎসব উদ্বোধন করবেন। আর ৫১৬০ বছরের বয়ঃক্রম? খুঁজতে খুঁজতে দেখা গেল, হিসাবটি দুই মরাঠির অবদান। প্রথম জন বালগঙ্গাধর টিলক। ১৯১০-১১ সালে মায়ানমারের মান্দালয়ের জেলখানায় বন্দি তিনি। বহু পরে সুভাষচন্দ্র বসুও সেখানে বন্দি ছিলেন। কিন্তু বিবেকানন্দের ভক্ত সুভাষের মনে যে ইচ্ছা কদাপি জাগেনি, সেটিই জাগরূক হল টিলকের মনে। লিখে ফেললেন শ্রীমদ্ভগবদ্গীতারহস্য। ১৯১৫ সালে সেই বই বেরোতেই দেশময় আলোড়ন। ইংরেজি থেকে হিন্দি, গুজরাতি, কন্নড়, তেলুগু, তামিলে অনুবাদ। বাংলায় অনুবাদ করলেন স্বয়ং জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর। তার আগে বঙ্কিম থেকে বিবেকানন্দ যা বলেননি, সেটাই জানালেন টিলক। খ্রিস্টধর্মের প্রায় ১৪০০ বছর আগে সৃষ্টি হয় গীতা। জৈন থেকে বৌদ্ধ, খ্রিস্টধর্ম সবই তার মানস-সন্তান। দ্বিতীয় জন শ্রীপুরোহিত স্বামী। ১৯৩৫ সালে এই মরাঠি পণ্ডিত বরোদার মহারাজের অর্থানুকূল্যে ছাপিয়েছিলেন তাঁর দ্য ভগবদ্‌গীতা: দ্য গসপেল অব দ্য লর্ড শ্রীকৃষ্ণ। আইরিশ কবি ইয়েটসকে সেই বই পাঠিয়ে লেখেন, “গ্রহণ করো এই গীতা। ভারতীয় ঐতিহ্যমতে এর উন্মোচন হয়েছিল ৫০৩৬ বছর আগে।”

ওয়ারেন হেস্টিংস গভর্নর জেনারেল না থাকলে কখনওই হত না শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার বিশ্বজোড়া রমরমা। লক্ষ, কোটি যত কণ্ঠেই গীতাপাঠ হোক না কেন, বইটা তো থাকতে হবে। এই যে শ্রাদ্ধে গীতাপাঠ করা হয়, ব্রাহ্মণদের গীতা ও পৈতে দান করতে হয়, সেই সংস্কৃতির উদ্ভব কবে? ছাপাখানা আসার আগে অবশ্যই নয়। সংস্কৃত জানা লোকজন রামায়ণ, মহাভারত, ভাগবত পড়তেন। বৃন্দাবন দাসের ‘চৈতন্যভাগবত’ নবদ্বীপের টোলে নিমাইয়ের লেখাপড়া নিয়ে জানাচ্ছে, ‘গীতা, ভাগবত, বেদ, ব্রাহ্মণ পঢ়য়ে।’ সংস্কৃত জানা ছাত্ররা গুরুমশাইয়ের কাছে এ সব শিখতেই পারে, কিন্তু পুরো মহাভারতের পুঁথি লিখে সংস্কৃত-অজ্ঞ আমজনতার কাছে বিলোনো বা গীতাপাঠের আসর বসানো আদৌ সম্ভব? গীতাপাঠ যে লক্ষ কণ্ঠের হরিবোল নয়, ব্যক্তিগত বুঝদারির, তার প্রমাণ কাশ্মীরি কবি কল্হণের রাজতরঙ্গিনী। “রাজা অবন্তীবর্মণ শেষ অবস্থায় গীতাপাঠ শ্রবণ ও বৈকুণ্ঠলোকের ধ্যান করিতে করিতে প্রাণত্যাগ করিলেন।”

বিশ্বগুরু ও তাঁর শিষ্যদের একটি তথ্য স্মরণ করানো যায়। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কেরানি, কলকাতার এশিয়াটিক সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতা সদস্য চার্লস উইলকিনস তখন সংস্কৃত থেকে ইংরেজিতে মহাভারত অনুবাদ করছেন। অসমাপ্ত পাণ্ডুলিপিটি তিনি সরাসরি কলকাতায় গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংসকে পাঠিয়ে দেন। হেস্টিংস উদ্যোগপর্বের ওই ছোট্ট অংশটি আলাদা করে লন্ডনে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির চেয়ারম্যান নাথানিয়েল স্মিথকে পাঠিয়ে দেন। লেখেন, “যাকে নিয়ে চিঠি, সে এর বিন্দুবিসর্গ জানে না। কিন্তু এটি কোম্পানির অর্থব্যয়ে ছাপা হওয়া উচিত।” ব্রিটিশরা যে ইসলামি শাসকদের মতো হিন্দুর অধ্যাত্মবাদকে হেলাফেলা করে না, মায় খ্রিস্টীয় ধর্মতত্ত্বের মৌল সিদ্ধান্ত হাজির এই প্রাচীন বইয়েও। অতঃপর ১৭৮৫ সালে কোম্পানির অর্থব্যয়ে লন্ডনে ছেপে বেরোয় বই। একে একে ফরাসি, রুশ, জার্মান অনুবাদ। ম্যাক্সমুলারের সম্পাদনায় ইংরেজিতে প্রথম ঋগ্বেদ অনুবাদ আরও পরে, ১৮৪৯ সালে। বেদেরও আগে শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার পাশ্চাত্যজয়।

সাতশো শ্লোকের এই বইয়ের বৈশিষ্ট্য কোথায়? মধ্যযুগে বৈদান্তিক শঙ্কর, দ্বৈতবাদী মধ্ব, দ্বৈতাদ্বৈতবাদী রামানুজ প্রত্যেকের আছে নিজস্ব গীতাভাষ্য। শঙ্কর জোর দিচ্ছেন জ্ঞানে, রামানুজ জ্ঞান ও কর্মের যুগল আশ্রয়ে। এই ব্যাখ্যাগুলিই ভারতীয় দর্শনের সম্পদ। মহাভারতে যেমন প্রাচীনত্ব, বৌদ্ধ অহিংসা, ব্রাহ্মণ্য প্রক্ষেপ সব মিলেমিশে, অষ্টাদশ পর্বের শ্রীমদ্ভগবদ্গীতাও সে রকম। বাংলা ভাষায় রামায়ণ, মহাভারতের সারানুবাদ লেখার কুড়ি বছর আগে বিশের দশকে রাজশেখর বসু গীতার অনুবাদ করেছিলেন। তাঁর মৃত্যুর পর সেটি বই হয়ে বেরোয়। সেই বইয়ের ভূমিকায় হঠাৎ চোখ আটকে গেল। রাজশেখর লিখছেন, “আপামর সাধারণকে গীতা মুখস্থ করিয়ে লাভ নেই।”

বিবেকানন্দের রাজযোগেরও আগে তামাম ভারতের গৃহীসমাজ যে শ্যামাচরণ লাহিড়ীর হাত ধরে ক্রিয়াযোগ শিখল, তাঁরও আছে একটি গীতাব্যাখ্যান। প্রায় ১৩০ বছর আগে সেই বইয়ে তিনি লিখছেন, ধর্মক্ষেত্র মানে ক্রিয়ার উপযোগী শরীর। কুরুক্ষেত্র মানে মন নিরুদ্ধ হওয়ার আগে ইন্দ্রিয়দের এ দিক-সে দিক ছোটাছুটি। গীতার প্রথম অধ্যায়ের ১৫ নম্বর শ্লোকে কুরু-পাণ্ডবদের যে শঙ্খনিনাদ, ‘পাঞ্চজন্যং হৃষিকেশো দেবদত্তং ধনঞ্জয়ঃ’, সেটিতে লাহিড়ীমশাইয়ের ব্যাখ্যা, “ভৃঙ্গ, বেণু, বীণ, ঘণ্টার শব্দ কূটস্থে দিতে লাগিল।” ব্রিগে়ডের লক্ষ কূটস্থ, মূলাধার বা স্বাধিষ্ঠানচক্র এই শব্দ অনুভব করতে পারবে তো?

লক্ষ কণ্ঠে পাঠ নয়, গীতার এক-একটি শ্লোক তন্নিষ্ঠ অধ্যয়নেই দর্শনের সারাৎসার। একটা ছোট্ট উদাহরণ দেওয়া যাক। দ্বিতীয় অধ্যায়ের ১২ নম্বর শ্লোকে ‘জনাধিপাঃ’ শব্দ আছে। রামানুজের ব্যাখ্যা, বহু আত্মার ভেদ বোঝাতেই এই বহুবচন। শাঙ্করভাষ্য অন্য রকম: এই বহুবচন দেহের নানাত্ব শিকার করিয়া, আত্মার নানাত্ব অভিপ্রায়ে নয়। ব্রিগেড কাকে মানবে? শঙ্কর, না রামানুজ? যাক গে, ক্যাডার তাতাতে নেতারা স্লোগান দেন, পদাতিক সৈন্যদের মার্চ পাস্ট করতে বিউগল বাজে, আর আমজনতাকে হিন্দুত্বে উদ্দীপ্ত করতে গীতা।

মধ্যযুগে শঙ্কর, রামানুজদের আমলেও গীতার ছিল না এই রাজনৈতিক গুরুত্ব। ছিল থাকবন্দি হিসাব। প্রথমে পুরাণ দেখো, তার পর মহাভারত। তাতেও সংশয় না মিটলে জাবাল-স্মৃতি, যাজ্ঞবল্ক্য স্মৃতি। তুষ্ট না হলে বেদ। ওটিই ধর্মকাঠামোর শেষ কথা। অধ্যাপক শিবাজী বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর ‘অথ মা ফলেষু কদাচন’ প্রবন্ধে জানাচ্ছেন, মধ্যযুগে শঙ্কর, রামানুজরা সকলে গীতাভাষ্য লিখেছেন, কিন্তু তাকে স্মৃতিশাস্ত্রের বর্গেই রেখে দিয়েছেন। গীতা তখনও পায়নি মহাগ্রন্থের সম্মান।

ছাপাখানা আসতেই বিরাট বদল। শিবাজী দেখিয়েছেন, ১৮০৮ সালে খিদিরপুর অঞ্চলের বাবুরাম প্রেসে প্রথম পুঁথি থেকে বই হয়ে ছেপে বেরোয় সংস্কৃত ভাষার গীতা। তার পরই অন্য খেলা। বঙ্কিম থেকে অরবিন্দ, টিলক, অ্যানি বেসান্ত থেকে মহাত্মা গান্ধী সকলে বলছেন, গীতাই ভারতীয় দর্শনের সারাৎসার। আর দ্বিতীয় অধ্যায়ের ৪৭ নম্বর শ্লোকই প্রধান: কর্মণ্যেবাধিকারস্তে মা ফলেষু কদাচন। “দ্বিতীয় লাইনটা আজকাল কেউ আর বলে না। মা কর্মফলহেতুর্ভূমা তে সঙ্গোঽস্ত্বকর্মণি”। ‘মা ফলেষু কদাচন’ আছে বলেই তো বঙ্কিম নিষ্কাম কর্ম ও অনুশীলন ধর্মের কথা বলেন, শিবাজীর মত। অরবিন্দ লেখেন, ক্ষত্রিয় যদি তার কর্তব্য নিষ্কামতায় সারে, পাপ লাগে না। পঞ্জাব কেশরী লালালাজপত রাইও সমান তালে বলেন, ধর্ম পালনের খাতিরে শত্রু তো বটেই, আত্মীয়দের নিধনও পাপকর্ম নয়। আর, দ্বিতীয় লাইনটি কিঞ্চিৎ জটিল, “কর্মফলার্থী হয়ো না। নৈষ্কর্মেও তোমার আসক্তি না হোক।” মহাত্মা গান্ধী আবার শেষ শব্দের ‘অকর্মণি’কে করে দেন ‘কর্মণি’। তাঁর বক্তব্য, নিষ্কাম কর্ম যোগ ও কর্মফলকামনা অকর্ম। নিষ্কাম কর্মের এই প্রাধান্য মধ্যযুগে ছিল না। দ্বিতীয় অধ্যায়ের ১৮ নম্বর শ্লোক ‘তস্মাদ্ যুধ্যস্ব ভারত’ মনে, ‘হে ভারত, যুদ্ধ করো’ শ্লোকটি শঙ্করাচার্য থেকে বঙ্কিম কারও সহ্য হয়নি। শঙ্কর ওটিকে খেলো যুক্তি বলেছিলেন। বঙ্কিম আরও চাঁছাছোলা, ওটি গীতার অযোগ্য। হাল আমলে রিচার্ড ডেভিস তাঁর দ্য ভগবদ্‌গীতা: আ বায়োগ্রাফি বইয়ে জানিয়েছেন, গীতা একই সঙ্গে দু’টি বইয়ের দ্যোতনা। একটি যুদ্ধের গীতা, অন্যটি দার্শনিক গীতা। এই বহুস্বর মাথায় রেখেই গীতা পড়তে হবে।

কিন্তু বিজেপি যে ভাবে গীতার বয়সকে পাঁচ হাজারে নিয়ে গিয়েছে, যুদ্ধং দেহি মনোভাবই প্রকাশিত। দার্শনিক গীতার মোক্ষ, ধ্যানযোগ, জ্ঞানযোগ অন্য বিষয়। শ্রমণধর্মে প্রভাবিত।

রোমিলা থাপর কি সাধে বলেছেন, গোতম বুদ্ধ সারথি থাকলে গীতা অন্য রকম হত।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement