দোসর: শাংহাই কোঅপারেশন অর্গানাইজ়েশনের বৈঠকে চিনে নরেন্দ্র মোদী ও ভ্লাদিমির পুতিন। ১০ জুন ২০১৮। রয়টার্স।
এই তো কিছু দিন আগেও মস্কো থেকে দু’শো মাইল দূরে, ভার নামের এক মফস্সল শহরে রাজ কপূরের রেট্রোস্পেকটিভ-এ এক রাশিয়ান বৃদ্ধার গলা বুজে এসেছিল আবেগে। রোমন্থন করেছিলেন পঞ্চাশের দশকের শুরুর— “সে ছিল ভয়াবহ দিন আমাদের। জার্মানির সঙ্গে যুদ্ধের পর কোমর প্রায় ভাঙা। ধ্বংসস্তূপের মধ্য থেকে মাথা তোলার চেষ্টা করছি সবাই। চার দিকে শুধু অভাব দুর্দশা। সে সময় আমাদের জন্য ছিলেন রাজ কপূর। ছিল তাঁর মুখের অমলিন হাসি। আমাদের চেয়ে ঢের দুর্দশাগ্রস্ত ভারতবাসীকে সেই হাসি সাহস জুগিয়েছিল। আমরাও তখন আশায় বুক বেঁধেছিলাম।” আওয়ারা, শ্রী ৪২০ ছবিগুলির পর সোভিয়েটবাসীর আশাবাদের প্রতীক হয়ে উঠেছিলেন রাজ কপূর। যে চরিত্রগুলির কিনা ঘরবাড়ি নেই, সংসার নেই, প্রেম নেই, অন্য পারে কারও সঙ্গে মিলন অসম্ভব, আবাদি সব বরবাদ হয়ে গিয়েছে। কিন্তু তদ্যপি খুশির গান গেয়ে চলেছেন তিনি, এক আওয়ারা দিল।
সে সোভিয়েট আজ ভেঙে খান খান, পঞ্চাশের দশকের ভারতই বা কোথায়। ঠান্ডা যুদ্ধ পার হয়ে আর এক নতুন ঠান্ডা যুদ্ধের শীতলতা নেমে যাচ্ছে এই গ্রহের শিরদাঁড়া দিয়ে। এ কথাও হয়তো ঠিক, ভারত-রাশিয়া সম্পর্কের সেই একনিষ্ঠ প্রেম আজ আর নেই। সময়ের প্রয়োজনের স্বার্থের বদলের সঙ্গে সঙ্গে নয়াদিল্লি আজ সম্পর্কের ক্ষেত্রে বহুগামী। তার রাধাকে চাই, মীরা ছাড়াও চলবে না। মস্কোর সঙ্গে আজ তারা মহাকাশ ভাগ করে নিয়েও পরমাণু প্রশ্নে ওয়াশিংটনের সহচর। কূটনৈতিক সম্পর্ক তো রাজ কপূরের ছবি নয়। বেশি দিন আবেগের ভেলায় ভাসতে পারে না, যদি না তার মধ্যে নাগাড়ে জোগান দেওয়া হতে থাকে স্বার্থের বীজ, দেনাপাওনার ঠান্ডা অঙ্ক। তা সত্ত্বেও বিশ্বের ছবি আমূল বদলে যাওয়ার পরেও সেই নেহরুর সময়কার ‘দ্রুজ়বা (বন্ধুত্বের স্লাভিক শব্দ)-দোস্তি’ ভারত-রুশি সম্পর্কে নিরন্তর বাতি জ্বালিয়ে রেখেছে। ইউক্রেন যুদ্ধের ক্ষত যত সর্বব্যাপী হয়ে উঠছে, ততই স্পষ্ট হচ্ছে, মোদী সরকার আসলে রাশিয়া-নির্ভরতা থেকে সিকি ভাগও সরবে না বা সরতে পারবে না। তার কারণ একটি নয়, একাধিক।
গত বছর অক্টোবরে ক্যানবেরায় এক সাংবাদিক বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্করকে প্রশ্ন করে বসেছিলেন, ইউক্রেনের উপর সামরিক হামলার কথা বিবেচনা করে ভারত কি রাশিয়ার থেকে অস্ত্র-নির্ভরতা কমানোর কথা ভাবছে? জবাবে জয়শঙ্কর যা বলেছিলেন, তা আসলে ভারত-রাশিয়া সম্পর্কের এক আবহমান মুখ। এই প্রাক্তন আমলা তথা মন্ত্রী সে দিন প্রথমেই স্বীকার করেছিলেন যে, ভারতের অস্ত্রের ভাঁড়ার রাশিয়ার কাছে সর্বার্থে ঋণী। রাশিয়ার প্রতিরক্ষা সরঞ্জামের গুণগত মানের ধারাবাহিকতা সংশয়াতীত। কিন্তু মোদ্দা কথাটা সে দিন যা বলেছিলেন বিদেশমন্ত্রী, তা হল— পশ্চিমের তাবড় তাবড় অস্ত্রবাগীশ দেশ তো ভারতকে একটা তির-ধনুকও দিত না দশকের পর দশক। তাতে ফলাফল কী হয়েছিল? ভারতের ঘাড়ের উপর সামরিক একনায়কতন্ত্র ফোঁস করতে শুরু করল। যে প্রতিবেশীকে নিয়ে আজও হিমশিম খায় ভারতীয় সীমান্ত। ঠান্ডা যুদ্ধের সময় আমেরিকা-সহ পশ্চিমের পাকিস্তানের সঙ্গে প্রণয়কেই সে দিন সামনে নিয়ে এসেছিলেন জয়শঙ্কর। বোঝাতে চেয়েছিলেন, সেই প্রবল বিপদের দিনে যে বন্ধু পাশে ছিল, তাকে ভুলে যাওয়ার কোনও কারণ আজও ঘটেনি। ভারত রণকৌশলগত নীতির স্বাধীনতায় বিশ্বাস করে— যাকে রণকৌশলগত বহুগামিতাও বলা চলতে পারে বোধ হয়। আমেরিকার সঙ্গে সখ্যের অর্থ আমেরিকার শত্রুর সঙ্গেও শত্রুতা করতে হবে, এই শর্তকে মেনে নেওয়া ভারতের বিদেশনীতির মন্ত্র নয়। ছিল না কোনও দিনই।
সে দিন যা বলেছিলেন জয়শঙ্কর, তা প্রকৃতপক্ষে পশ্চিমের রাশিয়া সংক্রান্ত নিরন্তর সমালোচনার মুখে নয়াদিল্লির অবস্থানগত ঢাল এবং তরোয়ালও। প্রায় নব্বই বছর আগে রাশিয়া থেকে রবীন্দ্রনাথ লিখছেন, “রাশিয়ার অবস্থা যুদ্ধকালের অবস্থা। অন্তরে বাহিরে শত্রু।” আশ্চর্যজনক ভাবে তা আজও একই ভাবে সত্য। ভারত তা জানে না, এমন নয়। কিন্তু সংলাপ এবং কূটনীতির কথা মুখে বললেও সবার সঙ্গে (সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্রের সঙ্গে) হাত মিলিয়ে প্রখর ভাবে মস্কোর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়নি ভারত, রাষ্ট্রপুঞ্জের মঞ্চে অথবা তার বাইরে। বরং আমেরিকার নিষেধাজ্ঞা এড়িয়ে যুদ্ধের বাজারে রাশিয়া থেকে বিপুল পরিমাণ অপরিশোধিত তেল অপেক্ষাকৃত সস্তায় কিনেছে।
একটু দেরিতে হলেও বাইডেন প্রশাসন ভারতের বাধ্যবাধকতার দিকটি বুঝতে শুরু করেছে এটা সত্য। কিন্তু কতটা মানছে, তা নিয়ে তর্কের অবকাশ আছে। এই তো গত মাসেই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সাম্প্রতিক আমেরিকা সফরে ঢক্কানিনাদে কান পাত দায় ছিল। ভারতের সুবিশাল বাজারের লোভে হোক, অথবা ভারত প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে চিনকে চাপে রাখার কৌশলই হোক, বাইডেন প্রশাসন দৃশ্যত মোদীতে মুগ্ধ। সে দেশের কংগ্রেসের যৌথ সম্মেলনে মোদীর প্রায় প্রতিটি বাক্যে উঠছে হাততালির হুল্লোড়। ভারতের উপর থেকে উচ্চপ্রযুক্তিগত প্রতিরক্ষাব্যবস্থায় বিধিনিষেধ তুলে নিয়েছে ওয়াশিংটন। ৩১টি নজরদারি ড্রোন কিনেছে ভারত (যদিও বিরোধীদের বক্তব্য, সেগুলি নাকি দরকচা মারা, তেমন কেজো নয়)। এফ-৪১৪ লড়াকু বিমানের ইঞ্জিন তৈরির জন্য ভারত-আমেরিকা চুক্তি সই করেছে। বোঝাই যাচ্ছে, অতীতের পাকিস্তানমুখিনতা ছেড়ে ভারত সম্পর্কে কিছুটা উদার সড়কে হাঁটার চেষ্টা করছে আমেরিকা।
কিন্তু এহ বাহ্য। আমেরিকা সফর সেরে দেশে ফিরেই সাউথ ব্লক থেকে প্রথম যে বিদেশি রাষ্ট্রনেতাকে মোদী ফোন করেন, তাঁর নাম ভ্লাদিমির পুতিন। তাঁকে সবিস্তার আমেরিকা সফরের মহিমা শুনিয়েছেন মোদী। ফোনপর্বের পর বিদেশ মন্ত্রক জানিয়েছে, রাশিয়ার সঙ্গে ‘বিশেষ এবং গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্ক’কে আরও প্রসারিত করা হবে।
সেই রাজ কপূরের সময়ে ফিরে তাকিয়ে যদি দেখি, ভারত এবং রাশিয়ার যূথবদ্ধতার রাস্তা গভীর অতীতচারী। স্বাধীনতার পর একটি নতুন দেশের কলকারখানা, রাস্তা, বন্দর, মহাকাশ প্রযুক্তি, পরমাণু শক্তি, জ্বালানি— সবেতেই এসে লাগত সুদূর মস্কোভা নদীর ঝাপট। একাত্তরে এসে সেই সম্পর্ক আরও গভীর হল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়। সে বছর অগস্টে ভারত ও সোভিয়েটের মধ্যে সই হয়েছিল যুগান্তকারী শান্তি সহযোগিতা চুক্তি। মিগ থেকে ব্রহ্মস ক্ষেপণাস্ত্র, যুদ্ধের ট্যাঙ্ক থেকে পরমাণু ডুবোজাহাজ— কেনা বেচার দোকানদারি থেকে বেরিয়ে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ক্রমশ যৌথ গবেষণার পথে হেঁটেছে নয়াদিল্লি ও মস্কো। এই তো ইউক্রেন হামলার আগে পুতিন ভারত সফরে এসে ছ’হাজারের উপর এ কে-২০৩ রাইফেল রফতানির চুক্তি সেরে গেলেন।
অস্ত্র এবং প্রতিরক্ষাই শুধু নয়। আমেরিকা তথা পশ্চিমকে এটাও বার বার বোঝাতে চাইছে নয়াদিল্লি যে, রাশিয়ার সঙ্গে নৈকট্যের আরও একটি ভূকৌশলগত যুক্তি রয়েছে। বেজিংয়ের সঙ্গে মস্কোর ঘনিষ্ঠতা একটি পর্যায়ের পর আর বাড়তে না দেওয়াটা শুধু ভারত নয়, পশ্চিমেরও অগ্রাধিকারের মধ্যে পড়ে। আর, চিন-রাশিয়া সম্পর্ককে পাহারা দেওয়ার জন্যও তো মস্কোর গায়ে গায়ে লেগে থাকা দরকার দিল্লির। একমাত্র ভারতই পারে রাশিয়ার সঙ্গে বিভিন্ন ক্ষেত্রে দর-কষাকষি করতে। আবার মস্কো ইসলামাবাদের সঙ্গে নতুন প্রতিরক্ষা সম্পর্ক তৈরি করছে, সেটিকেও যথাসাধ্য আটকানোর চেষ্টাও করতে হবে মস্কোর ঘনিষ্ঠ থেকেই।
আর এক বার ফিরে দেখা যাক ‘রাশিয়ার চিঠি’-র আর্ষবাক্যকে। “বর্তমান রাশিয়ার নিষ্ঠুর শাসনরীতির জনশ্রুতি সর্বদাই শোনা যায়— অসম্ভব না হতে পারে। নিষ্ঠুর শাসনের ধারা সেখানে চিরদিন চলে এসেছে, হঠাৎ তিরোভূত না হওয়ায়ই সম্ভব।”
ভ্লাদিমির পুতিনের ‘নিষ্ঠুর শাসনরীতি’কে দুনিয়ার সামনে তীব্র সমালোচনা করে দেশের অস্ত্রভাঁড়ারের চাবিটি হোয়াইট হাউসের হাতে সম্পূর্ণ ছেড়ে দেওয়া কখনওই সম্ভব হবে না নয়াদিল্লির। তার জন্য সরু দড়ির উপর দিয়ে হেঁটে যেতেই হবে। যেমনটা এখন হচ্ছে।