২০২২-এ কাতারের মাঠে। ফাইল ছবি।
দৃশ্য এক: ২০১৭। ম্যানচেস্টার সিটির অপ্রতিরোধ্য দৌড় প্রসঙ্গে আর্সেনালের বর্ষীয়ান কোচ আর্সেন ওয়েঙ্গার বললেন, “ওদের তেল আর ফুটবল বুদ্ধি, দুই-ই আছে।” তাঁর খোঁচা সিটি-র মালিকপক্ষ, আবু ধাবির শেখ মনসুরকে, তাঁদের সিটি ফুটবল গ্রুপ-এর বিনিয়োগ আজ ভারত-সহ বিশ্বের নানা প্রান্তে।
দৃশ্য দুই: ২০১৮। ২০২৬-এর ফিফা বিশ্বকাপ আয়োজনের দৌড়ে মরক্কোকে ১৩৪-৬৫ ভোটে হারিয়ে বাজিমাত করেছে আমেরিকা, কানাডা ও মেক্সিকো। ভোটাভুটিতে আরব ও আফ্রিকান ফুটবল ফেডারেশনের সমর্থন না পেয়ে ক্ষোভে ফুঁসছে মরক্কো। বিশেষ সমস্যা সৌদি আরবের ভূমিকা নিয়ে। অবশ্য এ বিষয়ে সৌদি কর্মকর্তা আগেই বলেছিলেন, আমেরিকা তাঁদের পরম মিত্র, মিত্রপক্ষের সঙ্গে তাঁরা থাকবেন। সে সময়ের ‘গালফ ক্রাইসিস’ তথা সৌদি-জোটের সঙ্গে কাতারের তীব্র কূটনৈতিক সংঘর্ষে মরক্কোর নিরপেক্ষ ভূমিকা সম্ভবত সৌদির পছন্দ হয়নি, খুঁটির জোর ব্যবহার করে আরও কিছু আরব দেশকে আমেরিকার প্রস্তাবে ভোট দিতে রাজি করায় তারা। এর পর শুরু হয় ঠান্ডা যুদ্ধ। ২০১৯-এ ইয়েমেন যুদ্ধে অংশগ্রহণ প্রত্যাহার করে মরক্কো, প্রত্যুত্তরে সৌদি রাজার মরক্কো সফর বাতিল করা হয়। সৌদি টিভি চ্যানেলে বিতর্কিত পশ্চিম সাহারাকে পৃথক দেশ দেখানো হয়, ক্ষুব্ধ হয় মরক্কো। সাংবাদিক জামাল খাশোগির হত্যার পর বাকি আরব দেশগুলোর সঙ্গে যুবরাজ মহম্মদ বিন সলমনের সমর্থনে নামতেও রাজি হয়নি মরক্কো। ২০২২-এ কাতারের মাঠে ‘অ্যাটলাস লায়ন’-দের প্যালেস্তাইনের পতাকা প্রদর্শন (ছবি) কতটা সংহতির প্রকাশ আর কতটা সৌদি-ইজ়রায়েল কূটনৈতিক মৈত্রীর বিরুদ্ধে বার্তা, সরাসরি তার উত্তর পাওয়া না গেলেও একটা বিষয় নিশ্চিত, ২০৩০-এর বিশ্বকাপ আয়োজনের দাবিতে ফের দ্বৈরথ হবে সৌদি আরব ও মরক্কোর। একুশ শতকের ফুটবল-দুনিয়া জুড়ে বর্তমান ভূ-রাজনীতির প্রতিফলন।
আধুনিক ফুটবলের চালিকাশক্তি বৃহৎ পুঁজি। বহু ক্লাবের শেয়ার বাজারে কেনা-বেচা হয়। ম্যানচেস্টার সিটির মালিক যেমন আবু ধাবি, মেসি-নেমার-এমবাপের মতো তারকাখচিত প্যারিস সঁ জরমঁ-র মালিক কাতারের আমির। অর্থের নিরন্তর প্রবাহ, ফিফার ফিনানশিয়াল ফেয়ার প্লে-র নিয়ম স্রেফ খাতায় কলমে। সৌদি আরবই বা কম কিসে? ২০২১-এ তারা ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের (ইপিএল) ‘বিগ সিক্স’-কে টেক্কা দেওয়ার আকাঙ্ক্ষায় শতাব্দীপ্রাচীন নিউকাসল ইউনাইটেডকে অধিগ্রহণ করেছে। পশ্চিম এশিয়ার দেশগুলির ফুটবল নিয়ে টানাটানিকে পশ্চিমি বিশ্বে বলা হয় ‘স্পোর্টসওয়াশিং’, যেমন বলা হয়েছে কাতার বিশ্বকাপকেও। অভিযোগ, মানবাধিকার লঙ্ঘনের দীর্ঘ ইতিহাস ঢাকতেই এই প্রয়াস। অবশ্য এমন রাষ্ট্রব্যবস্থায় এর আগেও বিশ্বকাপ হয়েছে, যেমন ১৯৩৪-এর ইটালি। বলা হয়, ১৯৭৮-এর সামরিক আর্জেন্টিনায় ফুটবল স্টেডিয়াম থেকে শোনা যেত রাজনৈতিক বন্দিদের আর্তনাদ। কাতারে অভিবাসী শ্রমিকদের মৃত্যু ও ‘কাফালা’ প্রথার নৃশংসতা বিস্তর সমালোচিত হয়েছে, তাতে বিশ্বকাপ আটকায়নি।
ফুটবলে ধনকুবেরদের বিনিয়োগের পথ কয়েক দশক আগেই ইউরোপে খুলে গিয়েছে ইটালির সিলভিয়ো বার্লুস্কোনি আর ইপিএল-এর হাত ধরে। ১৯৯২-এ ইংল্যান্ডের ‘সেরা’ ক্লাবগুলি পৃথক হয়ে ঝকঝকে নতুন ‘প্রিমিয়ার’ লিগ তৈরি করে, বিশাল অর্থ দিয়ে সম্প্রচারস্বত্ব কিনে নিয়েছিল রুপার্ট মার্ডকের স্পোর্টস চ্যানেল। এর পর সারা বিশ্বে ইপিএল সম্প্রচার শুরু করেন তিনি, শুরু হয় ফুটবল-বিনোদনের নতুন জমানা। একুশ শতকের শুরুতে এক দিকে রিয়াল মাদ্রিদের ধনকুবের প্রেসিডেন্ট ফ্লোরেন্টিনো পেরেজ় একের পর এক ‘গ্যালাকটিকো’-কে আকাশছোঁয়া দরে কেনা শুরু করলেন, অন্য দিকে রাশিয়ার রোমান আব্রাহামোভিচ চেলসি অধিগ্রহণ করে ইপিএল-এ খরচের সংজ্ঞাই দিলেন বদলে। তত দিনে কিছু ক্লাব রীতিমতো ধনী ‘ব্র্যান্ড’, তাদের টানে ইপিএল-এ আসেন বিশ্বের বহু ধনকুবের বিনিয়োগকারী, বাদ যাননি ভারতীয় ধনকুবেররাও। আইপিএল ও আইএসএল-এর পর মুকেশ অম্বানী নাকি ইপিএল-এও বিনিয়োগে ইচ্ছুক।
বিশ্বায়িত ফুটবল জগতে এক দিকে ফুটবল-উন্মাদনা বাংলাদেশ ও আর্জেন্টিনার ফ্যানদের কাছাকাছি নিয়ে আসে, অন্য দিকে মোটা টাকার আহ্বানে বিশ্বজয়ী কোচ মার্সেলো লিপ্পি ও লুইস স্কোলারি চিনের ক্লাবে পৌঁছে যান। প্রস্তাব আসে জেপি মর্গান চেজ়-সমর্থিত পৃথক ইউরোপীয় সুপার লিগের, যেখানে ধনীতম ক্লাবেরা আমেরিকান ক্রীড়া-মডেলে শুধু নিজেদের মধ্যে খেলে টিভি-সম্প্রচারের অফুরন্ত অর্থ ভাগাভাগি করে নেবে। অভিবাসী শ্রমিকদের রক্ত-ঘামে তৈরি লুসাইল স্টেডিয়ামে ফাইনালের মঞ্চে বিশ্বজয়ী মেসি ও পরাজিত নায়ক এমবাপের সঙ্গে ছিলেন কাতারের আমির, যিনি ওই দু’জনেরই ক্লাব-মালিকও বটে। ফুটবলের নিয়মেই ‘লাটিন আমেরিকান শিল্পী’ মেসি ও ‘ইউরোপীয় পাওয়ারহাউস’ এমবাপে প্যারিসের কাতারি ক্লাবের লিগ ফুটবলে ফিরে গিয়েছেন। আমরাও মেতে উঠেছি সাপ্তাহিক ফুটবলের উন্মাদনায়।