ভারতে আর্থিক অসাম্য দিনে-রাতে বেড়ে চলেছে। ফাইল চিত্র।
দুনিয়ায় এক নম্বর হতে ভারতীয়দের চিরকালই তুমুল আগ্রহ। কোন বিষয়ে এক নম্বর, তার আদৌ কোনও গুরুত্ব আছে কি না, এ সব প্রশ্ন নিয়ে আমরা তত মাথা ঘামাই না। সে দিক থেকে দেখলে, গত কয়েক বছরে অনেক কিছুতেই এক নম্বর হয়েছি আমরা। বিশ্বের উচ্চতম মূর্তিটি ভারতে; ২০২২ সালে দীপাবলি উপলক্ষে অযোধ্যায় ১৫ লক্ষ প্রদীপ জ্বালিয়ে ওয়ার্ল্ড রেকর্ড তৈরি হয়েছে; দুনিয়ার সবচেয়ে লম্বা চুলের অধিকারী টিনএজারটিও ভারতীয়। আর এখন দুনিয়ার দীর্ঘতম রিভার ক্রুজ়-ও ভারতেই।
কিন্তু, হিংসুটে লোকের তো অভাব নেই। তেমন কেউ বলতেই পারে, মূর্তি, প্রদীপ, চুল, জলযান— সবই তো বস্তু। এ দেশে মানুষের কী খবর? তাঁরা দুনিয়ার কোন স্থানে পৌঁছলেন? সেই প্রশ্নের মনপসন্দ উত্তর দেওয়ার জায়গাতেও পৌঁছে গিয়েছে ভারত। এত জন ভারতীয় এই ক’দিন আগেও বিশ্বের দ্বিতীয় ধনীতম ব্যক্তি ছিলেন— শেয়ার বাজারে কারচুপির অভিযোগে রাতারাতি সাত নম্বরে নেমে এসেছেন বটে, কিন্তু আশা করাই যায় যে, তিনি ফের ধনীতমদের তালিকার সিঁড়ি বেয়ে ঊর্ধ্বপানে যাবেন। অক্সফ্যাম-এর সাম্প্রতিক সমীক্ষা বলছে, ভারতে একশো কোটি ডলারেরও বেশি সম্পদের মালিকের সংখ্যা বাড়ছে হুহু করে— ২০০০ সালে গোটা দেশে এমন অতিধনী ব্যক্তি ছিলেন ন’জন; ২০১৭ সালে ১০১ জন, আর এখন ১৬৬ জন। মন্দ নয়।
একশো কোটি ডলারেরও বেশি সম্পদের মালিকের সংখ্যা যেখানে এমন প্রবল হারে বাড়ছে, সেখানে অক্সফ্যাম-এর রিপোর্টে প্রকাশিত এই তথ্যে অবাক হওয়ার কোনও কারণ নেই যে, ভারতে আর্থিক অসাম্যও দিনে-রাতে বেড়ে চলেছে। চরম আর্থিক অসাম্যের নিরিখে ভারত এখন দুনিয়ার প্রথম সারিতে। যদি ধনীরা ধনীতর হয়ে উঠতে থাকেন, আর অ-ধনীরা যেখানে ছিলেন সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকেন, তা হলে ধনী আর অ-ধনীদের মধ্যে ব্যবধান বাড়ে, এবং বলা চলে যে, এ ক্ষেত্রে ঊর্ধ্বমুখী ধাক্কার ফলে অসাম্যের পরিমাণ বাড়ল। অন্য দিকে, যদি ধনীরা যেখানে ছিলেন সেখানেই থেকে যান, কিন্তু অ-ধনীদের অবস্থা খারাপ হয়, তা হলেও অসাম্যের পরিমাণ বাড়ে। এ ক্ষেত্রে বলা যায় যে, নিম্নমুখী ধাক্কা লাগার ফলে অসাম্য বৃদ্ধি পেল। মনে রাখা ভাল যে, অসাম্য এ ভাবে বাড়তে পারে বটে— বাড়েও কখনওসখনও— কিন্তু, তেমন ঘটনা খুব নিয়মিত নয়। কারণ, এক জনের ক্ষতি হলে সচরাচর অন্য কারও লাভ হয়।
গোটা দেশে অসাম্যের মাত্রা বৃদ্ধির একটা তৃতীয়— এবং, ভয়ঙ্করতর— পথ আছে। এই তৃতীয় ক্ষেত্রটিতে ধনীরা ধনীতর হয়ে ওঠেন, দরিদ্ররা দরিদ্রতর হন। এই পরিস্থিতিতে ঊর্ধ্বমুখী এবং নিম্নমুখী, উভয় চাপই কাজ করে অসাম্যের মাত্রার উপর।
আমরা ইতিমধ্যেই জানি যে, সাম্প্রতিক কালে ভারতে ধনীরা আরও অনেক বেশি ধনী হয়ে উঠেছেন। দরিদ্ররা কি দরিদ্রতর হলেন? চরম দারিদ্র হ্রাস পাওয়ার পরও কি এমন কিছু দরিদ্র জনগোষ্ঠী রয়ে গিয়েছে, যারা দরিদ্রতর হয়েছে? চরম দারিদ্রে যদি পতিত না-ও হয়, আরও অনেক বেশিসংখ্যক পরিবার কি দারিদ্রের ফাঁদে পড়েছে? মানুষের আয় সম্বন্ধে নির্ভরযোগ্য তথ্য পাওয়া ভয়ানক কঠিন— কিন্তু জীবনযাত্রার বিভিন্ন সূচক থেকে অনুমান করা চলে যে, এই ঘটনাগুলো সাম্প্রতিক কালে ভারতে ঘটছে, বিশেষত কোভিড অতিমারি এবং তার পরিপ্রেক্ষিতে গৃহীত কিছু নীতিগত সিদ্ধান্তের ফলে।
তেমনই এক সূচক হল ক্রমবর্ধমান বেকারত্ব। যাবতীয় তথ্য বলছে, বিশেষত পুরুষদের মধ্যে কর্মসংস্থানহীনতার হার বেড়েছে। মহিলাদের ক্ষেত্রে এটা যতখানি কর্মসংস্থানহীনতা, তার চেয়ে বেশি ঘটেছে লেবার ফোর্স পার্টিসিপেশন রেট হ্রাস— কর্মক্ষম বয়ঃসীমার মধ্যে থাকা মেয়েদের যত শতাংশ কাজ খুঁজছেন, সেই সংখ্যাটা কমে গিয়েছে। অর্থাৎ, আরও বেশি সংখ্যক মেয়ে আর কাজ খুঁজছেনই না। কেন, তার ব্যাখ্যা অনেক রকম, এবং সব ব্যাখ্যাই জটিল। পাশাপাশি, শিশুদের মধ্যে চড়া, এবং ক্ষেত্রবিশেষে আরও বাড়তে থাকা অপুষ্টির স্তর জানাচ্ছে যে, বহু পরিবারের পক্ষেই বেঁচে থাকার জন্য ন্যূনতম প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো জোগাড় করাও কঠিন থেকে কঠিনতর হয়েছে। ক্ষুধার সূচকও অত্যন্ত স্পষ্ট ভাবে ঊর্ধ্বমুখী।
সম্প্রতি আরও একটি তথ্যসূত্র সামনে এল, যা থেকে বলা চলে যে, হ্যঁা, সত্যিই ভারতে আপেক্ষিক ভাবে দরিদ্রদের অবস্থা কোভিড-পরবর্তী সময়ে আরও খারাপ হয়েছে। প্রথম নামক অসরকারি সংস্থা ২০২২ সালের জন্য তাদের অ্যানুয়াল স্টেটাস অব এডুকেশন রিপোর্ট (রুরাল) প্রকাশ করল, যে রিপোর্টটি তার সংক্ষিপ্ত নাম ‘এএসইআর’ হিসাবেই বেশি পরিচিত। এর আগের এএসইআর প্রকাশিত হয়েছিল ২০১৮ সালের পরিসংখ্যান নিয়ে। মধ্যবর্তী বছরগুলিতে কোভিডের কারণে এই সমীক্ষা করা সম্ভব হয়নি।
এই রিপোর্টে বহু তাৎপর্যপূর্ণ তথ্য রয়েছে। সেগুলির মধ্যে একটি এই নিবন্ধের ক্ষেত্রে সরাসরি প্রাসঙ্গিক। পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে যে, ২০১৮ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে শিশুদের সরকারি স্কুলে ভর্তি হওয়ার অনুপাত তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। সামগ্রিক ভাবে স্কুলে ভর্তি হওয়ার প্রবণতা বৃদ্ধির কারণে সরকারি স্কুলে ভর্তির সংখ্যা বাড়েনি— ভারতে দীর্ঘ দিন ধরেই স্কুলে নাম লেখানো শিশুর অনুপাত ৯০ শতাংশের অনেকখানি বেশি। শিক্ষার উপরে মা-বাবাদের যে আস্থা আছে, এবং তাঁরা যে সন্তানকে পড়াতে চান, এনরোলমেন্ট রেশিয়ো দেখলে সেই কথাটি নিয়ে সংশয় থাকে না। কিন্তু, এখন সরকারি স্কুলে ভর্তির প্রবণতা বাড়ল কেন? আসলে অনেক ছেলেমেয়েকে বেসরকারি স্কুল থেকে ছাড়িয়ে সরকারি স্কুলে নিয়ে আসা হচ্ছে। এই প্রবণতাটি নিয়ে ইদানীং কালে যত আলোচনা হয়েছে, তার অধিকাংশই ইতিবাচক। বলা হয়েছে যে, সরকারি স্কুলগুলি শিক্ষাক্ষেত্রে এই নতুন চাহিদাকে সামলাতে পেরেছে, তা সুসংবাদ।
কিন্তু, এই প্রবণতাটি আদৌ তৈরি হল কেন? সরকারি স্কুলের জন্য এই নতুন চাহিদা তৈরি হওয়ার কারণ কী? অতীতে তো বেসরকারি স্কুলের রীতিমতো চড়া চাহিদা ছিল? ঘটনা হল, বেসরকারি স্কুলে সন্তানকে ভর্তি করার চাহিদার পিছনে ছিল অভিভাবকদের একটি বিশ্বাস— ঠিক বিশ্বাস, অথবা ভিত্তিহীন বিশ্বাস— সরকারি স্কুলের তুলনায় বেসরকারি স্কুলে লেখাপড়া ভাল হয়। এই বিশ্বাসটির আরও প্রকৃষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়, যখন মা-বাবার পক্ষে সব সন্তানকে বেসরকারি স্কুলে পড়ানো সম্ভব হয় না, তখন। যে সন্তানের প্রতি পক্ষপাত রয়েছে— পুত্র সন্তান, সবচেয়ে বুদ্ধিমান সন্তান, অথবা জ্যেষ্ঠ সন্তান, অথবা অন্য কোনও ধরনের পক্ষপাত— সেই সন্তানকে বেসরকারি স্কুলে ভর্তি করার প্রবণতাটিই এই স্কুলের গুণমানের প্রতি অভিভাবকদের বিশ্বাসের প্রমাণ। অন্য দিকে, আর্থ-সামাজিক অবস্থানে যে পরিবার যত উপরের দিকে, সেই পরিবারের সন্তানকে বেসরকারি স্কুলে পাঠানোর সম্ভাবনাও তত বেশি।
বেসরকারি স্কুলে হঠাৎ ছাত্রসংখ্যা কমতে আরম্ভ করলে বুঝতে হবে, স্কুলগুলোর পঠনপাঠনের মানে অকস্মাৎ অবনতি ঘটেনি, আসলে কোভিড চলাকালীন পরিবারগুলির আর্থিক সামর্থ্যে টান পড়ায় সন্তানকে এই স্কুলে পাঠানো অসম্ভব হয়েছে। অর্থাৎ, আরও বেশি সংখ্যক পরিবার কোভিডের সময়ে দরিদ্রতর হয়ে পড়েছে।
কিন্তু, একই সঙ্গে এএসইআর-এর ‘ট্রেন্ড ডেটা’ বা দীর্ঘকালীন পরিসংখ্যান থেকে এই কথাটিও অনুমান করা সম্ভব যে, এই দরিদ্রায়ণের জন্য শুধুমাত্র কোভিডকে দায়ী করা চলে না। বর্তমান রিপোর্টে এই প্রসঙ্গে কোনও আলোচনা নেই, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদি পরিসংখ্যান বলছে যে, ২০১৪ সাল থেকেই সন্তানকে সরকারি স্কুলে ভর্তি করার এই প্রবণতা লক্ষ করা যায়। তবে, অতিমারির সময়ে নিঃসন্দেহে প্রবণতাটি তীব্রতর হয়েছে।
এই ধরনের বিভিন্ন সূচক থেকে আপেক্ষিক দারিদ্র বৃদ্ধির যে পরোক্ষ, পারিপার্শ্বিক প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে, তা যদি সত্য হয়, তবে বলতেই হবে যে, অক্সফ্যাম বা অন্যান্য সূত্র থেকে ভারতে আর্থিক অসাম্য বৃদ্ধির যে দীর্ঘমেয়াদি প্রবণতার ছবিটি উঠে আসছে, তাতে বিস্মিত হওয়ার বিন্দুমাত্র কারণ নেই। ভারতে ধনীরা ধনীতর হয়ে উঠছেন, এবং যাঁরা বিপন্ন ছিলেন তাঁদের বিপন্নতা আরও বৃদ্ধি পাচ্ছে— যাবতীয় তথ্য আসলে এই প্রবণতাটির দিকেই ইঙ্গিত করছে।
কর্নেল ইউনিভার্সিটি, আমেরিকা