ঢেউ উঠবে, কারা টুটবে
COVID 19

বিকল্প যদি তৈরি করা যায়, প্রতিস্পর্ধাকে রুখবে কে

কোভিড সংক্রমণের প্রথম পর্বে কিছু দিন একটা কথা দুনিয়া জুড়েই খুব শোনা যেত: এই সঙ্কট গোটা পৃথিবীর, গোটা পৃথিবী এর বিরুদ্ধে একযোগে লড়বে।

Advertisement

অনির্বাণ চট্টোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ২৯ জুন ২০২১ ০৪:৫২
Share:

গত ১৮ থেকে ২১ জুন কোভিড ভ্যাকসিন নিয়ে একটি আন্তর্জাতিক বৈঠক হয়ে গেল। অবশ্যই ডিজিটাল পরিসরে। এ রকম সভা তো কতই হচ্ছে। ঠিকই, তবে এই আয়োজনটি একটু অন্য গোত্রের। ভ্যাকসিন নিয়ে গবেষণা এবং তার উৎপাদন ও বণ্টনের ব্যাপারে বিভিন্ন দেশের মধ্যে কী ভাবে সহযোগিতা গড়ে তোলা যায়, দুনিয়া জুড়ে সকলের কাছে সুলভে প্রতিষেধক পৌঁছে দেওয়া যায়, তার উপায় খোঁজার লক্ষ্যে এই সম্মেলনের আয়োজন করেছিল প্রোগ্রেসিভ ইন্টারন্যাশনাল নামক একটি আন্তর্জাতিক বামপন্থী সংগঠন। সম্মেলনে যোগ দেয় ল্যাটিন আমেরিকার পাঁচটি দেশের সরকার: আর্জেন্টিনা কিউবা বলিভিয়া ভেনেজুয়েলা ও মেক্সিকো, এবং আফ্রিকা ও এশিয়ার দু’টি দেশের দুই রাজ্য: কেনিয়ার কিসুমু ও ভারতের কেরল। আর ছিলেন গোটা কুড়ি দেশের ভ্যাকসিন নির্মাতা, অসরকারি সংগঠন, স্বাস্থ্যকর্মীরা। ছিলেন এ দেশের ‘আশা’ কর্মী সংগঠনের প্রতিনিধিরাও। উদ্যোক্তারা বলেছেন, একটা নতুন আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থা (নিউ ইন্টারন্যাশনাল হেলথ অর্ডার) গড়ে তুলতে হবে, তার কাজ শুরু হয়েছে। তাঁরা বলতেই পারতেন: ঢেউ উঠছে, কারা টুটছে।

Advertisement

কোভিড সংক্রমণের প্রথম পর্বে কিছু দিন একটা কথা দুনিয়া জুড়েই খুব শোনা যেত: এই সঙ্কট গোটা পৃথিবীর, গোটা পৃথিবী এর বিরুদ্ধে একযোগে লড়বে। শুনে বেশ লাগত, মনে হত— আলো ফুটছে, প্রাণ জাগছে। কিন্তু দেখতে দেখতে সেই সঙ্কল্পের রংমাটি ধুয়েমুছে সাফ হয়ে গেল। কোভিডের সঙ্গে লড়াইয়ের ময়দানে পৃথিবীর যে মূর্তি এখন উন্মোচিত, তার সর্বাঙ্গে উৎকট বৈষম্যের সহস্রলোচন যেন আমাদের গিলে খেতে আসছে। ভাইরাসের প্রতিষেধক নিয়ে যে দখলদারি চলছে, তা এই বৈষম্যের এক ভয়াবহ রূপ। ‘ভ্যাকসিন ন্যাশনালিজ়ম’ নামক শব্দবন্ধটি অভিধানে ঢুকে পড়ল বলে, কিন্তু এ তো কেবল জাতীয়তাবাদ নয়, এ হল নির্ভেজাল ক্ষমতাতন্ত্র। তার নীতি: ক্ষমতা যার ভ্যাকসিন তার। প্রতিষেধক অনুমোদিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমেরিকা-সহ ধনী এবং শক্তিমান দেশগুলি চটপট তার সিংহভাগ বাজার থেকে তুলে নিয়েছে, অন্যদের হাতে খুদকুঁড়ো। বিশেষ করে আফ্রিকার অবস্থা সবচেয়ে শোচনীয়, সেখানে অনেক দেশ এখনও প্রায় কিছুই পায়নি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (হু) কর্ণধারের ক্ষুব্ধ তিরস্কার শুনেছি আমরা: ‘ভ্যাকসিন বর্ণবৈষম্য’ চলছে, এ এক মর্মান্তিক নৈতিক ব্যর্থতা।

ভ্যাকসিন একটি উপলক্ষ। এই উপলক্ষে আমরা স্বাস্থ্য ব্যবস্থার বিশ্বরূপটি দেখতে পাচ্ছি। আক্ষরিক অর্থেই সেটা এক দুনিয়াদারির রূপ। ভারত-সহ বহু দেশেই রোগের নিরাময় এবং নিবারণের ব্যবস্থাটিকে উত্তরোত্তর নিয়ন্ত্রণ করছে বিশ্বায়িত পুঁজি— ওষুধ, প্রতিষেধক, রোগনির্ণয় ও চিকিৎসার যন্ত্রপাতি ইত্যাদি ষোড়শোপচারে সজ্জিত বিপুল চিকিৎসা-ব্যবসায় আধিপত্যকারী অতিকায় কিছু কোম্পানি, তাদের অনুগামী ও সহযোগী নানা সংগঠন, এবং ধনী দুনিয়ার এক বিরাট অংশের রাষ্ট্রযন্ত্রগুলি। এই ব্যবস্থার প্রথম এবং প্রধান লক্ষ্য হল যত বেশি সম্ভব এবং যত দ্রুত সম্ভব মুনাফা বাড়ানো, রোগ নিবারণ ও নিরাময় সেই সাধনার হাতিয়ারমাত্র। কোভিড প্রতিষেধক সকলের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য সবার আগে দরকার ছিল তাকে পেটেন্ট-মুক্ত করে দুনিয়া জুড়ে তার উৎপাদন দ্রুত বাড়ানোর ব্যবস্থা করা। গোড়াতেই তার চেষ্টাও হয়েছিল— গত বছর হু-এর নেতৃত্বে কোভিড ভ্যাকসিনকে পেটেন্ট-মুক্ত করার একটা সামগ্রিক নীতি বলবৎ করার চেষ্টা অনেক দূর এগিয়েছিল, কিন্তু অচিরেই নানান কুযুক্তি দেখিয়ে সেই উদ্যোগ বিনাশ করা হয়, এমন কথাও বলা হয় যে, উন্নয়নশীল দেশগুলিকে ভরসা করে ভ্যাকসিন তৈরির দায়িত্ব দেওয়া যায় না। প্রসঙ্গত, দুনিয়ায় সবচেয়ে বেশি ভ্যাকসিন তৈরির ক্ষমতা ধরে একটি উন্নয়নশীল দেশ, তার নাম ভারত।

Advertisement

চেষ্টা এখনও চলছে, ঘরে-বাইরে নানা দিক থেকে, বিশেষ করে ডেমোক্র্যাট পার্টিতে অধুনা-প্রভাবশালী বামপন্থীদের চাপে পড়ে আমেরিকার প্রেসিডেন্টও কোভিড প্রতিষেধকের ক্ষেত্রে পেটেন্ট বিধিতে ছাড় দেওয়ার প্রস্তাব অনুমোদন করেছেন। কিন্তু সেই বিধি বিশ্ব বাণিজ্য সংগঠনের (ডব্লিউটিও) এক্তিয়ারে, এবং সেখানে ঐকমত্য ছাড়া সিদ্ধান্ত নেওয়া যায় না। জার্মানি-সহ ইউরোপের একাধিক দেশ পেটেন্ট ছাড় দিতে নারাজ, ফলে বিশ্ববাজারে ভ্যাকসিনের জোগান যথেষ্ট বাড়ানো যাচ্ছে না। এই বাধার পিছনে ভ্যাকসিন-নির্মাতা কোম্পানি ও তাদের সহযোগীদের স্বার্থের প্রভাব সুস্পষ্ট— পেটেন্ট তুলে নিলে ভ্যাকসিনের দাম হু-হু করে কমে যাবে, ফলে তাদের মুনাফা কমে যাবে, সেটা তারা মেনে নিতে নারাজ। তাতে জনস্বাস্থ্যের বিপদ বাড়লে, সেই বিপদ সামলাতে গিয়ে অর্থনীতির মন্দা দীর্ঘায়িত হলে, সেই মন্দার তাড়নায় গরিবের সর্বনাশ হলে মুনাফাতন্ত্র নাচার। প্রসঙ্গত, দরিদ্র দেশগুলিতে জনস্বাস্থ্য প্রসারে অনেক টাকা দিয়ে নাম কিনেছে, এমন সংস্থাও কোভিড টিকার পেটেন্ট বজায় রাখার জন্য বিস্তর কাঠখড় পুড়িয়েছে। অবাক হওয়ার কিছু নেই— কর্পোরেট জনকল্যাণ মুনাফাতন্ত্রের অঙ্গমাত্র।

জনস্বাস্থ্যের প্রয়োজনকে যদি মুনাফা বাড়ানোর প্রয়োজনের উপরে স্থান দিতে হয়, তবে স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় কর্পোরেট একাধিপত্যকে ভাঙা দরকার। সেখানেই নতুন আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থা নির্মাণের উদ্যোগটির বিশেষ গুরুত্ব। যে দেশ বা রাজ্যগুলির সরকার এই উদ্যোগে শামিল হয়েছে, তারা বামপন্থী, কেউ কেউ সরাসরি সমাজতন্ত্রী। কোভিড ভ্যাকসিনের গবেষণা, উৎপাদন ও সরবরাহের ব্যবস্থাটিকে তারা মুনাফার শাসন থেকে মুক্তি দিতে চায়। এই লক্ষ্যেই চার দিনের সম্মেলনে কয়েকটি নির্দিষ্ট অঙ্গীকার করেছেন সরকারি কর্তারা। এক, কেউ প্রতিষেধক তৈরি করতে পারলে তার পেটেন্ট ধরে রাখবে না, উৎপাদনের লাইসেন্স অবাধ করে দেওয়া হবে। দুই, ভ্যাকসিন যাচাইয়ের জন্য যে সব পরীক্ষানিরীক্ষা ও গবেষণা চালাতে হয়, সেগুলির সমস্ত তথ্যও সবাইকে জানিয়ে দেওয়া হবে। তিন, প্রতিষেধকের দাম যথাসম্ভব কম রাখা হবে, যাকে বলা হচ্ছে ‘সলিডারিটি প্রাইস’। চার, ভ্যাকসিন উৎপাদনের জন্য যেখানে যতটা পরিকাঠামো আছে বা দ্রুত তৈরি করে নেওয়া সম্ভব, তা পূর্ণমাত্রায় ব্যবহার করা হবে, সেই ভ্যাকসিন যে দেশেই আবিষ্কৃত হোক না কেন। কেরলের মুখ্যমন্ত্রী তাঁর রাজ্যে এই পরিকাঠামো তৈরি রাখার নির্দিষ্ট প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। জেনে একটু দুঃখই হল— এমন একটা উদ্যোগে তো আমাদের রাজ্যও শামিল হতে পারত! কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ আছে পশ্চিমবঙ্গেই। যাক সে কথা। পাঁচ নম্বর অঙ্গীকারটি একটু ভিন্ন গোত্রের, সেখানে বলা হয়েছে: ওষুধ ব্যবসার মহাশক্তিধর কোম্পানিগুলির আধিপত্যবাদকে সমবেত ভাবে অমান্য করতে হবে। ‘কালেক্টিভ ডিসওবিডিয়েন্স’ শব্দবন্ধটি সরবরাহ করেছেন বলিভিয়ার বিদেশমন্ত্রী— কর্পোরেট দুনিয়া ও ডোনাল্ড ট্রাম্পের হোয়াইট হাউসের সমস্ত তৎপরতাকে ব্যর্থ করে যে দেশটিতে গণতান্ত্রিক নির্বাচনে জয়ী হয়ে গত অক্টোবর মাসে ক্ষমতায় ফিরেছে এভো মোরালেস-এর অনুগামী এমএএস। দলের নামটির অর্থ: সমাজতন্ত্র অভিমুখী আন্দোলন।

কোভিড ভ্যাকসিনের উপযোগিতা নিয়ে তর্ক চলছে, হয়তো অনেক দিন চলবে। কিন্তু প্রশ্নটা নিছক ভ্যাকসিন নিয়ে নয়। ভ্যাকসিন যদি মুনাফাতন্ত্রের সাধনার উপলক্ষ হয়, তবে তা সেই তন্ত্রের বিরোধিতারও উপলক্ষ হতে পারে। এবং কেবল প্রতিবাদ নয়, বিকল্পের সন্ধানও সেই বিরোধিতার জরুরি অঙ্গ। বিশ্বায়িত কর্পোরেট পুঁজি এবং তার স্যাঙাত রাষ্ট্রের আগ্রাসী ক্ষমতাকে প্রতিহত করে লোকসমাজের মঙ্গলকে সরকারি নীতির সত্যিকারের লক্ষ্য করে তুলতে চাইলে অবশ্যই সেই ক্ষমতার যুক্তি ও দাপটের প্রতিবাদ করতে হবে, কিন্তু তার সঙ্গে সঙ্গে জনকল্যাণ বিধানের বিকল্পও তৈরি করতে হবে সমবেত উদ্যোগে। সেই বিকল্প এক দিকে সাধারণ মানুষকে বেঁচে থাকার শক্তি এবং প্রতিরোধের সামর্থ্য দেবে, অন্য দিকে আঘাত করবে মুনাফাতন্ত্রের গোড়ায়। কাল যদি কিউবায় বা অন্য কোথাও তৈরি কার্যকর প্রতিষেধক কিছু রাষ্ট্র, প্রদেশ এবং নানা সংগঠনের সমবেত প্রচেষ্টায় নানা দেশে উৎপাদন এবং বণ্টন করা যায়, তা হলে কেবল সেই দেশগুলির মানুষ উপকৃত হবেন না, প্রতিষেধকের জোগান কম রেখে মুনাফা বাড়ানোর চিরাচরিত একচেটিয়া কারবারি ছকটিও অনেকাংশে বা সর্বাংশে বানচাল হয়ে যাবে। সমবেত উদ্যোগ যদি জারি রাখা যায়, তবে আরও অনেকে সেই সমবায়ে শামিল হবেন, এমন সম্ভাবনাও প্রবল।

আশা করতেই পারি— এবং আশা করা অত্যন্ত জরুরি— কোভিড ভ্যাকসিন উপলক্ষে গড়ে ওঠা এই প্রতিস্পর্ধী সংহতি ক্রমশ জনস্বাস্থ্যের অন্যান্য বিষয়েও কার্যকর হবে, কার্যকর হবে লোকসমাজের অন্য নানা পরিসরে, শিক্ষায়, পরিবেশ রক্ষায়, মানবাধিকারের প্রসারে। ঢেউ উঠবে, কারা টুটবে, আলো ফুটবে, প্রাণ জাগবে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement